পাউবোর বিলম্ব বিলে বেকায়দায় পিআইসি

বিশ্বজিত রায়, হাওর থেকে ফিরে


মে ১০, ২০২২
০৮:১৬ অপরাহ্ন


আপডেট : মে ১০, ২০২২
০৮:১৮ অপরাহ্ন



পাউবোর বিলম্ব বিলে বেকায়দায় পিআইসি
বাঁধের কাজে কৃষকের অনাগ্রহ, গেল অর্থবছরের পাওনা গত জানুয়ারিতে পরিশোধ

হালি হাওর পাড়ের ১২ নম্বর পিআইসির বাঁধ এটি। এ বাঁধের কাজ প্রায় নির্ধারিত সময়েই শেষ হয়েছে। ছবিটি গত ২ মার্চ তোলা।

জামালগঞ্জে হাওররক্ষা বাঁধের কাজ নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। ২০১৭ সালের হাওর বিপর্যয়ের পর অদ্যাবধি বাঁধের কাজ নিয়ে নানা অভিযোগ অহরহ উঠছে। প্রতিবছর সরকার কৃষকের কথা চিন্তা করে বাঁধ রক্ষা কাজে অকৃপণ অর্থ ছাড় দিয়ে এলেও পিআইসি বন্টনে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে হাওর। এ জন্য জনপ্রতিনিধি, উপজেলা পাউবো ও প্রশাসনের দিকে অভিযোগের তির উঠছে। কিন্তু অভিযোগের বিষয়টিতে ভিন্নমত পোষণ করছেন পাউবো ও প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা। হাওর থেকে ফিরে দৈনিক সিলেট মিরর-এর জামালগঞ্জ প্রতিনিধি বিশ্বজিত রায়ের পাঁচ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন। 

কৃষকের ফসল রক্ষায় প্রতি বছরের মতো এ বছরও হাওর এলাকায় নতুন-পুরাতন বাঁধ, ক্লোজার নির্মাণ ও মেরামত করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তত্ত্বাবধানে সংশ্লিষ্ট উপজেলা কাবিটা স্কিম প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটি কর্তৃক গঠিত প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) এ কাজ করে আসছে। এতে সরকার প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। কিন্তু বছরের পর বছর ফসলরক্ষা বাঁধের কাজে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ পর্যাপ্ত অর্থ ছাড় দিলেও বাঁধের কাজ সম্পন্নে মানা হয় না কোনো নিয়ম-নীতি। নির্ধারিত সময় পেরিয়ে বর্ধিত সময়েও শেষ হয় না বাঁধের কাজ। যে কারণে এ বছর অসময়ের পানিতে অনেক হাওর তলিয়ে স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে কৃষকের। এর জন্য অনিয়ম-দুর্নীতির পাশাপাশি পাউবোর বিলম্ব অর্থ ছাড় ও তাদের গড়িমসি অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করছেন হাওর সচেতন মানুষ ও পিআইসি সংশ্লিষ্টরা।

পিআইসি ও কৃষক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাওররক্ষা বাঁধ কাজে পদে পদে অনিয়ম আছে। সবকিছুর পর পাউবোর বিলম্বিত বিল পরিশোধের ব্যাপারটি বাঁধের কাজ এগিয়ে নিতে অন্যতম অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে। পাউবো সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় অর্থ ছাড় না দেওয়ায় পিআইসিসহ হাওর পাড়ের কৃষকেরা মনোবল হারিয়ে বাঁধের কাজে অনাগ্রহী হয়ে উঠছেন। অসচ্ছল পিআইসিদের কেউ কেউ প্রশাসনের অতিরিক্ত চাপে ধারদেনা করে বাঁধের কাজ কোনোরকম এগিয়ে নিলেও সেই কাজে ঢের দূর্বলতা থেকে যাচ্ছে। ফলে পানি আসার সাথে সাথে নড়বড়ে বাঁধ আরও দুর্বল হয়ে কৃষকের সর্বনাশ ডেকে আনছে।

অভিযোগ রয়েছে, উপজেলা পাউবো ও স্থানীয় প্রশাসন সম্পূর্ণ অনিয়মতান্ত্রিকভাবে অযোগ্য, অদক্ষ ও অকৃষকের হাতে পিআইসির দায়িত্ব তুলে দিয়ে নিজেদের আখের ঘুচানোর চেষ্টা করে থাকে। সংশোধিত নীতিমালায় জারিকৃত বাঁধের কাজ হাওর পাড়ের কৃষকের হাত থেকে পূর্বের ঠিকাদারি প্রথায় ফিরিয়ে নিতে কলকাঠি নাড়া হচ্ছে বলে মনে করছেন সচেতন মহল। তবে এ অভিযোগ মানতে নারাজ পাউবো সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, ২০১৭ সালের আলোচিত হাওর বিপর্যয়ের পর কৃষকের স্বার্থে ঠিকাদারি প্রথা বাতিল করে পিআইসি প্রথা চালু করে সরকার। হাওরপাড়ের উপকারভোগী অর্থাৎ স্থানীয় কৃষক দ্বারা প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠনের মাধ্যমে সরকার হাওরকে দুর্নীতিমুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সে নীতিমালায় ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শুরু এবং ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কাজ শেষ করার কথা বলা আছে। কিন্তু কৃষকের ফসল রক্ষার স্বার্থে সরকার বাঁধ রক্ষা কাজের নীতিমালা পরিবর্তন করলেও কাজ চলে সেই পুরোনো আদলে। এতে করে সরকারের কৃষকবান্ধব এ নীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পাঁয়তারা চলছে বলে মনে করছেন কৃষক ও কৃষক নেতারা।

