অনিয়ম দুর্নীতিতে ডুবছে জামালগঞ্জের হাওর

বিশ্বজিত রায়, হাওর থেকে ফিরে


মে ১২, ২০২২
০৭:০৩ অপরাহ্ন


আপডেট : মে ১২, ২০২২
০৭:১৩ অপরাহ্ন



অনিয়ম দুর্নীতিতে ডুবছে জামালগঞ্জের হাওর
মধ্যস্বত্বভোগীদের দখলে ফসলরক্ষা বাঁধ

বাঁধ ভেঙ্গে হাওর তলিয়ে গেলে ডুবো পানিতে ধান কাটছে কৃষক। ছবিটি এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে হালি হাওর পাড়ের মদনাকান্দি এলাকা থেকে তোলা।

জামালগঞ্জে হাওররক্ষা বাঁধের কাজ নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। ২০১৭ সালের হাওর বিপর্যয়ের পর অদ্যাবধি বাঁধের কাজ নিয়ে নানা অভিযোগ অহরহ উঠছে। প্রতি বছর সরকার কৃষকের কথা চিন্তা করে বাঁধ রক্ষা কাজে অকৃপণ অর্থ ছাড় দিয়ে এলেও পিআইসি বন্টনে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে হাওর। এ জন্য জনপ্রতিনিধি, উপজেলা পাউবো ও প্রশাসনের দিকে অভিযোগের তির উঠছে। কিন্তু অভিযোগের বিষয়টিতে ভিন্নমত পোষণ করছেন পাউবো ও প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা।

কৃষক, হাওর সচেতন মানুষ, পিআইসি ও পিআইসির অন্তরালের লোকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাওররক্ষা বাঁধ কাজের গোড়াতেই গলদ রয়ে গেছে। নিয়ম বহির্ভুতভাবে পিআইসি গঠন করে বাঁধের কাজে সুযোগ দেওয়া হয় তথাকথিত সুযোগসন্ধানী লোকদের। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নামকাওয়াস্তে কৃষকের নাম যুক্ত করে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠন করলেও মূলত এ কাজের নেতৃত্ব দেয় একশ্রেণির রাজনীতিক, জনপ্রতিনিধি ও মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়াবাজ চক্র। সাধারণ কৃষককে অল্প টাকার লোভ দেখিয়ে চুক্তি করে এবং কৃষকের স্বাক্ষরে টাকা তুলে হাতিয়ে নেওয়া হয় সেই টাকা। পরে মধ্যস্বত্বভোগী ও পিআইসির লোকের মধ্যে টানাপোড়েন দেখা দিলে বাঁধের কাজ আর সঠিকভাবে এগোয় না। পাউবো ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের যোগসাজশে এমনটা হচ্ছে বলে মনে করছেন স্থানীয় কৃষক ও কৃষকনেতারা।

পাউবো সূত্রে জানা গেছে, জামালগঞ্জের ৬টি হাওরে ১৮৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ৪৪.৮৬৫ কিলোমিটার বাঁধের কাজ হয়েছে। এর মধ্যে ১৩টি ক্লোজার আছে। এ বছরে ৪০টি পিআইসির অনুক‚লে বরাদ্দ এসেছে ৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এর মধ্যে শনির হাওরে ৪টি, হালি হাওরে ১৪টি, জুয়ালভাঙ্গা হাওরে ১টি, মিনি পাগনায় ১টি, পাগনা হাওরে ১২টি পিআইসি ও এ হাওরের ৪টি লম্বা বাঁধসহ ৪০ পিআইসিতে এ বরাদ্দ এসেছে। এ পর্যন্ত তিন কিস্তিতে ৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা পিআইসিদের দেওয়া হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মহালিয়ার ৭ ও ৮ নম্বর পিআইসি ছিল তুফাজ্জুল নামের এক ব্যক্তির অধীনে। পিআইসিদের স্বাক্ষরে প্রথম কিস্তির টাকা তুলে তুফাজ্জুল পকেটস্থ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বাঁধের কাজ এগিয়ে নিতে পিআইসিদের কোনো টাকা দেননি তিনি। ফলে পিআইসি দুটির কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি। বর্ধিত সময়েও কাজ নিয়মতান্ত্রিক শেষ না হওয়ায় মহালিয়া হাওর শেষমেষ ঝুঁকিতে পড়েছে বলে অভিযোগ অনেকের। গত ২ মার্চ এ প্রতিবেদক সরজমিনে গিয়ে বাঁধের কাজে পিআইসিদের দেখা না পেলেও তুফাজ্জুলকে পাওয়া যায় মাটির কাজ তদারকি করতে। এমনকি তার দুই পিআইসি অফিসে গিয়ে দেখা করবে বলে এ প্রতিবেদককে পক্ষে আনার চেষ্টা করেছে তুফাজ্জুল। কে এই তুফাজ্জুল, কিংবা কার বলে সে দুই পিআইসির কাজ ভাগিয়ে নিয়েছেন সেটা জানতে চেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকে।

এদিকে, ২৫ মার্চ রাতে হালি হাওরের আছানপুর গ্রামসংলগ্ন ১৭ নম্বর পিআইসির বাঁধ ভেঙ্গে হাওর তলিয়ে গেলে পরদিন বাঁধে গিয়ে পিআইসি সভাপতি মুহিবুর রহমানকে পাননি গণমাধ্যমকর্মীরা। শুধু ওইদিনই নয়, কাজের নির্ধারিত সময়ের আগে ও পরে কখনও তাকে বাঁধে পাওয়া যায়নি। এমনকি নির্দেশিকা বোর্ডটি যত্রতত্র ফেলে রেখে কাজের প্রতি চ‚ড়ান্ত অবহেলার পরিচয় দিয়েছেন এই পিআইসি। মূলত তার অবহেলার কারণে আছানপুর এই বাঁধটি ভেঙ্গেছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। কোনো অদৃশ্য বলে ওই পিআইসি বছরের পর বছর কাজের দায়িত্ব পায় সেটা নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন আছানপুর গ্রামের কেউ কেউ।

