সুনামগঞ্জে ধান কাটার শ্রমিক নিয়ে শঙ্কা

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি


এপ্রিল ০৯, ২০২০
১১:১৮ অপরাহ্ন


আপডেট : এপ্রিল ০৯, ২০২০
১১:১৮ অপরাহ্ন



সুনামগঞ্জে ধান কাটার শ্রমিক নিয়ে শঙ্কা

সুনামগঞ্জের হাওরের বোরো ধানে এখন ‘বাউরি বাতাস’ খেলছে। সবুজের খোলস ভেঙ্গে হাল্কা হলুদাভ হয়ে ওঠছে বিস্তৃত ধানখেত। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ধানের ফলনও হয়েছে ভালো। সরকারের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন পয়লা বৈশাখ থেকেই ধানকাটার ধুম পড়বে হাওর জেলা সুনামগঞ্জে। কিন্তু করোনার এই সংক্রমণের সময়ে বাইরের ও স্থানীয় শ্রমিকদের ধানকাটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে প্রশাসন ও কৃষক। তাছাড়া হাওরের উঁচু এলাকার (ইরি প্রকৃতির) জমির ধান কাটতে যে মেশিন সরকার ৭৫-৫০ ভাগ ভর্তুকিতে বরাদ্দ দিয়েছিল তাও অধিকাংশই নষ্ট। এ নিয়ে উৎকণ্ঠা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

কৃষি বিভাগ স্থানীয় উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছে ধানকাটা শ্রমিকদের দলনেতাদের তালিকা তৈরি করে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মাঠে নামানোর উদ্যোগের। পানি উন্নয়ন বোর্ড এপ্রিল মাসে বন্যা ও কালবৈশাখির দিকে ইঙ্গিত দিয়ে আগামী সপ্তাহ থেকে দ্রুত ধান কাটার আহ্বান জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে করোনা আশঙ্কার কারণে বোরো ধান কাটা নিয়ে নতুন করে শঙ্কা দেখা দিয়েছে হাওরে।

এদিকে, কৃষি বিভাগ ও কৃষকরা জানিয়েছেন, এখন শ্রমিক পাওয়া দুষ্কর হবে। তাই হাওরের ধানকাটার জন্য শ্রমিকদের বিশেষ প্রণোদনা ঘোষণা করলে শ্রমিকরা ধানকাটার মজুরির পাশাপাশি প্রণোদনা পেয়ে ধান কাটতে হাওরে যাবেন। অন্যদিকে সরকারি ভর্তুকির ধানকাটার অর্ধেক যন্ত্র বিকল হয়ে পড়ে আছে বলে জানা গেছে। ধানকাটা শুরুর আগে যন্ত্রগুলো সচল করা হলে কৃষকরা সহজে ধান কাটতে সক্ষম হতেন বলে মনে করেন তারা।

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে সুনামগঞ্জ জেলায় এ বছর ২ লাখ ১৯ হাজার ৪০০ হেক্টর বোরো লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে অর্জিত হয়েছে ২ লাখ ১৯ হাজার ৩০০ হেক্টর। বিআর ২৮, ২৯ সহ হ্ইাব্রীড, উফশীসহ কিছু স্থানীয় জাতের ধানও আবাদ হয়েছে। এবার হাওরের ফসলরক্ষার জন্য ৬৪০ কি.মি ফসলরক্ষা বাধ নির্মাণ, সংস্কার করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। সরকার প্রাথমিক ৬৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও পানি উন্নয়ন বোর্ড ১৩২ কোটি টাকার মোট বাজেট চেয়েছে। 

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, হাওরের কাজ শেষ হয়ে গেছে। ধানও পাকতে শুরু করেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের মতে এপ্রিলেই বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। ধান কাটা ও ফসল উত্তোলন নিয়ে গত ২ এপ্রিল সভা হয়েছে। পাউবো পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মহোদয়কে বিষয়টি অবগত করেছে। গত ৪ এপ্রিল এপ্রিল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে দ্রুত ধান কাটার আহ্বান জানিয়ে একটি পত্র দিয়েছে পাউবো। 

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, একসময় বৃহত্তর সিলেটের বাইরের অন্যান্য জেলা থেকে হাওরাঞ্চলে ধান কাটতে আসতেন শ্রমিকরা। গত দুই দশক ধরে তারা আসছেন না। তাই এই সময় হাওরে শ্রমিক সংকট দেখা দেয়। এবার করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে সিলেটের বিভিন্ন এলাকা থেকে যেসব শ্রমিকরা আসতেন তারাও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে না আসতে পারেন। অথচ আগামী ১৪ এপ্রিল হাওরের ধান কাটার উপযুক্ত সময়ের শুরু। তাই স্থানীয় শ্রমিকদের দিকেই নজর দিচ্ছে কৃষি বিভাগ। ইতোমধ্যে কৃষিবিভাগের মাঠ পর্যায়ে কর্মরত কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের ধানকাটার স্থানীয় শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে তাদেরকে ধানকাটায় উদ্বুদ্ধ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে শ্রমিক সংগ্রহের আহ্বান জানানো হয়েছে। 

