সিলেট মিরর ডেস্ক
মার্চ ০৮, ২০২২
১২:৫২ অপরাহ্ন
আপডেট : মার্চ ০৮, ২০২২
১২:৫৪ অপরাহ্ন
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন সাজা প্রাপ্ত আসামি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীর ঢাকায় আত্মগোপন নিয়ে চলছে তোলপাড়।
দৈনিক মানবজমিনের অনুসন্ধানে দাবি করা হয়েছে, হারিছ চৌধুরী ছদ্মনাম-পরিচয়ে ১৪ বছর গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আত্মগোপনে ছিলেন। বেশিরভাগ সময়ই তিনি কাটিয়েছেন ঢাকার পান্থপথের একটি বাসায়। করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে তিনি মারা যান।
মানবজমিনের দাবি, হারিছ চৌধুরী আত্মগোপনের সময় মাহমুদুর রহমান নাম ব্যবহার করেন। এ নামে তিনি জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্টও নিয়েছিলেন। এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে দেওয়া তার মৃত্যু সনদেও ছিল ‘মাহমুদুর রহমান’ নাম।
এই মৃত্যুসনদ যাচাই করতে গিয়ে বিস্ময়কর নতুন তথ্য পেয়েছে নিউজবাংলা। দেখা গেছে, এই সনদে ব্যবহার করা ঠিকানায় সত্যিই একজন মাহমুদুর রহমান আছেন। তবে সেই মাহমুদুর রহমানের দাবি, তার ‘নাম ব্যবহার করা’ হারিছ চৌধুরীকে কোনোভাবেই তিনি চেনেন না।
মৃত্যু সনদে দেখা যায়, মাহমুদুর রহমানের ঠিকানা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের ১৩ নম্বর রোডের ২৪ নম্বর বাসার ২বি ফ্ল্যাট।
রোগীর অভিভাবকের নামে জায়গায় আব্দুল হাফিজ নামে এক ব্যক্তির নাম রয়েছে।
ওই ঠিকানা অনুযায়ী উত্তরার ভবনটিতে গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক চুন্নু মিয়ার সঙ্গে কথা বলেন নিউজবাংলার দুই প্রতিবেদক।
চুন্নু মিয়া জানান, ভবনটিতে ২বি নম্বরের কোনো ফ্ল্যাট নেই। তবে এবি-২ নম্বরের একটি ফ্ল্যাট আছে। সেই ফ্ল্যাটে থাকের ভবনের মালিক। আব্দুল হাফিজ নামে কাউকে চেনেন না বলেও দাবি করেন চুন্নু।
ওই ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে নিচে নেমে আসেন ভবন মালিকের স্ত্রী ফরিদা মাহমুদ রিপা।
রিপা বলেন, ‘বাড়ির এই জায়গাটা আমার শ্বশুরের। উনি ২০০১ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। আমার শ্বশুরের নাম শাহ মোহাম্মদ আব্দুর রহমান। উনার তিন ছেলে। বড় ছেলে মোহতাশেম রাজশাহীতে থাকেন। দ্বিতীয় সন্তান মোছাব্বের রহমান বগুড়ায় থাকেন। আর ছোট ছেলে শাহ মোহাম্মদ অনুপম মাহমুদুর রহমান আমার স্বামী।’
হারিছ চৌধুরীর মৃত্যু সনদে এই বাসার ঠিকানা ও মালিকের নাম মিলে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন রিপা।
তিনি বলেন, ‘গতকাল (সোমবার) জানলাম একজন রোগী এভারকেয়ার হাসপাতালের ভর্তির জন্য আমাদের বাসার ঠিকানা ব্যবহার করেছে। কারা করেছে? কেন করেছে সেটা জানি না।
‘এখন তো দেখি শুধু ঠিকানাই নয়, আমার স্বামীর নামও ব্যবহার করেছেন। আমার স্বামীর নাম শাহ মোহাম্মদ অনুপম মাহমুদুর রহমান। তবে নামটা অনেক বড় হওয়ার বেশিরভাগ লোকই তাকে মাহমুদুর রহমান নামে চেনে।’
এ ধরনের ‘কাকতালীয় ঘটনা’ কীভাবে ঘটতে পারে- তা জানা নেই বলে দাবি করছেন রিপা। তিনি বলেন, ‘আসলে সন্দেহ করার মতো তেমন কাউকে পাচ্ছি না এখন পর্যন্ত। তবে আমাদের তিন তলায় একটা অফিস ভাড়া দেওয়া আছে। সেখানে বাইরের অনেকের যাতায়াত আছে। এমনও হতে পারে, এখানে যাতায়াতের সুবাদে আমাদের সম্পর্কে জেনে কেউ সুযোগ মতো আমাদের নাম ঠিকানাটাই ব্যবহার করেছে।’
