রাজনীতিকরা বিজ্ঞান মানেন না!

সিলেট মিরর ডেস্ক


নভেম্বর ২৯, ২০২৩
১২:৩২ অপরাহ্ন


আপডেট : নভেম্বর ২৯, ২০২৩
১২:৩২ অপরাহ্ন



রাজনীতিকরা বিজ্ঞান মানেন না!

যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞরা বলছেন রাজনীতিকরা বিজ্ঞান মানতে চান না। করোনা মহামারীর সময়ের কিছু ঘটনা উল্লেখ করেন তারা। বিভিন্ন সূত্র থেকে তুলে ধরা হলো সিলেট মিররের পাঠকদের জন্য।

করোনা নামে এক ভয়াবহ মহামারী এখনো তাজা বিশ্ববাসীর মনে। অজস্র মৃত্যু, আক্রান্ত হওয়া, সোশ্যাল ডিসট্যান্স তৈরি করতে গিয়ে একেবারে নিঃসঙ্গ হয়ে যাওয়ার সেসব ঘটনাও খুবই সাম্প্রতিক। শোক-তাপের ভিড়ে কিছু ঘটনা হয়তো মনে নেই অনেকের।

যেমন যুক্তরাজ্যের তখনকার প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের কথা। করোনা মহামারী চলাকালীন বিধিনিষেধ ভেঙে বিতর্কিত হয়েছিলেন তিনি। তার সেসব কর্মকাণ্ড বিবেচনায় নিয়ে যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, রাজনীতিকরা বিজ্ঞান মানেন না।

তদন্ত

যুক্তরাজ্যের সরকারি উদ্যোগেই একটি প্রকল্প পরিচালিত হচ্ছে। দেশটির কয়েকজন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার কাছ থেকে মন্তব্য নিয়েছে প্রকল্পের জন্য গঠিত কমিটি। তারা করোনা মহামারী মোকাবিলায় যুক্তরাজ্য কতটা প্রস্তুত ছিল সে বিষয়ে তদন্ত চালাবে। তাদের এ তদন্ত শুরু হয়েছে ২০২২ সালে, চলবে ২০২৬ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত।

চলতি সপ্তাহে ওই কমিটি দেশটির প্রধান সরকারি বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা, স্বাস্থ্য কর্মকর্তাসহ কয়েকজন বিশেষজ্ঞের সাক্ষ্য নেয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, করোনা চলাকালীন বরিস জনসনকে কিছুতেই  বোঝানো যাচ্ছিল না পরিস্থিতির কথা। তবে এটা শুধু যুক্তরাজ্যের সমস্যা নয়, বরং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশেও রাজনীতিকদের মধ্যে এ সমস্যা দেখা গেছে। তারা কিছুতে গ্রাফ বুঝতে চান না। তাদের ভাষ্য, বেশির ভাগ রাজনীতিবিদ সৎ হলেও বিজ্ঞান জানার বিষয়ে তারা উদাস এবং বিশেষজ্ঞদেরও বুঝতে চান না। রাজনীতিকদের প্রমাণের ভিত্তিতে সঠিক পরামর্শ দেওয়ার দায়িত্ব বিজ্ঞানীদের ওপর বর্তায়।

তারা বলছেন, মহামারীর মতো ঘটনায় পরিস্থিতির দ্রুত বদল ঘটতে পারে, যা বুঝতে গেলে বিজ্ঞানের প্রয়োজন। তবে সাধারণ মানুষ, রাজনীতিক আর কিছু কিছু বিজ্ঞানীও বিজ্ঞান বুঝতে চান না। তাদের পক্ষ থেকে এ পরামর্শও এসেছে যে, বিজ্ঞানীদের মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া উচিত।

করোনার সময়ে

তবে শুধু বরিস জনসন নন, করোনা মহামারীর সময় বিশে^র অন্যান্য কিছু দেশের নেতারাও অবৈজ্ঞানিক কথা বলেছেন বা মন্তব্য করেছেন।

বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে জানা যায়, প্রথম যেদিন যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর জানা গেল, তার দুদিন পর ২২ জানুয়ারি তখনকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সিএনবিসিকে একটি সাক্ষাৎকার দেন।

তাতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে কভিড সংক্রমণকে খুব একটা গুরুত্ব দেননি। যদিও এর দুমাস পর সেখানকার পরিস্থিতি আমূল বদলে যায়। যুক্তরাষ্ট্রেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়। মহামারীর প্রথম কয়েক সপ্তাহে শুধু নিউ ইয়র্ক সিটিতে তিন হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। পরে ট্রাম্প নিজেই বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা আড়াই লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে।

মহামারীর ওই সময়ে সবচেয়ে আলোচিত ছিলেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জায়ের বোলসোনারো। তিনি করোনা নিয়ে বিতর্কিত অনেক মন্তব্য করেন। ব্রাজিলে কভিড সংক্রমণ দেখা দেওয়ার পর থেকে বোলসোনারোর জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করে।

