‘কান্দা’ কাটার খেসারত হাওরের জীববৈচিত্র্যে

বিশ্বজিত রায়, হাওর থেকে ফিরে


মে ১৩, ২০২২
০৭:২৪ অপরাহ্ন


আপডেট : মে ১৩, ২০২২
০৭:২৪ অপরাহ্ন



‘কান্দা’ কাটার খেসারত হাওরের জীববৈচিত্র্যে
ধ্বংস হচ্ছে গোচারণ ভূমি ও হিজল-করচের বাগ

অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণে এভাবে কান্দা কেটে তছনছ করা হচ্ছে হাওর পাড়। ছবিটি এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে মহালিয়া হাওর পাড় থেকে তোলা।

হাওর-বাওড় ও হাওরাঞ্চলের বিল-বাদাড়ের তির ছুঁয়ে চলা উঁচু ভ‚মির নাম কান্দা। সে কান্দাই গোচারণ ভ‚মি, কৃষকের ফসল তোলার নিরাপদ খলা। আবার কখনও হিজল-করচ আকড়ে জেগে থাকা অবারিত মাঠ। সুস্থ পরিবেশ ও প্রতিবেশের জন্য শক্তিশালী প্রাকৃতিক ঢাল। জীববৈচিত্র্যের অন্যতম আধার।

বছরের পর বছর এ কান্দা কেটে অপরিকল্পিত ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করতে গিয়ে হাওরকে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে হুমকির কারণ করে তোলা হচ্ছে। প্রকৃতি ও পরিবেশবিধ্বংসী এসকেভেটর দিয়ে কান্দার মাটি কেটে পুরো হাওরের বিপদ ডেকে আনা হচ্ছে। এতে একদিকে অপরিকল্পিত বাঁধ তৈরির মাধ্যমে হাওররক্ষা পেলেও গোচারণ ভ‚মি বিনষ্টের পাশাপাশি হিজল-করচের বাগ ধ্বংস করে গোটা হাওরকে হুমকির মধ্যে ফেলে দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করছেন হাওর সচেতন মানুষেরা।

হাওর নিয়ে কাজ করেন এমন লোক ও স্থানীয় কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশের প্রধান খাদ্যশস্যের ভান্ডার ও নানা জাতের জলজ উদ্ভিদ, প্রাণীসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও মাছের অভয়াশ্রম হচ্ছে হাওর। এক সময় এ হাওর বিভিন্ন ধরনের জলজ উদ্ভিদ ও হিজল-করচে ভরপুর ছিল। সেগুলো ছিল প্রাণী ও পক্ষী প্রজাতির অন্যতম আশ্রয়স্থল। কিন্তু দিন দিন প্রাকৃতিক এ অভয়াশ্রম প্রায় ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত এ হাওর ঘিরেই হাওরাঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা আবর্তিত হয়। শুষ্ক মৌসুমে কৃষকেরা যখন এ হাওরকে শস্যাদিতে পূর্ণ করার অক্লান্ত চাষাবাদে মত্ত হয় তখন হাওর পাড়ের হিজল-করচের কান্দা তাদেরকে এক ধরনের প্রশান্তি এনে দেয়।

কৃষকের গরু-বাছুরের খাদ্যের সংস্থানের পাশাপাশি দেশীয় ও পরিযায়ী পাখি এবং সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীর নিরাপদ আভাসস্থল হচ্ছে হাওর পাড়ের হিজল-করচে সমৃদ্ধ এই উঁচু ভ‚মি। সবকিছু মিলে হাওর পাড়ের কান্দা বাস্তুসংস্থান ও জীববৈচিত্র্যের এক অপার সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে কান্দা কেটে সেই মূল্যবান ক্ষেত্রটিকে ধ্বংস করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন হাওর উন্নয়ন ও পরিবেশবিদরা। এভাবে কান্দা না কেটে হাওরের ফসল রক্ষায় শীঘ্রই পরিকল্পিত ও বিকল্প পদ্ধতি অবলম্বনের দাবি জানিয়েছেন তারা।

পাউবো সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জের ১১টি উপজেলার ছোট-বড় অন্তত ১৩৭টি হাওরের মধ্যে ৪২টি হাওর পাড়ে ৫৩৫ কিলোমিটার বাঁধ, ক্লোজার নির্মাণ ও মেরামত করা হয়েছে। এর মধ্যে জামালগঞ্জের ৬টি হাওরে ১৮৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার বাঁধের কাজ হয়েছে। এসব বাঁধ এসকেভেটর দিয়ে কান্দার মাটি কেটে নির্মাণ করছে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি। অনেক সময় কান্দার উপর মাটি ফেলে বাঁধের কাজ এগিয়ে নেওয়া হয়েছে। এভাবে অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণের কারণে ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে হাওরের জীববৈচিত্র্য।

পরিবেশ ও হাওড় উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা বলেন, বাঁধ রক্ষায় যে কান্দাগুলো কাটা হচ্ছে সেগুলো হাওরের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করে থাকে। এই কান্দাগুলো দীর্ঘদিনের। প্রকৃতিগতভাবেই এগুলোর সৃষ্টি হয়েছে। এভাবে কান্দা কেটে বাঁধ নির্মাণ মানে হাওরের অপমৃত্যু ঘটানোর সামিল। কান্দা কেটে বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে ঠিক, কিন্তু হাওরে দীর্ঘ ক্ষতের সৃষ্টি করা হচ্ছে। তাই কান্দা ধ্বংস না করে বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে বিকল্প কিছু করার দাবি জানাই।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বনবিদ্যা ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, হাওরের কান্দা কাটলে উদ্ভিদ ও প্রাণী দুটিতেই মারাত্মক প্রভাব পড়বে। হাওরে বিশেষ কিছু সরীসৃপ ও পাখি আছে যেগুলো একই সঙ্গে বিলে এবং কান্দায় বিচরণ করে। সেগুলো মাছ খেতে বিলে গেলেও একসময় এসে কান্দার মাঝে কোনো একটা নির্জন জায়গা কিংবা কান্দার গাছে এসে বসে। সেই যে বিচরণ ক্ষেত্র, কান্দা কাটার মাধ্যমে সেগুলো বিনষ্ট করা হচ্ছে।

তিনি আরও জানিয়েছেন, হিজল-করচ মূলত কান্দাতেই জন্মায়। হিজল-করচ এখন আর হাওরে নেই বললেই চলে। কিছু কিছু জায়গায় সামান্য আছে। এর মধ্যে যদি কান্দা কেটে ফেলা হয় তাহলে এক সময় হিজল-করচ পাওয়াই যাবে না। কান্দা কাটলে সেগুলো ধ্বংস হবে। এ ছাড়া কান্দা কাটা হলে এখানকার যে বাস্তুসংস্থান সেটা নিশ্চিতভাবেই নষ্ট হয়ে যাবে। গোচারণভ‚মিটুকুও অবশিষ্ট থাকবে না। জীববৈচিত্র্যের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। তাই এ থেকে বেরিয়ে আসা দরকার।

এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘আগামী বছর থেকে বাঁধের জন্য আর কান্দা কাটতে দেওয়া হবে না। বাঁধ টেকসই করতে যেখান থেকে পারা যায় সেখান থেকেই মাটি আনতে হবে। আমরা হাওরের পাশ থেকে আর মাটি কাটতে দেব না।’

বিএ-০১