জকিগঞ্জে পুলিশের সোর্সের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ

জকিগঞ্জ প্রতিনিধি


সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২১
১২:১১ পূর্বাহ্ন


আপডেট : সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২১
১২:১১ পূর্বাহ্ন



জকিগঞ্জে পুলিশের সোর্সের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ

পুলিশের সোর্স জামাল

সিলেটের জকিগঞ্জে পুলিশের সোর্স জামাল বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তার মিথ্যা মামলার অত্যাচার ও চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। নানা অপকর্ম করে ঘুরে বেড়ালেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন তিনি। পুলিশ সোর্স জামালের বিরুদ্ধে পুলিশের নামে মাদক ব্যবসা থেকে টাকা কামাই, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি, ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে মুক্তিপণ আদায়, চাঁদার টাকা না পেলে পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে থানা হাজতে নিয়ে ফাঁকা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর গ্রহণের মতো নানা অভিযোগ রয়েছে।

এ নিয়ে সিলেটের ডিআইজি বরাবরে পৃথক অভিযোগ দায়ের করেছেন দুই বিচারপ্রার্থী। অভিযোগকারীরা হলেন- জকিগঞ্জ ইউনিয়নের শিমেরবন্দ গ্রামের মৃত রইছ আলীর ছেলে হেলাল আহমদ ও বারঠাকুরী ইউনিয়নের কস্তইল গ্রামের মৃত ইয়াছিন আলীর ছেলে ছালেহ আহমদ।

লিখিত অভিযোগে হেলাল আহমদ দাবি করেন, গঙ্গাজল এলাকার জহির উদ্দিনের ছেলে জামাল নিজেকে র‌্যাব, পুলিশ ও ডিবি পুলিশের সোর্স দাবি করে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর নাম ভাঙিয়ে মাদক ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করে যাচ্ছেন। চাহিদামতো চাঁদার টাকা না পেলে একের পর এক মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো, ক্রসফায়ারের ভয় দেখানো, পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে নিয়ে নির্যাতন করাসহ নানাভাবে হয়রানি করে থাকেন তিনি। তার অত্যাচার, পুলিশ দিয়ে হয়রানি ও চাঁদাবাজিতে এলাকার লোকজন তটস্থ। পুলিশের সোর্স জামালের বিরুদ্ধে একাধিকবার লিখিত অভিযোগ দিলেও রহস্যজনক কারণে তার বিরুদ্ধে তদন্ত ও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এতে দিন দিন তিনি বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। কয়েকদিন আগে মিথ্যা মামলার ভয় দেখিয়ে হেলালের কাছে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেছিলেন জামাল। পরে হয়রানি থেকে রেহাই পেতে ভয়ে চাঁদার কিছু টাকা জামালকে দেওয়ার পর বাকি টাকা দিতে না পারায় হেলালের নিরপরাধ দিনমজুর ভাই শাহজাহান আহমদকে দুটি মিথ্যা মামলায় আসামি করেছেন জামাল। এমতাবস্থায় শাহজাহানের পরিবার অনাহারে-অর্ধাহারে মানবেতর জীবনযাপন করছে। জামালের অপকর্মের বিরুদ্ধে কারও কথা বলার সাহস নেই। প্রতিবাদ করলেই পড়তে হয় হয়রানির মুখে। তাই ভয়ে নিশ্চুপ থাকেন সাধারণ মানুষ।

তিনি জানান, উত্তরকুল গ্রামের মৃত ইয়াছিন আলীর ছেলে দিনমজুর ছালেহ আহমদ পুলিশের সোর্স জামালের হয়রানির সমালোচনা করায় জামাল ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর তাকে বিনা মামলায় পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে থানায় নিয়ে ৩ দিন হাজতে রেখে চোখ বেঁধে অমানুষিক নির্যাতন করিয়ে ক্রসফায়ারের ভয় দেখান। এরপর ছালেহ আহমদের স্ত্রী রাবিয়ার কাছে ১ লাখ টাকা দাবি করেন জামাল। টাকা না দিলে ডাকাতি মামলায় ছালেহকে চালান করা হবে বলে জানান। পরে রাবিয়া তার স্বামীকে ডাকাতি মামলা থেকে বাঁচাতে ৩৫ হাজার টাকা দেন। বাকি টাকা ছালেহ জামিনে বেরিয়ে দেবেন বলে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল জামালকে। এ আশ্বাসের প্রেক্ষিতে জামাল হাজতে গিয়ে ছালেহ আহমদের কাছ থেকে সাদা স্ট্যাম্পে সই নিয়ে রাখে। এরপর ওই বছরের ২৬ অক্টোবর ছালেহ আহমদকে ১৫১ ধারায় আটক দেখিয়ে পুলিশ দিয়ে আদালতে প্রেরণ করায় জামাল। কিন্তু ছালেহ আহমদ জামিন পাওয়ার পর জামালের দাবিকৃত চাঁদার বাকি টাকা পরিশোধ করতে পারেননি। এ কারণে আবারও হয়রানি শুরু হয়।

