নিজস্ব প্রতিবেদক
জুন ০১, ২০২১
০৫:০৫ পূর্বাহ্ন
আপডেট : জুন ০১, ২০২১
০৫:০৫ পূর্বাহ্ন
সিলেট নগরে ভূমিকম্প হলে তোড়জোড় শুরু হয়। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভাঙা ও ক্ষয়ক্ষতি রোধে পূর্ব প্রস্তুতির বিষয়টি সামনে আনা হয় ভূমিকম্পের পরে। কিছুদিন গেলে আবার বিষয়টি আড়ালে চলে যায়। তবে, অবহেলা না করে কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত শনিবার ও রবিবার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি মাত্রায় কয়েক দফা ভূমিকম্প অনুভত হয় সিলেট নগরে। যা অতীতে আর কখনও হয়নি। এরপর নড়েচড়ে বসে সিটি করপোরেশন। গতকাল রবিবার নগরে ঝুঁকিপূর্ণ ২৪ ভবনের তালিকা প্রকাশ করে সাত ভবন ১০ দিনের জন্য বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন সিটি মেয়র। অথচ, এসব ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে প্রায় ১৫ বছর আগে। এতদিনেও ভবনগুলোর বিষয়ে কার্যত উদ্যোগ না নেওয়ায় ঝুঁকি নিয়েই বসবাস করছেন অনেকে, ব্যবসা পরিচালনা হচ্ছে শপিংমলগুলোতে। ২০০৯ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিডিএমপি) পরিচালিত এক জরিপে জানা যায়, সিলেট অঞ্চলে ৫২ হাজার ভবন রয়েছে। এর মধ্যে ২৪ হাজার ভবনই ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এরপর নগরের ৩২টি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা প্রকাশ করা হয়।
২০১২ সালে সিলেটে ছোট-বড় ২৯টি ভূমিকম্প অনুভূত হয়Ñ বলে আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে। এরপর নড়েচড়ে বসে সিটি করপোরেশন। কিছুদিন পর সিটি করপোরেশনে কার্যক্রমে ভাটা পড়ে। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে আবারও ভূমিকম্পের বিষয়টি সামনে আসে। সিটি করপোরেশন ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে তালিকা ধরে অভিযান শুরু করে। প্রথমে নগরের তাঁতিপাড়াস্থ চারতলা একটি আবাসিক ভবন ভাঙা হয়। এরপর সিটি করপোরেশন পরিচালিত সিটি সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলার কয়েকটি ভবন ভাঙা হলেও পরে ভবনটি সেভাবেই রয়ে যায়।
গতকাল প্রকাশিত ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকায় ২৪ ভবনের কথা বলা হয়। যা ২০১৯ সালে ৩০ এপ্রিল সিসিকের প্রধান প্রকৌশলীর স্বাক্ষর করা। এর আগে শাবিপ্রবি প্রকাশিত ৩২টি ভবনের তালিকা ধরে কাজ করে সিসিক। গতকালের তালিকায় দেখা যায়, শাবিপ্রবির ২০০৫ সালে করা তালিকা থেকে কয়েকটি ভবন বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে, কী কারণে এসব ভবন তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে তা জানা যায়নি।
নতুন প্রকাশিত ভবনের মধ্যে রয়েছে, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের উত্তর পাশের কালেক্টরেট ভবন-৩, জেল রোডস্থ সমবায় ব্যাংক ভবন, মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় ভবন, সুরমা মার্কেট, বন্দরবাজারস্থ সিটি সুপার মার্কেট (সিটি করপোরেশন পরিচালিত), জিন্দাবাজারের মিতালী ম্যানশন, দরগাহ গেইটের হোটেল আজমীর, বন্দরবাজারের মধুবন সুপার মার্কেট, টিলাগড় কালাশীলের মান্নান ভিউ, শেখঘাট শুভেচ্ছা-২২৬ নম্বর ভবন, যতরপুরের নবপুষ্প ২৬/এ বাসা, চৌকিদেখির ৫১/৩ সরকার ভবন, জিন্দাবাজারের রাজা ম্যানশন, পুরানলেনের ৪/এ কিবরিয়া লজ, খারপাড়ার মিতালী-৭৪, মির্জাজাঙ্গাল মেঘনা এ-৩৯/২, পাঠানটুলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, উত্তর বাগবাড়ির একতা ৩৭৭/৭ ওয়ারিছ মঞ্জিল, একই এলাকার একতা ৩৭৭/৮ হোসেইন মঞ্জিল, একতা-৩৭৭/৯ শাহনাজ রিয়াজ ভিলা, বনকলাপাড়া নূরানী-১৪, ধোপাদিঘীর দক্ষিণ পাড়ের পৌরবিপণী মার্কেট, ধোপাদিঘিরপাড়ের পৌর শপিং সেন্টার ও জিন্দাবাজারের জেন্টস গ্যালারি। এর মধ্যে পুরান লেনের কিবরিয়া লজ মেরামত করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
এদিকে, ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স পরিচালিত একটি জরিপে জানা গেছে, সিলেটের হাজার হাজার বহুতল ভবনের মধ্যে মাত্র ১০৭টি ভবন বিল্ডিংকোড মেনে তৈরি হয়েছে। অন্য সবগুলো দালান নির্মাণে মানা হয়নি নিয়ম। এটি কয়েক বছর আগের তথ্য বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির উপপরিচালক মো. আনিসুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘ভবন নির্মাণের অনুমতি সিটি করপোরেশন দিয়ে থাকে। নির্মাণের পর এটির সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হয়েছি কিনা এবং ব্যবহার উপযোগী কি না, সে বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের কাছ থেকে প্রত্যয়নপত্র নিতে হয়।’ তবে, সিলেটে ভবন নির্মাণের পর এরকম আবেদনের পরিসংখ্যান জানাতে পারেননি নবনিযুক্ত এই কর্মকর্তা।
