সিলেটের করোনাযোদ্ধাদের অন্য রকম ঈদ

নিজস্ব প্রতিবেদক


মে ১৮, ২০২১
০২:২০ পূর্বাহ্ন


আপডেট : মে ১৮, ২০২১
০৫:১৫ পূর্বাহ্ন



সিলেটের করোনাযোদ্ধাদের অন্য রকম ঈদ

ঈদের যে প্রথাগত আনন্দ-উচ্ছ্বাস, সেটা ছিল না। গত বছরের মতো এবারও ঘরবন্দী ছিল ঈদের আনন্দ। টিভি দেখা, ঘুমোনো কিংবা পারিবারিক আবহে ঈদের ছুটি যাপন করেছেন অনেকে। তবে এক রত্তি অবসর ছিল না করোনায় চিকিৎসায় নিযুক্ত চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের। তাই স্বজনদের সঙ্গে নয়, রোগীদের সঙ্গেই তাঁরা কাটিয়েছেন ঈদের ছুটির সময়টুকু। দায়িত্ব আর কর্তব্যকে সবার ওপরে স্থান দিয়ে তাঁরা ব্যস্ত ছিলেন রোগীদের সেবায়। হাসপাতালেই কেটেছে তাঁদের ঈদের দিনগুলো, রাতগুলো।

সারা দেশের মতো চিকিৎসক-নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের একই ধরণের ব্যস্ততা ছিল সিলেটের করোনা চিকিৎসায় ডেডিকেটেড শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালেও। এ হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এস এম সাজ্জাদুল হক বলেন, ‘ঈদ মানে স্বজনদের সঙ্গে কাটানো খুশির সময়। সাধারণ মানুষের মতো চিকিৎসক-নার্সরাও পরিবার পরিজন নিয়ে ঈদের দিন কাটান। তবে করোনা হাসপাতালে দায়িত্ব থাকার কারণে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে ঈদ মানেই দায়িত্ব। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নয়, হাসপাতালে রোগীদের সেবাতেই কেটেছে ঈদের দিন ও রাত।’

ডা.এস এম সাজ্জাদুল হক ঈদের দিন দায়িত্ব পালন করেছেন হাসপাতালের আইসিইউ ইউনিটে। সিলেট মিররকে তিনি বলেন, ‘সবাই ঈদ করে পরিবার ও স্বজনদের সঙ্গে। এটা হলো মানসিক একটা প্রশাস্তির বিষয়। এর পাশাপাশি দায়িত্বেরও একটা বিষয় আছে। দায়িত্ব পালনে একটা আলাদা শান্তি আছে আবার এক ধরনের চাপও আছে। হাসপাতাল হলো এমন একটা প্রতিষ্ঠান, যেখানে মানুষ আসবে চিকিৎসা সেবা নিতে। তাই এখানে সেই দায়িত্ব পালনে পিছপা হওয়া যাবে না চিকিৎসকদের।’

তিনি আরও বলেন, ‘যেহেতু আমরা করোনা ইউনিটে দায়িত্বপালন করছি তাই আমাদের চলাফেরাতে অনেক বিধি নিষেধ আছে। ঈদের দিন পরিবার পরিজনের মিলন মেলা হলেও হাসপাতাল থেকে যাওয়ার পর আমাকে থাকতে হয়েছে আলাদা রুমে। করোনা শুরু পর থেকেই বাসায় আলাদা রুমে থাকছি। সেখানে খাওয়া-দাওয়া করতে হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘তবে এই দায়িত্ব পালনে আনন্দ আছে। কারণ আমার রোগীরা হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়বেন আর আমি বাসায় ঈদ কাটাব বিষয়টি চিকিৎসারা মেনে নিতে পারেন না। তাই ঈদের দিন রোগীদের সেবা করে আমরা আনন্দ পাই, মানসিক প্রশান্তি পাই। তারাই যেন আমাদের আপনজন তখন। তবে এক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যরা আমাদের সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেন।’