অভিযোগে বলা হয়, সাজানো, কাল্পনিক, মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলায় দিনমজুর শাহজাহান ও ছালেহ আহমদকে ফাঁসিয়েছেন জামাল। মিথ্যা ঘটনার সঙ্গে শাহজাহান জড়িত না থাকার বহু সাক্ষী, প্রমাণ ও সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থাকার পরও জামাল চাঁদার দাবিতে হয়রানি করে যাচ্ছেন। এছাড়া সুলতানপুর ইউনিয়নের খাদিমান গ্রামের নিরীহ, অসহায় কবির আহমদ নামের এক ব্যক্তিকে হয়রানি করেছেন জামাল। কবিরের কাছেও চাঁদা দাবি করে চাহিদামতো টাকা না পেয়ে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে হেনস্তা করেছেন পুলিশের এই সোর্স।

অভিযোগে হেলাল আরও উল্লেখ করেন, জকিগঞ্জ থানার সাবেক এক শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা, দারোগা, র‌্যাব ও ডিবি পুলিশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে জামালের গভীর সখ্যতা থাকার কারণে সাধারণ নিরীহ মানুষের কাছে নিজেকে সোর্স হিসেবে পরিচয় দেন তিনি। তিনি আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর নাম ভাঙিয়ে অসহায় সাধারণ মানুষ ও সীমান্তের দুর্ধর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করেন। চাঁদা সংগ্রহের জন্য জামালের নিজস্ব বাহিনীও রয়েছে।

অপরদিকে, আরেক বিচারপ্রার্থী বারঠাকুরী ইউনিয়নের কস্তইল গ্রামের ছালেহ আহমদ পুলিশের সোর্স জামালের নানা অপকর্ম ও মুক্তিপণ আদায়ের বর্ণনা দিয়ে ডিআইজি বরাবরে অভিযোগ দাখিল করেছেন। অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, জামাল ও তার স্ত্রী মিলে ৩টি মিথ্যা মামলায় তাদের একসময়ের ঘনিষ্ট বন্ধু আব্দুর রহমানকে চার্জশিটভুক্ত করিয়েছেন। চার্জশিটভুক্ত আব্দুর রহমান সম্পর্কে সালেহ আহমদের ভায়রা হন। আব্দুর রহমান পলাতক থাকার কারণে সালেহ আহমদ তার পরিবারের খরচাপাতি করে দিতেন। এ আক্রোশের জের ধরে জামাল পুলিশ দিয়ে তাকে বিনা মামলায় আটক করিয়ে ২ দিন হাজতে রেখে চোখ বেঁধে অমানবিক নির্যাতন করেন। পরে সালেহ আহমদের অভিভাবকরাসহ স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মহসিন মর্তুজা চৌধুরী থানায় গিয়ে পুলিশের হাতে-পায়ে ধরেন। একপর্যায়ে তৎকালীন ওসি বিষয়টি নিয়ে জামালের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। তখন জামালের সঙ্গে কথা বললে তিনি তাদের কাছে ৩ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন। পরে জামালের হাতে-পায়ে ধরে নগদ ৩৫ হাজার টাকা ও পরে আরও ১ লাখ টাকা মুক্তিপণ দেওয়ার গ্যারান্টি হিসেবে থানা হাজতে সাদা স্ট্যাম্পে সালেহ আহমদের সই নেন। পরবর্তীতে সাদা স্ট্যাম্প উদ্ধার করতে চেষ্টা করেন সালেহ আহমদ। এ নিয়ে জামাল ও সালেহ আহমদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এর জেরে আরও একটি মিথ্যা মারামারির মামলায় সালেহ আহমদকে জড়িয়ে হাজতবাস করিয়েছেন জামাল। 

অভিযোগে তিনি আরও বলেন, জামাল পুলিশের ছত্রছায়ায় থেকে জকিগঞ্জ থানার 'বিকল্প ওসি' হয়ে উঠেছিলেন। পুলিশের নামে সব ধরনের চাঁদা আদায়, মামলার তদবিরসহ লেনদেন করেন জামাল। এলাকায় কাকে ধরাবেন, কাছে ছাড়াবেন এসবের ঠিকাদারি ছিল জামালের কাছে। এ নিয়ে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা রেহানা পারভীন সিলেটের ডিআইজি বরাবরে কয়েকদিন আগে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন।

সালেহ আহমদ অভিযোগে দাবি করেন, জামাল এখনও তাকে হুমকি-ধমকি দিয়ে বলছেন মুক্তিপণের ১ লাখ টাকা না দিলে স্বাক্ষরযুক্ত সাদা স্ট্যাম্প ব্যবহার করে সালেহ আহমদকে আরও ১০টি মামলায় ঢোকাবেন। এমতাবস্থায় তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তিনি তার স্বাক্ষরযুক্ত সাদা স্ট্যাম্প উদ্ধার ও মিথ্যা মামলা থেকে রেহাই পেতে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে জামাল আহমদের দাবি, মুক্তিপণের জন্য নয়, নিজের নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনা করে সালেহ আহমদের কাছ থেকে একটি লিখিত স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিয়েছেন তিনি। হেলাল আহমদ ও ছালেহ আহমদের কাছে চাঁদা দাবিসহ নিরীহ মানুষকে হয়রানির অভিযোগগুলো মিথ্যা। জামাল নিজেকে একজন ভালো মানুষ হিসেবে দাবি করেন।


ওএফ/আরআর-০৫