জানা গেছে, দুর্যোগ মোকাবেলায় আরবান কমিউনিটি ভলান্টিয়ার (স্বেচ্ছাসেবি) গঠনের কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়। এর মাধ্যমে ফায়ার সার্ভিস সিলেট মহানগরে ৫ হাজারের মতো যুবককে প্রশিক্ষণ দেয়। পরে এই কর্মসূচিও থমকে যায়।
ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলায় সিলেটে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে মাঝে-মধ্যে সভা-সেমিনার, কর্মশালা, ভূমিকম্পের মহড়া প্রদর্শনের মধ্যেই কার্যক্রম অনেকটা সীমাবদ্ধ। তবে, গুরুত্ব দিয়ে এ বিষয়ে একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরি করা জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ ও নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দ।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স এর ডিন অধ্যাপক ড. মুশতাক আহমদ সিলেটে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় প্রস্তুতি বিষয়ে বলেন, ‘সিলেট ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে, এটি আমাদের সবারই জানা। তবুও, প্রস্তুতি একেবারেই নগণ্য। মাঝে-মধ্যে ভূমিকম্প হলে এ নিয়ে কথা হয়। পরে আর কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায় না।’ তিনি বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে এটি বিবেচনার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘কার্যকর উদ্যোগ না নিলে বড় ধরনের ক্ষতির মুখোমুখি হতে হবে।’
সিলেট আবহাওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী জানান, ‘ভূমিকম্প হলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হবে বেশি। রান্নাঘরে গ্যাসের আগুন ও আতঙ্কে মানুষের ছোটাছুটির কারণে মারাত্মক ক্ষতি হবে।’ এ বিষয়কে অবহেলা না করে সত্যিকার অর্থে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘শুধুমাত্র ভবন চিহ্নিত এবং ভাঙ্গার কথা বলা হচ্ছে। এটিই শুধু পূর্ব প্রস্তুতি নয়। বিল্ডিং কোড মানানোর বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয় কম। সিলেটের বড় বড় মাঠগুলো পূর্বাবস্থায় নেওয়া প্রয়োজন। ভূমিকম্পের সময় খোলা জায়গা না থাকলে লোকজন কোথায় যাবে? নগরে যেভাবে বহুতল ভবন গড়ে উঠছে, সড়কেও মানুষ নিরাপদ বলে মনে হয় না।’
লামাবাজার মসজিদ মাঠ, চৌকিদেখী মাঠ, মেডিকেল কলেজ মাঠ, শেখঘাট কলোনীসহ বিলুপ্ত মাঠগুলো পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা এবং মধুবন মার্কেটসহ ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভেঙে খোলা জায়গা বাড়ানোর আহ্বান জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, সিলেটে এ যাবৎকালের মধ্যে ১৮৯৭ সালের ১২ জুন সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প হয় যা গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থ কোয়াক নামে পরিচিত। ৮ দশমিক ৭ মাত্রার সেই ভূমিকম্পে ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৫৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় পাকা দালানকোঠার ব্যাপক ক্ষতি করে। এরপর ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই সিলেটের শ্রীমঙ্গলে ভূমিকম্প ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। এর তীব্রতা ছিল ৭ দশমিক ৬।
২০০৯ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিডিএমপি) পরিচালিত জরিপে সিলেট অঞ্চলে ৫২ হাজার ভবন থাকার কথার কথা বলা হলেও গত ১২ বছরে আরও কয়েক হাজার ভবন তৈরি হয়েছে। সেগুলোর কত শতাংশ ভবন নির্মাণ কোড মেনে তৈরি হয়েছে তা বলা কঠিন।
আমেরিকান সংগঠন ফিমার বিধান অনুযায়ী, ৬ রিখটার স্কেলের ভূমিকম্প মোকাবেলা করতে ভিজিব্যাল স্ক্যানিং ফ্যাক্টর (ভিএসএফ) দুই (২)-এর উপরে হতে হবে। ভিএসএফ হচ্ছে ভূমিকম্পের ঝুঁকি নির্ণয়ের একটি পদ্ধতি। সিলেটের অধিকাংশ ভবনের ভিএসএফ কোনোটিরই ২ পর্যন্ত নেই বলে জানা গেছে। এ কারণে ৬ বা তার চেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে কত ভবন টিকবে তা বলা বাহুল্য।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব উদ্যোগে ২০০৬ সালে পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, সিলেট অঞ্চলে পাহাড় কাটা, অধিকতর বেলে মাটির ভূমির কারণে এবং সুপার স্ট্রাকচার, নকশায় ভুল, বহুমাত্রিক আকারের বাড়ি ও ভিমহীন বাড়ির সংখ্যা বেশি হওয়ায় এখানে ভূমিকম্প হলে ক্ষয়ক্ষতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।
আরসি-০২