বেহেলী ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য ও আছানপুর গ্রামের বাসিন্দা ইউসুফ মিয়া বলেন, ‘ভাঙ্গনকৃত ১৭ নম্বর বাঁধের এই জায়গায় সপ্তাহখানেক ধরে একটা ফুলপা ছিল। ধীরে ধীরে সেটা বড় হয়েছে। ফুলপা বন্ধ করতে পিআইসিসহ সকলকে জানানোর পরও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এই ১৭ নম্বর প্রজেক্টটা আরেকজনে পাইছিল। পরে হুনলাম মুহিবুর-এ পাইছে। সে আওয়ামী লীগ করে, এমপির আত্মীয় লাগে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মহালিয়ার এক পিআইসি সদস্য বলেন, ‘আমরার কাজডা মূলত তুফাজ্জুলের। ৭ আর ৮ নম্বর পিআইসি দুয়াডাই হের। আমরা পিআইসি এমনে দিয়া পাই না। তখন হে আমরারে কন্টাক করছে যে, তোমরারে ৬০ হাজার টাকা দিয়াম আর কাজডা আমরা করবাম। আমরা নাম দিছি। প্রথম কিস্তির ২ লাখ ৩৮ হাজার টাকা তুলা হইছিল। এর মধ্যে ১০ হাজার টাকা আমরারে খরচের দিছিল। পুরা টেকাডা হে (তুফাজ্জুল) নিয়া গেছে। পরে আর তারে পাইছি না, গাড়ির টেকাও দিছে না। পরে ইউএনও স্যার, এসও স্যার আমরারে ফোন দেয়। এখন কাজডা তো উডাইতে হইব। পরে কি করবাম, এইখান থাইক্যা, হেইখান থাইক্যা টেকা আইন্যা কাজডা করছি।’

উপজেলা হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অঞ্জন পুরকায়স্থ বলেন, ২০১৭ সালের কাবিটা নীতিমালা বহির্ভূত অদৃশ্য সুপারিশে পিআইসি বরাদ্দ দেওয়া হয়। এক হাওর পাড়ের মানুষকে অন্য হাওর পাড়ে এনে পিআইসি বানানো হয় এবং রাজনৈতিক পরিচয়ের ব্যক্তিরা পিআইসি সেজে কিছু কিছু বাঁধে অতিরিক্ত বরাদ্দ ভাগিয়ে আনে। বাঁধে মাটি কমপেকশনসহ নির্ধারিত দূরত্ব বজায় রেখে মাটি আনা হচ্ছে কিনা পাউবোর সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী সে বিষয়গুলো এড়িয়ে চলে। যে কারণে সদ্য মাটি ফেলা সরু বাঁধগুলোতে কাঁকড়া ও ইঁদুর গর্ত করতে সুবিধা পায়। এতে বাঁধগুলো দুর্বল হয় এবং বাঁধ ভেঙ্গে কৃষকের সর্বনাশের কারণ হয়।

এ নিয়ে গণমাধ্যমকর্মী শামস শামীম বলেন, কৃষক তার বাঁধ রক্ষা করবে, এর চেয়ে সুন্দর পদ্ধতি আর হতে পারে না। কিন্তু এটাকে কলঙ্কিত করা হচ্ছে। এর জন্য প্রথমে দায়ী আমাদের জনপ্রতিনিধিরা। তাদের লোক না হলে পিআইসি হয় না। প্রশাসনও এর বাইরে গিয়ে কিছু করতে পারে না। বাঁধের টাকা মধ্যস্বত্বভোগী, রাজনীতিক, আমলাসহ সাংবাদিকদের পকেটেও যাচ্ছে। আসলে বাঁধের কাজটা মধ্যস্বত্বভোগীর কাছে চলে গেছে। এতে কৃষকের অংশগ্রহণ নেই। যে বেশি টাকা দেয় ইউএনও-এসও মিলে তাকেই পিআইসি দিয়ে দেয়। আর যারা ভালো কাজ করার অভিজ্ঞতা রাখে তাদেরকে পিআইসি দেওয়া হয় না। দিলেও তাদের বরাদ্দ দেওয়া হয় কম, নানাভাবে হয়রানিও করা হয়।

কেন্দ্রীয় হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, বাঁধের কাজে পিআইসি গঠনের শুরুটাই অনিয়মের মাধ্যমে হয়। গণশুনানীর মাধ্যমে পিআইসি গঠনের কথা। কিন্তু তারা এক টেবিলে বসে গণশুনানী করে। এ থেকে শুরু করে সর্বাগ্রেই অনিয়ম হচ্ছে।

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, পিআইসি গঠনের ক্ষেত্রে যারা পিআইসি পায় তারা ঠিক আছে। আর যারা পায় না তারাই অনিয়মের অভিযোগ করে। কাজ যথাযথভাবে হয়েছে বলেই সুনামগঞ্জের মানুষ ফসল ঘরে তুলতে পেরেছে।

অনিয়ম-দুর্নীতির ব্যাপারে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ড ও উপজেলা থেকে বাঁধের কাজ তো প্রকৃত কৃষককেই দেওয়া হয়। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে কৃষক অন্য কারও দ্বারস্থ হয়। তাহলে সে দোষ তো কৃষকের, অন্য কারও নয়। এরপরও আমরা আরও যাচাই-বাছাই করব, যে কৃষকের কাজ করার মতো সক্ষমতা আছে তাদেরকে বাঁধের কাজ দেওয়া হবে।’

বিএ-০২