বিশ্বজিত রায়, জামালগঞ্জ
এপ্রিল ০৬, ২০২২
০৪:৪৫ অপরাহ্ন
আপডেট : এপ্রিল ০৬, ২০২২
০৪:৪৭ অপরাহ্ন
‘এই ভাঙ্গাডা বিপজ্জনকের লাখান দেখা যায়। এইডাত এখনও কোনো নিরাপত্তা আইছে না। বাঁশ নাই, বস্তা নাই, দাড়ি নাই। কিচ্ছু এখনও দেওয়া হইছে না। বস্তা এখন ভরা হইতাছে দেখছি। ঝুঁকি রইছে, ফাডা আছিন একটা, এইডারে ফাইরা-টাইরা, কোদাল দিয়া ফিরাইল অইছে। আমি ওই খালোই আছলাম, এখন বাড়িত আইছি। আমরা ঝুঁকির মধ্যেই আছি।’ বেহেলী ইউনিয়নের মামুদপুরের ভাঙা নিয়ে এভাবেই শঙ্কার কথা জানিয়েছেন হালি হাওর পারের মামুদপুর গ্রামের কৃষক লোকমান হোসেন।
নদীতে পানি বাড়ায় চরম অনিশ্চয়তা ও উৎকণ্ঠায় দিন পার করছেন জামালগঞ্জের হাওর পারের অগনিত কৃষক। কৃষিনির্ভর পরিবারগুলোর মাঝে এখন হাওরডুবির গভীর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। একটু ভারি বৃষ্টিপাত হলে যেকোন সময় বাঁধ ধসে হাওর তলিয়ে যাওয়ার ভয়ে তটস্থ হয়ে পড়ছেন হাওর পারের কৃষিজীবী মানুষেরা। সারা বছরের শ্রম-ঘাম ও অর্থ খরচায় আবাদকৃত জমি কৃষককে সোনালী স্বপ্ন দেখালেও সম্প্রতি পাহাড়ী ঢলে আগাম বন্যার আশঙ্কাসহ হাওর রক্ষা বাঁধ কাজে সংশ্লিষ্টদের গাফিলতি ও নানা অনিয়ম হাওর পারের মানুষকে গভীর চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। এ নিয়ে হাওর পারে নীরব অসন্তোষ ও চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
হাওরের এ দুর্যোগপূর্ণ মুহ‚র্তে গতকাল হাওর পরিদর্শনে এসেছেন সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. মোশাররফ হোসেন। তিনি হাওর রক্ষা বাঁধ কাজে উপজেলা প্রশাসনকে সহায়তা করার জন্য হাওরবাসীকে আহবান জানিয়েছেন। এ সময় তার সাথে ছিলেন সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেনসহ উপজেলা প্রশাসন ও পাউবো সংশ্লিষ্টরা।
হাওর পারের মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়, হাওরের পরিস্থিতি তেমন ভালো না। একদিকে পানি বাড়ার অশনি সংকেত, আরেকদিকে সময়মতো বাঁধের কাজ না করার কারণে বিপর্যয়ের সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠছে। বাঁধ টেকসইকরণে নিয়মতান্ত্রিক ঘাস লাগানোর কথা থাকলেও অনেক বাঁধে তা করা হয়নি। তাই বৃষ্টিপাতসহ নদীতে পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে বাঁধের দুর্বল অংশ ধসে মহাবিপদ ঘনিয়ে আসতে পারে।
এছাড়া বিপজ্জনক ক্লোজারগুলোতে সময়মতো বস্তা ও বাঁশ ফাইলিং না করায় বিপর্যয়ের ঝুঁকি অনেকটাই বেড়ে গেছে। উদ্বেগজনক এ পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তোড়জোড় হাওর রক্ষায় কতটা কার্যকরী ভূমিকা রাখবে তা নিয়ে আতঙ্কে আছে হাওরবাসী।
ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় অনেকে জানিয়েছেন, হাওরে বিপদ যখন তেড়ে আসে তখন সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা হাওর রক্ষার ডাক দিয়ে বাঁধে নামার আহবান জানায়। আর বাঁধের কাজে পিআইসি গঠনের সময় কেউ হাওর পারের কৃষকের মতামত কিংবা পরামর্শ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না। নিয়ম বহির্ভূতভাবে যাকে ইচ্ছে তাকেই প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া হয়। যাতে করে বাঁধের কাজে দীর্ঘ সময় ক্ষেপণের পাশাপাশি নানা অনিয়মের মাধ্যমে ফসল রক্ষার বদলে ফসলহানির পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয় হাওরকে। একপর্যায়ে হাওর ডুবির অদ্ভুত পরিস্থিতিতে পড়ে নির্মম নিয়তির কাছে মাথা টুকতে হয় কৃষকদের।
হাওর থেকে ফিরে উপজেলা হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অঞ্জন পুরকায়স্থ জানিয়েছেন, পাহাড়ী ঢলে নদীগুলো প্রায় ভরপুর, পানিও বাড়তির দিকে। সবকিছু মিলে পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। এই উদ্বেগের কারণ যদিও প্রকৃতি, তবে ফসল রক্ষা বাঁধ কাজে নানা অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও গাফিলতিই অনেক ক্ষেত্রে দায়ি। যেমন নির্ধারিত সময়ের পর অতিরিক্ত সময় নিয়েও বাঁধের কাজ পুরোদস্তুর শেষ করা যায়নি।
মাটির কাজ হয়েছে ঠিক কিন্তু কোন কোন বাঁধে দুর্বা লাগায়নি পিআইসির লোকেরা। এতে বৃষ্টি ও নদীর পানিতে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার উপক্রম পরিলক্ষিত হচ্ছে। এছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ ক্লোজারগুলোতেও বিপদের আলামত প্রায় পরিস্কার। এ মুহ‚র্তে যদি ভারি বৃষ্টিপাত হয় তাহলে হাওরে নিশ্চিত বিপর্যয় নেমে আসবে। তখন কৃষকের ভোগান্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছবে। এর দায়ভার অযোগ্য পিআইসিসহ দায়িত্বশীলদের নিতে নেবে?
খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, হালি হাওরের মামুদপুরের ভাঙ্গায় এখনও বস্তা ও বাঁশের আড় দেওয়া হয়নি। ঘনিয়ার কাড়ার বিপদ এড়াতে বস্তা পাতা হয়েছে। তবে তা শঙ্কামুক্ত মনে হয় না। এর বিপরীত তীরে শনি হাওরের নান্টুখালি ক্লোজারেও বস্তা ফেলা হচ্ছে। মহালিয়া হাওরের হিজলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী বাঁধ এলাকা অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ। পাগনা হাওরের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বৌগলাখালি ক্লোজারে সাম্প্রতিক বৃষ্টিতে ফাটল দেখা দিলে পরে তা তড়িঘড়ি সংস্কার করা হয়।
এছাড়া হালি হাওরের কাজিরগাঁও ও সুন্দরপুর সংলগ্ন স্লুইচ গেইটের কপাট বন্ধ থাকলেও ফাঁকফোকর দিয়ে হাওরে দ্রুত গতিতে পানি প্রবেশ করছে। সবকিছু মিলে অরক্ষিত অবস্থায় আছে হালি, শনি, মহালিয়া ও পাগনা হাওর। বর্তমানে তড়িঘড়ি ব্যবস্থা গ্রহণের যে তোড়জোড় দেখা যাচ্ছে তা সময়মতো করলে হয়তো কৃষকের মাঝে বাড়তি আতঙ্ক দেখা দিত না বলে জানিয়েছেন হাওর সচেতন মানুষেরা।