গত ১৪ মে সারাদেশের মানুষ যখন ঈদ আনন্দে ব্যস্ত তখন হাসপাতালটির চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা ব্যস্ত রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য। দায়িত্বরত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঈদের দিনটা আনন্দের হলেও এভাবে হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করায় তাদের খুব বেশি আক্ষেপ নেই। কারণ মানুষের প্রয়োজনে তারা সবাইকে সেবা দিয়ে যেতে পারছেন এটাই তাদের বড় আনন্দ। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আনন্দের সময় কাটানোটা উপভোগ করতে না পারলেও পেশাগত দায়িত্ব থেকে সবাই চেষ্টা করে যাচ্ছেন রোগীদের সর্বোচ্চ সেবা দিয়ে যেতে। তবে দায়িত্বরত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য সহকর্মীদের বাসা থেকে এসেছে ঈদের খাবার। তাতেই হাসপাতালের মধ্যে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করেন তারা।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ঈদের দিন হাসপাতালে ৪৯ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। তাদের সেবা দিতে চিকিৎসক ছিলেন ১০ জন এবং নার্স ছিলেন ৩৪ জন। তবে ঈদের দিন রোগী ভর্তির চাপ কিছুটা কম ছিল।

ঈদের দিন হাসপাতালে দায়িত্ব পালনে আনন্দ যেমন আছে তেমনি পীড়াও আছে বলে জানান হাসপাতালটির মেডিকেল অফিসার ডা. মো. মিলাদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘ঈদের রাতে আমাকে হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। স্বাভাবিক সময়ে ঈদের দিন আমরা সকালে ঈদের নামাজ পড়ে পরিবার পরিজনের সঙ্গে সময় কাটাতাম। সন্ধ্যার পর আত্মীয়ের বাসায় ঈদ শুভেচ্ছা জানাতে যেতাম। তবে গত প্রায় একবছরের বেশি সময় ধরে সেই সুযোগ আমাদের হচ্ছে না।’ চিকিৎসা পেশা মহৎ পেশা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের সব সময় দায়িত্ব পালনে প্রস্তুত থাকতে হয়। তাই সেই দায়িত্ব পালন করে আমাদের যেমন আনন্দ লাগে তেমনি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ করতে না পারাটা পীড়াও দেয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের ১৫ দিন ডিউটি করলে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়। করোনা শুরু থেকেই আমাকে আলাদা বাসায় থাকতে হচ্ছে। বাসায় বাবা, মা, এক ভাই ও দুই বোন আছেন। তাই ঈদে পরিবারের সঙ্গে থাকার সুযোগ নেই। যার কারণে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর থেকেই ঈদগুলো পালন করতে হয়েছে ভার্চুয়ালি। ফোনেই তাদেরকে ঈদ শুভেচ্ছা জানিয়েছি।’

এবিষয়ে হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) সুশান্ত মহাপাত্র সিলেট মিররকে বলেন, ‘স্বাভাবিক সময়ে আমাদের সহকর্মীদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নিতাম। আমাদের মুসলিম সহকর্মীরা যাতে তাদের পরিবারের সঙ্গে ঈদ কাটাতে পারেন তাই আমরা অন্যান্যরা অতিরিক্ত দায়িত্ব নিতাম। তাতে আমাদেরও আনন্দ লাগত। তবে করোনা মহামারির কারণে গত এক বছর ধরে আমাদের কাছে সেই সুযোগ আসছে না। আমাদের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। যেহেতু পুরো বিশ্বে একটা মহামারি চলছে তাই এখানে দায়িত্ব এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। আর তাই আমরাও আবেগকে সীমিত করে দায়িত্ববোধ নিয়েই মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘স্বাভাবিক সময়ে ঈদের দিন আমরা আমাদের সহকর্মীদের বাসায় যেতাম। তবে এবার যেহেতু সেই সুযোগ নেই সেকারণে আমাদের এক সহকর্মীদের আমাদের জন্য ঈদের খাবার পাঠিয়েছেন। আমরা হাসপাতালে তা ভাগ করে সবাই খেয়েছি। এভাবেই হাসপাতালে দায়িত্বরত সবাই ঈদ কাটিয়েছেন।’

এনএইচ/আরসি-০১