ভালো নেই সিলেটের পরিবেশ ও প্রকৃতি

শুয়াইব হাসান


জুন ০৫, ২০২১
০৭:০৯ অপরাহ্ন


আপডেট : জুন ০৫, ২০২১
০৮:০৫ অপরাহ্ন



ভালো নেই সিলেটের পরিবেশ ও প্রকৃতি
# কেটে নিশ্চিহ্ন অর্ধেক পাহাড়-টিলা # নদীর নাব্যতা সংকটে খরা ও জলাবদ্ধতা # আবাস ও খাবার সংকটে বিলীন হচ্ছে বণ্যপ্রাণী

ভালো নেই সিলেটের পরিবেশ ও প্রকৃতি। পাহাড়-টিলা কাটা, পুকুর-জলাশয় ভরাট, নদ-নদীর নাব্যতা সংকট, বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ আর পানি দূষণে সিলেটে সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। পশু-পাখিও হারাচ্ছে তাদের আবাসস্থল।

এ অবস্থার উত্তরণে কার্যকর পদক্ষেপ নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। বরং, উন্নয়ন কাজের বেলায় পরিবেশকে প্রাধান্য না দিয়ে নিজেরাই ধ্বংস করছেন। পরিবেশবিদরা বলছেন, বিষয়টি এখনই অনুধাবন করে কার্যকর উদ্যোগ না নিলে অচিরেই বাসযোগ্যতা হারাবে সিলেট। 

গতকাল শুক্রবার পাহাড়ুটিলা ধ্বংসের প্রতিবাদে জৈন্তাপুর সদরে মানববন্ধন চলছিল। কর্মসূচি চলার সময় সামন দিয়ে মাটিভর্তি একটি ট্রাক বের হয়। জানতে চাইলে চালক জানান এসব টিলার মাটি! গোলাপগঞ্জের বাঘা ইউনিয়নে বোরহান উদ্দিন সড়কের পাশে গড়ে উঠেছে একটি বাজার। বাজারটির অর্ধেক অংশই ছিল ছোট-বড় টিলা। টিলাগুলো নিশ্চিহ্ন করে গড়ে তোলা হয়েছে দোকানপাট। 

এভাবে সিলেটে চলছে টিলা-পাহাড় কাটার মহোৎসব। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর অভিযোগ, কোথাও গোপনে, কখনও প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় আবার কখনও প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমঝোতায় এ অঞ্চলের পাহাড়ুটিলা কেটে অর্ধেক করা হয়েছে। 

শুধু বাঘা ইউনিয়ন নয়; গোলাপগঞ্জ উপজেলা, সিলেট সদর, জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, কানাইঘাটসহ উপজেলাসহ বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চলে টিলা কেটে গড়ে তোলা হচ্ছে ইট-পাথরের দালান। 

পরিবেশবিদরা বলছেন, একসময় সিলেট শহর ও আশপাশের শাহী ঈদগাহ, টিবি গেট, বালুচর, বিমানবন্দর এলাকা, মেজরটিলা, খাদিমপাড়া, লাক্কাতুরা, শাহপরান, বটেশ্বর, পাঠানটুলা এলাকায় অসংখ্য পাহাড় ও টিলা ছিল। গত তিন দশকে সিলেটে প্রায় অর্ধেক টিলা সাবাড় হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে সিলেট অচিরেই টিলাশূন্য হয়ে পড়বে। 

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) এর তথ্য অনুযায়ী, সিলেট সদর, গোলাপগঞ্জ, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি টিলা কাটা হচ্ছে। শহরে আবাসন গড়ে তুলতে সবচেয়ে বেশি টিলা কাটা হচ্ছে। এতে ভূমিধ্বসসহ নানাধরনের দুর্ঘটনার ঝুঁকি ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটতে পারে। 

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত ১৩৭ দশমিক ৫০ একর জায়গায় শাহ আরেফিন টিলা। লালচে, বাদামি ও আঠালো মাটির এ টিলার নিচে রয়েছে বড় বড় পাথর খণ্ড। খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ও আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের ফলে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে বিশাল এ টিলা। বর্তমানে টিলার বাইরের খোলসটাই কেবল রয়েছে, ভেতরে মাটি খুঁড়ে তৈরি করা হয়েছে বিশাল বিশাল গর্ত। 

পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাব মতে, গত দেড় দশকে সিলেটের ৬১টি টিলা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। জেলার ৪১২টি পাহাড়ুটিলার মধ্যে এখন টিকে আছে মাত্র ৩৫১টি। তবে পরিবেশ বিষয়ক সংগঠনগুলো বলছে, গত দুই দশকে শতাধিক টিলা সিলেট থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। 

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, ‘গত তিন দশকে সিলেট নগরের ৫০ভাগ টিলা ধ্বংস হয়ে গেছে। করের পাড়া, বালুচর, বাদামবাগিচা, বনকলাপাড়া, জালালাবাদ, শাহী ঈদগাহ, তারাপুর এলাকার টিলা সবচেয়ে বেশি কাটা হয়েছে। এসব বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরকে অবহিত করা হলে তারা কার্যকর উদ্যোগ নেন না। বরং, প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় লিয়াঁজো করে আরও দাম্ভিকতার সঙ্গে পাহাড়খেকোরা সক্রিয় হয়ে উঠে।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালের নভেম্বরে সিলেটে সব ধরনের পাহাড়ুটিলা কাটায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেন উচ্চ আদালত। এছাড়া পরিবেশ আইনেও পাহাড়ুটিলা কাটায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। যদিও আইন-আদালতের এসব বিধি-নিষেধের কোনো তোয়াক্কাই করছে না পাহাড়খেকোরা। 

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সিলেটের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ শাহেদা বলেন, ‘টিলা কাটার ব্যাপারে আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তার পরও টিলা কাটা বন্ধ হচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘টিলা কাটা বন্ধে অনেকবার আমরা পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন, ইউনিয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিদের চিঠি দিয়েছি। মাঝে মধ্যে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উদাসীনতার কারণে আমরা পাহাড়ুটিলা রক্ষা করতে পারছি না। এ বিষয়ে জনগণেরও সচেতন হওয়া উচিত।’

এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেটের পরিচালক মোহাম্মদ এমরান হোসেন বলেন, ‘পাহাড় কাটা আইনগতভাবে সম্পূর্ণ অবৈধ এবং পরিবেশ বিধ্বংসী কাজ। এমন কাজে জড়িতদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। গত এক বছরে এরকম দু’টি ঘটনায় সরাসরি অভিযান পরিচালনা করে ৩ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে।’

তিনি আরও জানান, যারা পাহাড়ুটিলা কাটছে, খবর পাওয়ার সঙ্গে সেইসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পরিবেশ আইনে মামলা করে এনফোর্সমেন্ট পরিচালনা করা হয়। এভাবে গত এক বছরে সিলেটে ৩৪ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ৮৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। 

কেবল পাহাড় কাটা নয়; গাছপালা কাটায় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ প্রশ্নবিদ্ধ। এতে পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। জীবজন্তু হারাচ্ছে তাদের আবাসস্থল। খাবার সংকটে লোকালয়ে বেরিয়ে আসছে বিভিন্ন প্রাণী। 

সিলেট শহরে প্রায়ই বানরের উৎপাত শোনা যায়। খাবারের সন্ধানে তারা মানুষের বাসাবাড়িতে ঢুকে পড়ছে। এ বিষয়ে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক জানিয়েছেন, বন উজাড়, পাহাড়ুটিলা কাটা ও শহরের পরিধি বিস্তৃতির ফলে বন্যপ্রাণী লোকালয়ে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছে। সিলেট শহর ছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিঅধিকার সংরক্ষণ বিষয়ক সংগঠন প্রাধিকার বলছে, তারা বছরে বিভিন্ন এলাকায় আটকের খবরে শতাধিক প্রাণী উদ্ধার করে বন বিভাগের কাছে হস্তান্তর করেন। মানুষের প্রাণিবান্ধব আচরণ নিশ্চিত করতে তারা কাজ করে যাচ্ছেন। 

পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন ভূমিসন্তান বাংলাদেশ-এর প্রধান সমন্বয়ক আশরাফুল কবির বলেন, ‘সিলেটে গবেষণা করলে দেখা যাবে- শতাধিক প্রজাতির পশু-পাখি ও বন্যপ্রাণী বিলীন হয়ে গেছে। বিষয়টি এলার্মিং। এর জন্য দায়ী আমরা মানুষ। সবচেয়ে উত্তম উদাহরণÑ সিলেটের রাতারগুল। সংরক্ষিত বিশেষ ধরনের বন হওয়া সত্ত্বেও সেখানে পর্যটনের নামে বন ধ্বংস হচ্ছে। একদশক আগে শতাধিক প্রজাতির প্রাণী থাকার কথা বলা হলেও এখন ১০ প্রজাতির প্রাণী পাওয়া যাবে না।’

