শুয়াইব হাসান
মার্চ ১৭, ২০২১
০৪:২৪ পূর্বাহ্ন
আপডেট : মার্চ ১৭, ২০২১
০৪:২৪ পূর্বাহ্ন
সিলেট বিমাবন্দর-বাদাঘাট বাইপাস সড়ক তৈরির প্রথম পরিকল্পনা ১৯৯৯ সালে। উদ্দেশ্য ছিল পাথরবাহী ভারী যানবাহন নগরে প্রবেশ না করে এই সড়ক দিয়েই চলাচল করবে। দুই দফায় কাজ শুরু হলেও বাস্তবে বাইপাস সড়কটি পরিকল্পনাতেই আটকে যাচ্ছে বারবার। ২২ বছর পর সড়কটির গুরত্ব বহুগুণে বেড়েছে। বেড়েছে জনসংখ্যা, যানবাহন, প্রয়োজন। তবুও সড়কটি বাস্তবে রূপ পাবে কিনা-এ নিয়ে সন্দিহান সিলেটবাসী।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) সিলেট জানিয়েছে, সম্প্রতি আবারও ‘উন্নয়ন প্রকল্প পরিকল্পনা (ডিপিপি)’ তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এ নিয়ে ভার্চুয়াল মাধ্যমে উচ্চ পর্যায়ের কমিটির সঙ্গে বৈঠকও হয়েছে। দু’চার দিনের মধ্যে এটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য উচ্চ পর্যায়ের টেকনিক্যাল টিম সিলেটে আসবে।
এর আগে আরও একটি ডিপিপি দিয়েছিল সওজ। গত বছরের ৮ আগস্ট বাংলাদেশ সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের যুগ্ম প্রধান জাকির হোসেনের নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল সরজমিন পরিদর্শনে সিলেট আসেন। তারা সিলেট বিমানবন্দর থেকে বাদাঘাট হয়ে তেমুখি পয়েন্ট পর্যন্ত বিভিন্নস্থানে দাঁড়িয়ে পুরো সড়কের রূপরেখা পর্যবেক্ষণ করেন। ঐদিন বিকেলে সিলেটে সাংবাদিক ও গণ্যমান্য ব্যাক্তিদের সঙ্গে আলোচনায় এ রাস্তাটি দ্রুত চার লেন বাস্তবায়নের আশ্বাস দেন। কিন্তু, ঢাকায় গিয়ে ১৭ আগষ্ট সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগে একটি প্রতিবেদন দেন। যেখানে ভবিষ্যত চার লেনের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে সড়কটি দুই লেনে নির্মাণের প্রস্তাব দেন।
এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন সিলেটবাসী। সিলেটের পেশাজীবী, ব্যবসায়ী, সাংস্কৃতিক সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ‘সিলেট উন্নয়ন পরিষদ’ এক সভায় এই প্রতিবেদনকে সম্পূর্ণ মনগড়া এবং বাস্তবতা বিবর্জিত প্রতিবেদন আখ্যায়িত করে বাইপাস সড়ককে ছয় লেনের ব্যবস্থা রেখে চার লেনে বাস্তবায়নের দাবি জানায়।
সিলেট নাগরিক সমাজের নেতারা বলছেন, এভাবে বারবার নানা অজুহাতে সড়কটি হিমাগারে পাঠানো হচ্ছে। সড়কটির গুরুত্ব বিবেচনায় ৬ লেনের সুবিধা রেখে আপাতত চার লেনে নির্মাণ করা হোক; এবং তা যেনো হয় শিগগিরই।
সড়কটি কেন এত গুরুপূর্ণ-এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে মিলল নানা তথ্য। দেশের সবচেয়ে বড় পাথর কোয়ারি ভোলাগঞ্জের অবস্থান সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে। প্রতিদিন সহস্রাধিক পাথরবোঝাই ট্রাক ভোলাগঞ্জ থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাতায়াত করে। কোম্পানীগঞ্জে আইসিটি পার্ক নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলছে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্লাইট সংখ্যা বাড়ছে, যাত্রীও বাড়ছে।
সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামও রয়েছে বিমানবন্দরের কাছাকাছি। বছরে প্রায়ই দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক খেলার আয়োজন হয়ে থাকে। আছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সিলেটের গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনকেন্দ্র ভোলাগঞ্জ, বিছনাকান্দি, রাতারগুল। যেখানে হাজার হাজার পর্যটকের সমাগম হয় প্রতিদিন।
সব গুরুত্ব অনুধাবন করে সাড়ে ৬শ কোটি টাকা ব্যয়ে সিলেট-ভোলাগঞ্জ মহাসড়ক নির্মাণ করে সরকার। বর্তমানে ২ হাজার ১১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে সিলেট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়ন হচ্ছে।
এতসব গুরুত্ব থাকা সত্তে¡ও বিমানবন্দর-বাদাঘাট বাইপাস সড়ক নির্মাণ না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে সিলেট উন্নয়ন পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক, আটাব সিলেটের সভাপতি আব্দুল জব্বার জলিল বলছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিলেটের উন্নয়নে আন্তরিক। কিন্তু, কিছু সিলেট বিদ্বেষী কুচক্রীর কারণে সিলেটের প্রতিটা গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে। এরা সিলেটের উন্নয়ন সবসময় বাধাগ্রস্ত করছে, সিলেটের যত উন্নয়ন পরিকল্পনা নেওয়া হয় তা বারবার হোঁচট খাচ্ছে।’