গতকাল সকালে সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঝুঁকিপূর্ণ ঘনিয়ার কাড়া ভাঙ্গায় বস্তা ফেলা হয়েছে। তার উপরে ঢেউ খেলছে নদীর উপচে ওঠা পানি। অপর পারের নান্টুখালি ক্লোজারের সুরঙ্গপথে দেদারছে পানি প্রবেশ করছে। সেখানে মাটিভর্তি বস্তা ফেলে সুরঙ্গ বন্ধের চেষ্টা করা হচ্ছে। কার্পেট ও বাঁশ এনে মজুদ রাখা হয়েছে নান্টুখালি বাঁধের পারে। এছাড়াও বদরপুর-বেহেলী বাজারের মাঝখানের কসমা হাওরের একটি অংশের সুরঙ্গপথে পানি প্রবেশের খবর পাওয়া গেছে। বিপর্যয়ের এ কথাগুলো সংবাদ ভাষ্যে বারবার তুলে ধরলেও আমলে নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এখন পানি আসায় ঝুঁকিপূর্ণ ক্লোজারগুলোতে ব্যাপক তোড়জোড় লক্ষ্য করা গেছে।
বেহেলী ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্যা ও রাধানগর গ্রামের বাসিন্দা হাফসা বেগম বলেন, হাওরের অবস্থা বেশি ভালো না। প্রায় প্রতিটা বাঁধেই ঝুঁকি আছে। গত তিনদিন ধরে আমি নান্টুখালি বাঁধে আছি। বাঁধের সুরঙ্গ একদিকে বন্ধ করলে আরেকদিকে বন্ধ হয় না। এইমাত্র একটা বন্ধ করা হয়েছে অন্যদিকের চারটি সুরঙ্গে ফের পানি ঢুকছে। এগুলো কেন আগে করা হয়নি এমন প্রশ্ন আমি করেছি তাদেরকে। কিন্তু তারা আগ থেকে কাজ করা হচ্ছে বলে আমাকে বোঝ দিয়েছেন।
জানা যায়, হালি, শনি, মহালিয়া, পাগনা, মিনি পাগনা ও জোয়ালভাঙ্গাসহ ৬টি হাওরে এ বছর ৩৬টি পিআইসির অনুক‚লে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫ কোটি ২২ লাখ টাকা। পরবর্তীতে হাওরকে বিপদমুক্ত করতে বরাদ্দ আরও কিছু বাড়ানো হয়েছে। চলতি বছরে ফসল রক্ষা বাঁধ কাজ হয়েছে ১৮৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৪৮ কিলোমিটার নতুন বাঁধ ও ১৩৭ কিলোমিটার পুরাতন বাঁধে কাজ করেছে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি। যদি বাঁধ ভেঙ্গে যায় তাহলে তলিয়ে যাবে উপজেলার ছোট-বড় ৬টি হাওরের ২৪ হাজার ৩৮০ হেক্টর আবাদকৃত বোরো জমি।
পানি আসার পর বাঁধে যে তোড়জোড় সেই কাজটা আগে করা হল না কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ইকবাল আল আজাদ সিলেট মিররকে বলেন, আমি একজন কৃষক এবং কৃষকেরই সন্তান। তাই কৃষকের কষ্ট আমি অনুভব করতে পারি। বাঁধের কাজটা সম্পূর্ণভাবে পানি উন্নয়ন বোর্ড করে থাকে। তাদের পরিকল্পনায় গলদ আছে, অনিয়ম আছে। হাওর রক্ষা বাঁধ কাজে সুপরিকল্পনা দরকার। নইলে প্রতি বছরই কৃষককে এভাবে চিন্তিত থাকতে হবে।
এ ব্যাপারে প্রকল্প বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ্বজিত দেব বলেন, এখনও হাওরে আছি, গতকালও (সোমবার) ছিলাম। হাওরের পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত ভালোই আছে। বিশেষ করে কাকড়ার গর্ত, ইঁদুরের গর্ত দিয়ে পানি প্রবেশ করছে। এইটা আমাদের কাছে রিস্ক মনে হচ্ছে। এগুলো আটকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। আর ঘনিয়ার কাড়া আশঙ্কামুক্ত। সমস্যাটা এখন শনির হাওরে। মামুদপুরের ভাঙায় বস্তা-বাঁশ দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যদি না করে তাহলে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।
আরএম-০৯