প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো যে শুধু এই মহামারীকে খাটো করে দেখিয়েছেন তা নয়, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কিছু নির্দেশনাও তিনি বারবার ভঙ্গ করেছেন। বিভিন্ন রাজ্যের গভর্নরদের ঘোষিত লকডাউনেরও তিনি বিরোধিতা করেছেন। শেষ পর্যন্ত ব্রাজিলে মহামারী করোনার হানায় সাত লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়।

তারপর আছেন ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতের্তে। তার বিজ্ঞান বোঝার ঘটনা আবার উল্টো। তিনি কর্র্তৃত্ববাদী শাসক। করোনাভাইরাসের হুমকিকে কাজে লাগিয়ে তিনি দেশটিতে কঠোর সব বিধিনিষেধ আরোপ করেছেন। তিনি এমনকি লকডাউন ছাড়াও কারফিউ জারি করেছেন। তখন খাদ্য ঘাটতির প্রতিবাদে একবার রাস্তায় বিক্ষোভও হয়। সেই বিক্ষোভে গুলি চালানোর হুমকি দেন দুতের্তে।

করোনায় করমর্দন, কোলাকুলির বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলেছিলেন। সেসবকে থোড়াই কেয়ার করেন বরিস জনসন। করোনা চলাকালে তিনি হাস্যরসেরও জন্ম দেন। যুক্তরাজ্যে কভিড সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার পরেও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বলেন, তিনি লোকজনের সঙ্গে করমর্দন করার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন নন। তার প্রধান বক্তব্য ছিল, ভাইরাসটি প্রতিরোধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে হাত ধোয়া।

এরপর বরিস জনসনের শরীরে করোনাভাইরাস পাওয়া যায়। তাকে হাসপাতালেও ভর্তি করা হয়।

করোনা মহামারীর ব্যাপারে বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো যে মনোভাব দেখিয়েছেন তাতে অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তার দেশেও করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হলে তিনি তা উড়িয়ে দিয়ে বলেন, তিনি তো এই ভাইরাসকে কোথাও উড়তে দেখছেন না।

একটি আইস হকি ম্যাচের সময় একজন টিভি সাংবাদিকের কাছে তিনি এই মন্তব্য করেন। ম্যাচ দেখতে সেখানে দর্শক ভিড় করলেও তার কোনো আপত্তি ছিল না। তার বক্তব্য ছিল, ইনডোর স্টেডিয়ামের ভেতরে যে ঠাণ্ডা পরিবেশ করোনাভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধ করবে। করোনাভাইরাসের ভীতিকে তিনি ‘মানসিক বৈকল্য’ বলেও উল্লেখ করেছেন।

ভাইরাসটি ঠেকানোর জন্য তিনি লোকজনকে ভোদকা পান করতে পরামর্শ দেন। অবশ্য পরে তিনি বলেছেন, ‘কৌতুক’ হিসেবে এসব মন্তব্য করেছিলেন।

মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেস মানুয়েল লোপেজ ওব্রাদোর করোনা মোকাবিলায় তার দেশের স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের দেওয়া উপদেশের বিরোধিতা করেন। একই সঙ্গে এই ভাইরাসের যে বিপদ সেটাও তিনি খাটো করে দেখান। মহামারীর সময়ে সারা দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তাকে জনসমাগমে যোগ দিতে দেখা গেছে, দেখা গেছে শিশুদের চুম্বন করতে এবং সমর্থকদের ভিড়ে মিশে গিয়ে তাদের শুভেচ্ছা জানাতে।

ইরাকে প্রভাবশালী শিয়া নেতা মুক্তাদা আল-সদর যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী দেশগুলোতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিযুক্ত করেন। ভাইরাসটির বিস্তার রোধে ইরাকে যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয় সেগুলো ভঙ্গ করেন তিনি।

এ ছাড়া করোনা ছড়িয়ে পড়ার জন্য তিনি ‘সমকামী বিবাহ আইনকে’ দায়ী করেছেন। তবে যেসব দেশ সবচেয়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেই ইতালি ও স্পেনে এ ধরনের বিয়েকে বৈধতা দিয়ে কোনো আইন তৈরি হয়নি।

তিনি এক টুইটে লিখেছেন, ‘যেসব কারণে এই মহামারী ছড়িয়ে পড়েছে, তার একটি হচ্ছে সমকামীদের মধ্যে বিবাহের আইন। সব সরকারের প্রতি আমি আহ্বান জানাচ্ছি এখনই অবিলম্বে যেন এই আইন বিলুপ্ত করা হয়। এই অনুতপ্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা দোষ থেকে মুক্তি পাব।’

ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো তার দেশে করোনা সংক্রমণের তথ্য গোপন করেন। তিনি বলেছিলেন, লোকজন যাতে পাগলের মতো কেনাকাটা করতে শুরু না করে দেয় সে জন্যই এই তথ্য গোপন করা হয়েছে।

করোনা চলাকালে যুক্তরাষ্ট্রে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, দেশটির রিপালিকান দলের নেতারা টিকা নিতে অনীহা প্রকাশ করছেন। ওই জরিপে দেখা গেছে, রিপাবলিকানদের মাত্র ২৮ শতাংশ দ্রুত করোনার টিকা নেওয়ার পরিকল্পনায় ছিলেন। আর ৭১ শতাংশ বলেন, তারা অন্যদের কী হয় তা দেখার জন্য অপেক্ষা করবেন। দেশটির ডেমোক্র্যাট দলের সদস্যদের ৪০ শতাংশও টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে অনীহা প্রকাশ করেন। পরে আরেকটি জরিপে জানা গেছে, ৪২ শতাংশ রিপাবলিকান বলেন, তারা কখনো ভ্যাকসিন নিতে চান না।

বাস্তবতা

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনীতিবিদরা স্মার্ট, কৌশলী মানুষ। তবে তারা বৈজ্ঞানিক পরামর্শের বিষয়ে যথেষ্ট সতর্ক নন। তারা হয় একে কিছুটা ভয় পায় বা তারা উপেক্ষা করে।

তাদের মতে, রাজনীতিকরা কিছু বৈজ্ঞানিক পরামর্শ নিঃসন্দেহে গ্রহণ করেন। কিন্তু পরে বিস্তৃত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সেসব পরামর্শ সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করতে হয় তাদের। যে কারণে তাদের পরামর্শ, আমাদের একটি মাঝামাঝি অবস্থা দরকার যেখানে রাজনীতিবিদরা সব বিষয়ে বিবেচনা নিয়ে সিদ্ধান্তে আসতে পারেন।

নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী স্যার রিচার্ড জন রবার্টস এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি অনেক রাজনীতিবিদ বিজ্ঞান বুঝতে চান না। তারা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কারণকে বেশি গুরুত্ব দেন। রাজনীতিবিদরা বিজ্ঞান বুঝতে চান না, বিজ্ঞান যে সত্য বলে তা তারা পছন্দ করেন না। বৈজ্ঞানিক তথ্য সত্যনির্ভর, তাদের বিশ্বাস করুন বা না করুন, তা সত্য। রাজনীতিবিদদের বিজ্ঞান সম্পর্কে জানা উচিত। বিজ্ঞানীদের কথা শুনে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। আমি নিশ্চিত আপনার কাছে একটি মোবাইল ফোন আছে। মোবাইল ফোন কোথা থেকে এসেছে? কী কারণে মোবাইল ফোন সম্ভব হয়েছে? এর পেছনে ছিল বিজ্ঞান। কোনো রাজনীতিবিদ কি বলছিলেন আমাদের সেলফোন বানাতে হবে? মোবাইল তৈরি হয়েছে কারণ বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবনের উপায় আবিষ্কার করেছিলেন।’

রাজনীতিবিদদের বিজ্ঞান বুঝতে কেন সমস্যা হয় তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা আছে পশ্চিমা বিশ্বে। তারা এ সংকট কাটিয়ে উঠতে পরামর্শও দিয়েছেন। তবে এশিয়া বা আফ্রিকার দেশগুলোতে এ প্রবণতা আরও বেশি। এখানে বিষয়টি নিয়ে আলোচনাও হয় কম। রাজনীতিবিদরা এখানে বিজ্ঞান বোঝার চেয়ে প্রযুক্তির নানামুখী ব্যবহারের বিষয়ে বেশি উৎসাহী। যার পেছনে অন্যতম কারণ থাকে নির্বাচনী চমক দেওয়া। এসব প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার নিয়ে তাদের হয়তো ধারণা থাকে না। অথবা ধারণা থাকলেও ভোট পাওয়ার প্রয়োজনে তারা সেসব উপেক্ষা করেন।

বিজ্ঞান বিষয়ে রাজনীতবিদদের জানা-বোঝা

থাকলে জনগণের জন্যই তা মঙ্গলজনক হতে পারে। পরিবেশও ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায়। যেমন বাংলাদেশে বন ও নদী বিপুল ক্ষতির মুখে পড়েছে। রাজনীতিবিদরা যদি বিজ্ঞান মানতেন তাহলে এ বিপর্যয় থেকে আমরা রক্ষা পেতাম। একই কথা বলা যায় বিশ্বনেতাদের ক্ষেত্রেও। পুঁজির পেছনে ছুটতে গিয়ে তারা জলবায়ু বিপর্যয় ডেকে এনেছেন।

আরসি-০৪