সিলেটের নদনদী ও হাওরের নাব্যতা নিয়ে কারও মাথাব্যাথা নেই। শুষ্ক মৌসুমে সুরমা, কুশিয়ারা, সারি, পিয়াইন, খোয়াই ও ভাসিয়া নদীতে জেগে উঠে বালুচার। পানির প্রবাহ নেই বললে চলে। পানি সংকটে ব্যাহত হয় কৃষি। অপরদিকে, বর্ষা মৌসুমে উজান থেকে নামা পানি নামতে পারে না। মাটি ভরাটের কারণে নদনদী ও খাল-বিলে পানি আটকে যায়। প্রবাহ ঠিক না থাকায় দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা ও বন্যা দেখা দেয়। 

নদী গবেষক ও সেভ দ্য হ্যারিটেজ এর প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল হাই আল হাদী বলেন, ‘সুরমা-কুশিয়ারার মতো শাখা নদীগুলো মরে যাচ্ছে। পরিকল্পিতভাবে উদ্যোগ না নিলে সিলেটের কৃষিতে এর প্রভাব পড়বে। বর্ষায় স্রোত-প্রবাহ ঠিক না থাকায় দীর্ঘস্থায়ী বন্যাও দেখা দিবে।’

তবে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শহীদুজ্জামান সরকার বলছেন, ‘আপাতত সুরমা-কুশিয়ারা খননের পরিকল্পনা তাদের নেই। বিষয়টি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় দেখছে।’

নাব্যতা সংকটের পাশাপাশি সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও সচেতনতার অভাবে পানি দূষণও বাড়ছে। বিষাক্ত হচ্ছে জল। বিভিন্ন সময় নদী ও হাওরে মাছ মরে ভেসে ওঠার খবর পাওয়া যাচ্ছে। উজানে ভারত থেকে প্রবাহিত কানাইঘাটের লোভাছড়া ও জৈন্তাপুরের লালাখালে বছরে পানি নীল হয়ে যাওয়ার ঘটনাও পরিবেশ দূষণের একটি বড় উদাহরণ। 

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর ও পরিবেশ প্রকৌশল বিভাগের ডিন অধ্যাপক ড. মুশতাক আহমদ বলেন, ‘লালাখালে একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ঢলের সময় উজান থেকে ভারি শিল্পবর্জ্য নেমে আসে। এসব বর্জ্য পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের জন্য হুমকি।’ কিছুদিন আগে ভারতের একটি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদেও এরকম তথ্য পাওয়া গেছে। 

সিলেটে বায়ু ও শব্দ দূষণ বাড়ছে দিন দিন। এ বিষয়ে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার জানান, ২০১৭ সালে পরিবেশ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত এবং অংশীদারিত্বমূলক কর্মসূচির আওতায় শব্দের মানমাত্রা পরিমাপ জরিপ করা হয়। এই জরিপ থেকে জানা যায়, সিলেটে সর্বাধিক শব্দদূষণের শিকার করিমউল্লাহ মার্কেট এলাকা। আর সবচেয়ে কম শব্দদূষণ হয় কোর্ট এলাকায়। আবাসিক এলাকার মধ্যে শ্যামলীতে শব্দের সর্বোচ্চ মান ১২৪ দশমিক ১ ডেসিবল এবং সর্বনিম্ন ৫৮ দশমিক ৮ ডেসিবল। সবচেয়ে কম শব্দদূষণ হয় লন্ডনী রোড এলাকায়। এর সর্বোচ্চ শব্দ মান ৯৫ দশমিক ৫ ডেসিবল এবং সর্বনিম্ন ৬০ দশমিক ৭ ডেসিবল। মোটরযানের হর্ন এবং নির্মাণ কাজকে শব্দদূষণের মূল কারণ বলে দায়ী করা হয়েছে। 

এদিকে, শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে সিলেটে পরিবেশ অধিদপ্তর আদৌ কোনো উদ্যোগ নিয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করে জানা যায়নি। 

তবে, পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, গত এক বছরে তারা বায়ু দূষণ রোধে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। কেবল ইটভাটা থেকে ১ কোটি ৮৯ লাখ ৫ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। ৩৭টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান, ২৬টি স্টোন ক্রাশারের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেছে তারা। সবমিলিয়ে গত এক বছরে জরিমানা আদায় হয়েছে ৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। 

আরসি-১৬