জামালগঞ্জে দুই ইউপি নির্বাচন, বিদ্রোহী স্বতন্ত্রে কোণঠাসা নৌকা

বিশ্বজিত রায়, জামালগঞ্জ


জুন ০৫, ২০২২
০৭:১৭ অপরাহ্ন


আপডেট : জুন ০৫, ২০২২
০৭:১৭ অপরাহ্ন



জামালগঞ্জে দুই ইউপি নির্বাচন, বিদ্রোহী স্বতন্ত্রে কোণঠাসা নৌকা
প্রার্থীদের নানা প্রতিশ্রুতি, বোঝে-শুনে ভোট দেবেন ভোটাররা


জামালগঞ্জে আগামী ১৫ জুনের দুই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে চেয়ারম্যান ও সদস্য পদপ্রার্থীদের বিরামহীন প্রচার-প্রচারণা শুরু হয়েছে। পোস্টার-ব্যানারে ছেয়ে গেছে নির্বাচনী এলাকা। বৃষ্টিবিঘ্নি দিনেও প্রার্থীরা মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। চলছে গণসংযোগ ও উঠান বৈঠক। নানা প্রতিশ্রুতিতে ভোটারদের মন জয় করারও চেষ্টা করছেন প্রার্থীরা।

সুরমা নদীর উত্তর ও দক্ষিণ পারে বিস্মৃত জামালগঞ্জ সদর ও উত্তর দুই ইউনিয়নই উপজেলা সদর এবং সাচনা বাজারকেন্দ্রিক হওয়ায় সর্বদা আলোচনামুখর থাকছে সেখানকার চা-স্টল, হোটেল-রেস্তোরাঁ ও দোকানপাটসহ সব জায়গা। পুরো উপজেলার নজর এখন এ দুই ইউনিয়নের দিকে। এতে আওয়ামী লীগ মনোনীত দুই চেয়ারম্যান প্রার্থী এম নবী হোসেন ও জামিল আহমেদ জুয়েলের নাম ঘুরেফিরে সামনে চলে আসলেও ভোট বৈতরণী পার হওয়ার ক্ষেত্রে তাদেরকে নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভ্রু-কুঁচকানো ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত জামালগঞ্জ সদরে বিদ্রোহী ও উত্তরে স্বতন্ত্র প্রার্থীর বেড়াজাল টপকে এ দুই প্রার্থীর বের হয়ে আসাটা বেশ কঠিন বলে মনে করছেন ভোটার সচেতন মানুষেরা।

সাধারণ মানুষের মতামত বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৬ নম্বর জামালগঞ্জ উত্তর ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থীর চেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই অনেক এগিয়ে রয়েছেন। এর মাঝে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন আনারস প্রতীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা তরুণ চেয়ারম্যান প্রার্থী সৈকত ঘোষ চৌধুরী ও ‘পাকিস্তানীর ভাই’ খ্যাত ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থী মো. হানিফ মিয়া। এছাড়া জামালগঞ্জ সদর ইউনিয়নের সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান চশমা প্রতীকের প্রার্থী মো. শহীদুল ইসলামও চায়ের কাপে উষ্ণতা ছড়িয়ে যাচ্ছেন। তবে এ আলোচনায় নৌকা প্রার্থী এম নবী হোসেন অনেক দিক থেকেই পিছিয়ে রয়েছেন। শেষ পর্যন্ত মো. হানিফ মিয়া, মো. শহীদুল ইসলাম ও সৈকত ঘোষ চৌধুরীর মাঝে ত্রিমুখী লড়াইয়ের জোর সম্ভাবনা দেখছেন ভোটাররা। এ ৩ জনের মাঝে যে কেউ বিজয়ী হতে পারেন, এমন ধারণ এলাকাবাসীর।

অন্যদিকে, ২ নম্বর জামালগঞ্জ সদর ইউনিয়নে নৌকা প্রার্থী জামিল আহমেদ জুয়েলের প্রধান বাধা হিসেবে বিদ্রোহী প্রার্থী মো. কামাল হোসেন প্রতিযোগিতার প্রায় অগ্রভাগে রয়েছেন। জামিল আহমেদ জুয়েলকে টেক্কা দিয়ে সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছেন উপজেলা কৃষক লীগে সদ্য পদায়িত সহ সভাপতি চশমা প্রার্থী মো. কামাল। এলাকায় ‘ঢাকাইয়া কামাল’ হিসেবে পরিচিত অর্থবিত্তে শক্তিশালী আওয়ামী অঙ্গ সংগঠনের পদধারী এ নেতা নৌকার ভোট বিভক্ত করে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীকে চরম ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছেন, এমন অভিমত অনেকের। এ ঝুঁকি নিরসনে বিদ্রোহী কামালকে নির্বাচন থেকে বিরত রাখতে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে উপজেলা আওয়ামী লীগ ও কৃষক লীগ।

এছাড়াও সদর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান সাজ্জাদ মাহমুদ তালুকদার বৃহৎ একটা অংশের ভোটব্যাংক নিয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও তাঁর নিকটাত্মীয় সাবেক চেয়ারম্যান ফয়জুল আলম মোহন প্রার্থী হওয়ায় এক্ষেত্রে কিছুটা বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে নৌকা প্রার্থী জামিল আহমেদ জুয়েল, আনারস প্রতীকের প্রার্থী সাজ্জাদ মাহমুদ তালুকদার ও চশমা প্রার্থী মো. কামালের মাঝে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে উঠার আভাস পাওয়া গেছে। শেষ পর্যন্ত নৌকা প্রার্থী নেতাকর্মীদের নিয়ে প্রচার-প্রচারণায় তৎপর হলে ভালো কিছু হতে পারে বলে ধারণা অনেকের।

নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, ১৫ জুন জামালগঞ্জ সদর ইউনিয়নের ১০টি কেন্দ্রে ২০ হাজার ৬৯৩ জন ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। এর মধ্যে পুরুষ ১০ হাজার ৩৯৮ ও নারী ভোটার ১০ হাজার ৩০৪ জন রয়েছেন। অন্যদিকে জামালগঞ্জ উত্তর ইউনিয়নের ভোটার সংখ্যা ১৬ হাজার ৮৯৬ জন। ওই ইউনিয়নের ১১টি ভোট কেন্দ্রে ৮ হাজার ৫৮৯ জন পুরুষ ও ৮ হাজার ৩০৭ জন নারী ভোটার ভোট দিতে যাবেন।

জামালগঞ্জ সদর ইউনিয়নে ৭ জন চেয়ারম্যান প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। এদের মধ্যে উপজেলা আ.লীগের সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক জামিল আহমেদ জুয়েল নৌকা, ফারুক আহমেদ মোটর সাইকেল, মো. ওয়াসিম চৌধুরী ঘোড়া, উপজেলা কৃষক লীগের সহ সভাপতি মো. কামাল চশমা, মো. নাজিম উদ্দিন টেবিল ফ্যান, মো. ফয়জুল আলম মোহন অটোরিক্সা ও মো. সাজ্জাদ মাহমুদ তালুকদার আনারস মার্কায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

জামালগঞ্জ উত্তর ইউনিয়নে চেয়ারম্যান প্রার্থী রয়েছেন ৬ জন। এর মধ্যে উপজেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক এম নবী হোসেন নৌকা, বর্তমান চেয়ারম্যান মো. রজব আলী মোটরসাইকেল, সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. শহীদুল ইসলাম চশমা, তরুণ সমাজকর্মী সৈকত ঘোষ চৌধুরী আনারস, হানিফ মিয়া ঘোড়া ও ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মো. ইকবাল হোসাইন হাতপাখা মার্কা নিয়ে নির্বাচনী মাঠে অংশ নিয়েছেন বলে জানা গেছে।

জামালগঞ্জ সদর ইউনিয়নের চাঁনপুর গ্রামের ভোটার মো. হায়দার আলী বলেন, এ ইউনিয়নে নৌকা প্রার্থী এখনও অনেকটা পিছিয়ে আছে। এর অন্যতম কারণ কর্মী সঙ্কট। আ.লীগ নেতাকর্মীরা এখনও সেভাবে মাঠে নামেনি। প্রচার-প্রচারণায় অনেক দুর্বলতা রয়ে গেছে। সেদিক থেকে চশমা প্রার্থী কামাল ও বর্তমান চেয়ারম্যান সাজীব এখন পর্যন্ত এগিয়ে আছেন। সম্ভবত এ দু’জনের মধ্যেই মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে উঠবে। তবে নৌকার প্রার্থী যদি কর্মী-সমর্থক নিয়ে সেভাবে মাঠে নামতে পারে তাহলে সম্ভাবনা আছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উত্তরের ভোটার ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনে সম্পৃক্ত এমন একজন জানিয়েছেন, নৌকা প্রার্থীর তেমন কোন সম্ভাবনা নেই। এখানে পাকিস্তানীর ভাই হানিফ মিয়া ও শহীদুল ইসলাম এগিয়ে আছে। আর আনারস মার্কার সৈকতের অবস্থানও খুব ভালো। তার ভোটগুলো নীরব। শেষ পর্যন্ত হানিফ, শহীদুল ও সৈকতের মধ্যে লড়াই হবে। তবে সব শেষে নৌকার ভোট কিছুটা বাড়তে পারে।

জামালগঞ্জ উত্তর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থী মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, যেদিকে যাচ্ছি সেদিকে ভোটাররা আমাকে ভোট দেবেন বলে আশ্বস্ত করছেন। আমার বিশ্বাস আমি নির্বাচনে জয়ী হতে পারব। কথা দিচ্ছি জয়ী হলে অবহেলিত এ ইউনিয়নকে মডেল ইউনিয়ন হিসেবে গড়ে তুলব।

জামালগঞ্জ সদর ইউনিয়নের নৌকা প্রার্থী জামিল আহমেদ জুয়েল বলেন, আমার বিশ্বাস উন্নয়ন ও পরিবর্তনের স্বার্থে জনগণ আমাকে নির্বাচিত করবে। উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করতে নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়ে সহযোগিতা করার জন্য আমি ভোটারদের প্রতি অনুরোধ জানাই।

ইভিএমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এমনটা জানিয়ে উপজেলা নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তা আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, নির্বাচনী পরিবেশ শান্তিপূর্ণ আছে। এখন পর্যন্ত আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ কেউ করেনি। সার্বিক পরিস্থিতিও ভালো রয়েছে। দুই ইউনিয়নে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র তেমন নেই। তবে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি কেন্দ্র আমাদের টার্গেটে আছে। আমরা সতর্ক অবস্থানে আছি।

প্রসঙ্গত, গত ৫ জানুয়ারি জামালগঞ্জের ৬ ইউনিয়নের মাঝে ৪ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হলেও জামালগঞ্জ সদর ও জামালগঞ্জ উত্তরের নির্বাচন হয়নি। ২০১৭ সালে জামালগঞ্জ সদর ইউনিয়ন ভেঙ্গে সদর ও উত্তর ইউনিয়ন পৃথক হওয়ায় এ দুই ইউনিয়নের নির্বাচন দেরিতে হয়েছিল। ফলে ৫ জানুয়ারি সদর ও উত্তর ইউনিয়নের মেয়াদ পূর্ণ না হওয়ায় তা পিছিয়ে আগামী ১৫ জুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।