পাউবো সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জের ১১টি উপজেলার ছোট-বড় হাওর রয়েছে অন্তত ১৩৭টি। এর মধ্যে ৪২টি হাওরে প্রায় ১২১ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭২৭টি পিআইসির মাধ্যমে ৫৩৫ কিলোমিটার বাঁধ, ক্লোজার নির্মাণ ও মেরামত করা হয়েছে। জামালগঞ্জে এ বছর ছোট-বড় ৬টি হাওরে ১৮৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ৯০ কি.মি বাঁধে জরিপ চালিয়ে ৪৪.৮৬৫ কিলোমিটার বাঁধের কাজ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৩টি ক্লোজার আছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে উপজেলার ৪০টি পিআইসির প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এ পর্যন্ত ৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা পিআইসির অনুক‚লে ছাড় দেওয়া হয়েছে। এখনও বাকি আছে প্রায় ৫০ ভাগেরও বেশি বিল। ২০২০-২১ অর্থবছরে পিআইসিদের পাওনা বিলের ১ কোটি ৪৯ লাখ টাকা চলতি বছরের জানুয়ারিতে পরিশোধ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে উপজেলা পাউবো কার্যালয়।

বেহেলী ইউনিয়নের মহালিয়া হাওর পাড়ের কৃষক ও ৮ নম্বর পিআইসি সভাপতি চন্দন বর্মন বলেন, ‘আমার পিআইসির বরাদ্দ ১২ লক্ষ ৩৮ হাজার টেকা। এখন পর্যন্ত পাইছি ৪ লাখ ৩৪ হাজার। বাকি টেকা আমি ঋণ কইরা আনছি। আমার কাজের টোটাল ব্যয় আছে ৮ লাখ টেকার উপরে। ৪ লাখ ৭২ হাজার টেকা সুদি কইরা আনছি। এখন বিল দিতে গিয়া যদি লেইট হয় তখন তো আমার একমাত্র পরিস্থিতি মরণই, এ ছাড়া তো কোনো উপায় নাই। বিলের ব্যাপারে আমি স্যাররে ফোন দিছিলাম, স্যারে বলতাছে যে আমরা হিসাব-কিতাব করতাছি ঈদের পরপর দেওয়া হইব।’

চন্দন বর্মনের মতো বেকায়দায় অধিকাংশ পিআইসি। প্রায় প্রতি বছরই বন্যা, খরা, শিলাবৃষ্টিসহ প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগে হাওর পাড়ের কৃষক এমনিতেই ক্ষতিগ্রস্ত। এর মাঝে ঋণের টাকায় হাওররক্ষা বাঁধের কাজ করে যদি সময়মতো বিল না পাওয়া যায় তাহলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কৃষক, এমন প্রশ্ন রাখের কৃষক নেতারা। পাউবোর বিল ছাড়ে গাফিলতি ও অব্যবস্থাপনা ফসল রক্ষার বিপরীতে কৃষককে সর্বস্বান্ত করার পাঁয়তারা বলে মনে করছেন তারা।

কেন্দ্রীয় হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, পাউবো মূলত পিআইসি প্রথা চায় না। এ ছাড়া বাঁধের কাজে প্রশাসনের সম্পৃক্ততাও তারা মেনে নিতে পারছে না। এতে তাদের সমস্যা হচ্ছে। আমি মনে করি পিআইসিকে সময়মতো টাকা না দেওয়ায় বাঁধের কাজ খামখেয়ালিভাবে হয়, দুর্বল হয়। বাঁধের কাজে যদি ঠিকমতো বিল দেওয়া হতো তাহলে বাঁধের কাজও সঠিকভাবে হতো। মূলত কৃষককে পাশ কাটিয়ে বাঁধের কাজ পূর্বের অবস্থানে ফিরিয়ে নিতে পাউবো এ রকম করছে।

এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, বাঁধের কাজে বিলের বিলম্ব কোনো বিষয় না। যখন টাকা আসছে তখনই তো আমরা দিয়ে দিচ্ছি। কাজের প্রাক্কলনের ভিত্তিতে কাজ যতটুকু করবে সে ততটুকু বিল পাবে। এটা পিআইসিদের গাফিলতি, এটা টাকার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা আমার দৃষ্টিকোণ থেকে কম। আর বিল দিলেও পিআইসিরা এভাবেই কাজ করবে।

পাউবো আসলে চাচ্ছে না বাঁধের কাজ কৃষক করুক, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এতে পাউবো চাওয়া না চাওয়ার কিছু নাই। গভমেন্টের নীতিমালার আলোকে কাজ হচ্ছে। পাউবো গভমেন্টের বাইরের তো কোনো সংস্থা না। সরকার যেভাবে চাইবে পাউবো সেভাবেই কাজ করবে। এ নিয়ে অভিযোগ হাস্যকর।

বিএ-০১