সিলেটকে পর্যটনসমৃদ্ধ এলাকা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সিলেটের পর্যটন বিকাশে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন জরুরি। যেহেতু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অনেক বিমান সংস্থা এখানে সরাসরি ফ্লাইট চালু করবে। আগামী ৫ থেকে ১০ বছর পরে এই সড়কে গুরুত্ব আরও বাড়বে।’
সবকিছু বিবেচনায় দীর্ঘ মেয়াদী চিন্তা মাথায় রেখে সড়কটি চার বা ছয় লেনের সুবিধা রেখে সড়কটি নির্মাণের দাবি জলিলের।
এদিকে, নগরের ভেতর দিয়ে ট্রাকসহ যাত্রীবাহী বিভিন্ন যান চলাচলের কারণে প্রায়ই যানজট লেগে থাকে। ঘটে ছোট-বড় বহু দুর্ঘটনা। সম্প্রতি এমন হতাহতের কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। নগরে যানবাহনের চাপ কমাতে এবং বিমানবন্দর-বাইপাস সড়ক নির্মাণের দাবি অনেক পুরনো। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় ২০০৯ সালে তৎকালীন সংসদ সদস্য ও অর্থমন্ত্রী আবুল আবদুল মুহিত বিমানবন্দর-বাদাঘাট বাইপাস সড়কটি নিজের অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে ঘোষণা দেন।
এরই ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালে ১০ আগস্ট বাইপাস সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তিনি। তখন ব্যয় ধরা হয় ৪৫ কোটি ৪২ লাখ ৯৬ হাজার টাকা। ২৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে করার পর উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল সড়কটির কাজের তদারকি করতে আসে। তারা জানায়-সড়কটি জাতীয় হাইওয়ে মানের হওয়ার কথা থাকলেও কাজ হয়েছে স্থানীয় পর্যায়ের। এই পথ দিয়ে ভারী যান চলাচল সম্ভব নয়-তাই সড়কটির কাজ ‘আপাতত স্থগিত’ ঘোষণা করা হয়। এই যে হিমঘরে প্রবেশ করে সড়কটি, আর আলোর মুখ দেখেনি।
কী কারণে আলোর মুখ দেখেনি তা পরিষ্কার না হলেও এই সড়কটির গুরুত্ব দিন দিন আরও বাড়ছে বলে মনে করেন সিলেট চেম্বারের সভাপতি এটিএম শোয়েব। তিনি বলছেন, ‘যেকোনো শহরের বিকল্প সড়ক থাকে। সিলেট বিভাগীয় একটি শহর। শহরের এই প্রান্তে একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। অথচ, বিমানবন্দর থেকে বিকল্প সড়ক নেই।’
এ কারণে বিশেষ করে পর্যটক ও প্রবাসী বিমানযাত্রীদের ভোগান্তি হচ্ছে বলে জানান চেম্বার সভাপতি। তিনি আরও বলেন, ‘বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনায় অথবা ট্রাকের প্রকট যানজটে বিমানবন্দরে যাওয়ার একমাত্র সড়কে যানজট সৃষ্টি হয়। এতে অনেকে বিমানের ফ্লাইট মিস করেন। বাইপাস সড়কটি নির্মাণ হলে যানজট কমবে, যেকোন প্রয়োজনে বিকল্প সড়ক ব্যবহার করা যাবে।’
বড় ভাইয়ের পথ ধরে সংসদ সদস্য হওয়ার আগে থেকেই বাইপাস সড়কটি চার লেন করার পরিকল্পনার কথা জানিয়ে আসছেন বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। নির্বাচনের পরে তিনি একাধিকবার এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছেন। দিয়েছেন আধাসরকারি পত্র (ডিও লেটার)।
১৯৯৯ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত অন্তত পাঁচ থেকে ছয় বার প্রকল্প পরিকল্পনা (ডিপিপি) তৈরি করা হয়েছে। দু’বার কাজও শুরু হয়েছে। তবে, ঠিক কী কারণে সড়কটি বাস্তায়ন হচ্ছে না তা জানেন না সড়ক ও জনপথ সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোস্তাফিজুর রহমান। এখন পর্যন্ত কতগুলো ডিপিপি হয়েছে সেটিও তার অজানা। তিনি বলেন, ‘আগে কী কারণে বাস্তবায়ন হয়নি তা বলতে পারব না। এবার উচ্চ পর্যায়ের টিম ডিপিপি পর্যালোচনা করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর প্রায় সব ব্যবস্থা ঠিক করেছে।’ সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী আগস্ট-সেপ্টেম্বর থেকে কাজ শুরু হবে বলে আশা করছেন তিনি।
প্রস্তাবিত ডিপিপি অনুযায়ী, ভোলগঞ্জ সড়কের পয়েন্ট থেকে বিমানবন্দরের পাশ দিয়ে বাইশটিলা ও বাদাঘাট হয়ে কুমারগাঁও (তেমুখী পয়েন্ট) পর্যন্ত বাইপাস সড়ক নির্মাণ হবে। দৈর্ঘ্য ১২ দশমিক ৭ কিলোমিটার। চার ফুট ডিভাইডার এবং প্রতি দুই লেনে ২৫ ফুট প্রস্থ থাকবে। সবমিলিয়ে ৫৪ ফুট প্রশস্ত হবে চারলেন সড়কটি। ২৪টি কালভার্ট, ২ টি সেতু নির্মাণও রয়েছে প্রস্তাবিত পরিকল্পনায়।
এসএইচ/বিএ-১৪