ভবনটিতে বসবাসকারীদের তথ্য দিয়ে রিপা বলেন, ‘আট তলায় যিনি থাকেন তার নাম খন্দকার মোরশেদ জাহান। উনি ব্যবসা করেন। সাত তলায় থাকেন কাইয়ুম সাহেব। গাজীপুরে তার গার্মেন্টস আছে। ছয় তলায় আবু সাইদ নামের যে ভদ্রলোক থাকেন উনি এনজিওতে চাকরি করেন। পাচ তলার শাহিন ভাই কোনো রাজনীতি করেন না।
‘আমার ভাসুরের ফ্লাট কিনে শরিফুল সাহেব চার তলায় থাকেন। তিন তলা তো মেজো ভাসুরের। উনি অফিস হিসেবে তিন তলা ভাড়া দিয়েছেন। আর দোতলায় আমরা থাকি। নীচ তলায় গ্যারেজ।’
ভবনের কেউ বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কিনা- এমন প্রশ্নে রিপার জবাব, ‘আমার ননদের স্বামী বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। উনার নাম জান্নাতুল ফেরদৌস। ওদের বাসা রাজশাহীতে। দুই বছর আগে তিনি মারা গেছেন।’
হারিছ চৌধুরী তার ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্টে ‘মাহমুদুর রহমান’ নাম ব্যবহার করেছিলেন। সে ক্ষেত্রে তথ্য যাচাইয়ের জন্য পুলিশ কখনও এ বাসায় এসেছিল কি না- জানতে চাইলে রিপার দাবি, এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি।
ভবন মালিক মাহমুদুর রহমানের সঙ্গেও যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘আমার পুরো নাম শাহ মোহাম্মদ অনুপম মাহমুদুর রহমান। ডাকনাম অ্যাপোলো। আমার নাম তুলনামূলক বড় হওয়ায় মূলত মাহমুদুর রহমান অ্যাপোলো আমি পরিচিত।’
হারিছ চৌধুরীর মৃত্যুসনদে ‘মাহমুদুর রহমান’ নাম ব্যবহারের তথ্যে উদ্বিগ্ন ‘আসল’ মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘আপনার মুখেই আমি এটা প্রথম শুনলাম। আমি তো জানিই না আমার নাম এবং আমার বাসার ঠিকানা তিনি (হারিছ চৌধুরী) ব্যবহার করেছেন। আমি কখনোই রাজনীতি করিনি, তার সঙ্গে আমার কোনোদিন পরিচয় হয়নি। তাকে আমি চিনিই না।’
তিনি বলেন, ‘আমি একজন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। এই জায়গাটা আমাদের। ডেপলপারস কোম্পানিকে দিয়ে বাড়িটা করেছি। এখানে মোট আটটি ফ্ল্যাট আছে। তার মধ্যে আমাদের চার ভাইয়ের চারটা আর বাকিগুলো কোম্পানি অন্যদের কাছে বিক্রি করেছে। পুরো ভবনে বিএনপির রাজনীতি করা বা সিলেট অঞ্চলে বাড়ি এমন কেউ নেই।’
মানবজমিনের তথ্য অনুযায়ী, ‘মাহমুদুর রহমান’ ছদ্মনামের হারিছ চৌধুরী মারা যাওয়ার পর গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর সাভারের জালালাবাদ এলাকার জামিয়া খাতামুন্নাবিয়্যীন মাদ্রাসার কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
মাদ্রাসা সুত্র বলছে, মাহমুদুর রহমান নামের মরদেহটি লন্ডনপ্রবাসী সামিরা চৌধুরী মুন্নু নিয়ে গিয়েছিলেন। সামিয়া হারিছ চৌধুরীর মেয়ে। দাফনের সময় সামিয়ার সঙ্গে ছিলেন তার মামা জাফর ইকবাল মাছুম। মরদেহ দাফনের পর তারা মাদ্রাসা উন্নয়নে পাঁচ লাখ টাকা অনুদান দেন।
হারিছ চৌধুরীর শাশুড়ি ফুলন নেছা লস্কর ও শ্যালক জাফর ইকবাল মাছুম থাকেন মিরপুরের পল্লবীতে।
তবে বিষয়টি নিয়ে তাদের কেউ কথা বলতে রাজি হননি।
এএফ/০৩