কৃষি বিভাগ আরও জানিয়েছে, জেলায় সরকারি ভর্তুকি ও অনুদানে ১৩১টি কম্বাইন্ হার্ভেস্টর ও ২৮৫টি রিপার ধানকাটা ও মাড়াইয়ের যন্ত্র রয়েছে। এছাড়াও সম্প্রতি আরও ৩৩টি কম্বাইন হার্ভেস্টর ১৭টি রিপার বরাদ্দ পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ধানকাটা মেশিন দিয়ে হাওরের উঁচু অংশের কিছু জমির ধান কাটা সম্ভব। তবে এই মেশিনের মধ্যে ৪১টি কম্বাইন হার্ভেস্টর ও ৯২টি রিপার মেশিন নষ্ট আছে। এগুলো সচল থাকলে হাওরের ধানকাটায় কিছুটা সুবিধা পেতেন কৃষকরা।

হাওর আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কৃষকরা জানিয়েছেন, যে মেশিন কৃষকদের ভর্তুকি দিয়ে দেওয়া হয়েছে তা হাওরের জমির ধান কাটার জন্য উপযুক্ত নয়। এগুলো আমন বা উচু শ্রেণির জমির মধ্যে ব্যবহার করা যায়। হাওরের কৃষকরা নিচু জমিতে ধানকাটার যন্ত্র উদ্ভাবনের দাবি জানিয়ে আসছেন বহুদিন ধরে। তবে এ বছর সবকিছু ছাপিয়ে এই ধান কাটার মওসুমে শ্রমিক নিয়েই শঙ্কিত কৃষকরা। শ্রমিকদের প্রণোদনা দিয়ে মাঠে না পাঠানো হলে এবার হাওরের ধান কাটা কঠিন হবে বলে মনে করছেন তারা। 

খরচার হাওরপাড়ের কৃষক হানিফ আলী বলেন, হাওরের বোরো ধান এবার ভালো হয়েছে। এক সপ্তাহের মধ্যেই কাটা শুরু হবে। কিন্তু এবার শ্রমিকের খুব সংকট হবে। স্থানীয় যারা আছেন তারাও ধান কাটতে আগ্রহী নন। ধান কাটতে না পারলে আমাদের অবস্থা কাহিল হয়ে যাবে। এমনিতেই গত বছর ধানের দাম না পেয়ে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

দেখার হাওরের হালুয়ারগাও গ্রামের কৃষক রইছ মিয়া বলেন, ‘এখন আওরো ধান রইয়া পোষায়না। তারবাদেও বাপদাদার শিকানো কৃষিকাজ করি। ইবার আওরের ধান কিলা খাটমু আল্লায় জানে। করোনার লাগি ইবার বাইরের কামলা আইতোনা। আমরার এলাকার কামলারাও ধান কাটতে চাইতোনা।’

হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু বলেন, হাওরে গত দুই দশক ধরে ধানকাটার মওসুমে শ্রমিক সংকট প্রকট হয়েছে। করোনার সময়ে এবার স্থানীয় শ্রমিকরাই ভরসা। তাই সরকার বর্তমানে করোনা প্রনোদনা হিসেবে যে শ্রমিকদের তালিকা করছে তাতে হাওরাঞ্চলের জন্য ধানকাটা শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্ত করলে প্রনোদনা ও ধানকাটা মজুরি লাভের আশায় অনেক শ্রমিক ধান কাটতে আগ্রহী হতেন। আমরা সরকারকে এ বিষয়ে অনুরোধ জানাই। 

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ সফর উদ্দিন বলেন, আমি প্রতিদিনই হাওর ঘুরছি। ধান পাকতে শুরু করেছে। আগামী ১৪ এপ্রিল থেকে পুরোদমে ধানকাটা শুরু হবে। হাওরের কৃষকরা জানিয়েছেন এবার ধানকাটা শ্রমিকের সংকট হবে। তাই আমরা মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের স্থানীয় ধানকাটা শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের প্রতিটি দলকে ধানকাটতে উদ্বুদ্ধ করছি। প্রতিটি উপজেলায় এ ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া আমাদের সচল হার্ভেস্টর যন্ত্রগুলো দিয়েও হাওরের ওপরের অংশের জমির ধান দ্রুত কাটার নির্দেশনা দিয়েছি।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন, করোনার কারণে সারাদেশের মানুষই এবার আতঙ্কিত। এই অবস্থায় হাওরের ধানকাটায় প্রভাব পড়তে পারে। আমরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালককসহ স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাওরে ধান কাটায় পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছি।

পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মানান্ন বলেন, এবছর হাওরে ভালো ফলন হয়েছে। হাওরের মানুষ শ্রমঘামে ফলানো ফসল কাটতে উন্মুখ হয়ে আছে। কিন্তু মহামারি করোনা আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে এখন। এই অবস্থায় বাইরের শ্রমিকদের হাওরে ধান কাটায় আসতে পরিবহন চলাচলে যে বাধা আছে তা শিথিল করা উচিত। পাকা ধান কেটে গোলায় তুলতে না পারলে কৃষকের আফসোস থামবে না।

এনপি-০৪/বিএ-০৫