লাউয়াছড়ায় ফিরেছে প্রাণ, নির্ভয়ে ঘুরছে বন্যপ্রাণীরা

সজীব দেবরায়, কমলগঞ্জ


এপ্রিল ১৫, ২০২০
১০:০০ অপরাহ্ন


আপডেট : এপ্রিল ১৫, ২০২০
১০:০০ অপরাহ্ন



লাউয়াছড়ায় ফিরেছে প্রাণ, নির্ভয়ে ঘুরছে বন্যপ্রাণীরা

অপরূপ সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত জীববৈচিত্র্যে ভরপুর লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। পর্যটন ক্ষেত্রে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। এই বনের পরিচিতি শুধু দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত একটি পর্যটন কেন্দ্র। জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে সুন্দরবনের পরেই লাউয়াছড়ার অবস্থান। এটি কেবল পর্যটন কেন্দ্রই নয়, এ উদ্যান এক জীবন্ত প্রাকৃতিক গবেষণাগার। 

গেল কয়েকদিন আগেও হাজারও পর্যটকের আগমনে তাদের ব্যবহৃত যানবাহন ও হৈ হুল্লোড়ে কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান হারিয়ে ফেলেছিল তার শান্ত নিবিড় পরিবেশ। মানুষজনের অবাধ বিচরণে এ বনের প্রাণীরা অনেকটাই গা ঢাকা দিয়েছিল। সাম্প্রতিক করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারি নির্দেশনায় সারাদেশের মতো লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে পর্যটক প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়া হয়। পর্যটকশূন্য লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান এখন তার আগের শান্ত নিবিড় পরিবেশে ফিরে পেয়েছে। ফলে মনের আনন্দে বন্যপ্রাণীরা এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে উদ্যানের ভেতরের সমতলে ও গাছ থেকে গাছে।

বাংলাদেশের ৭টি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও ১০টি জাতীয় উদ্যানের মধ্যে লাউয়াছড়া অন্যতম। চিরহরিৎ এ বনাঞ্চল বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকের নিরাপদ আবাসস্থল। এছাড়াও নানা ধরণের দুর্লভ প্রাণী, কীটপতঙ্গ আর গাছপালার জন্য এ অরণ্য বিখ্যাত। লাউয়াছড়া উদ্যানের পুরোনো নাম ছিল পশ্চিম ভানুগাছ সংরক্ষিত বনাঞ্চল। মৌলভীবাজার রেঞ্জের আওতাধীন কমলগঞ্জ উপজেলার প্রায় ২ হাজার ৭শ ৪০ হেক্টর এলাকা নিয়ে বিস্তৃত ছিল পশ্চিম ভানুগাছ সংরক্ষিত বনাঞ্চল। বনের অস্তিত্ব ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার পাশাপাশি ভ্রমণ ও জনসচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশে সংরক্ষিত এই বনের প্রায় ১ হাজার ২শ ৫০ হেক্টর এলাকাকে ১৯৭৪ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ, সংশোধন) আইন অনুযায়ী ১৯৯৬ সালের ৭ জুলাই জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই বনে রয়েছে ৪৬০ প্রজাতির দুর্লভ বন্যপ্রাণী ও গাছপালা। এর মধ্যে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪ প্রজাতির উভচর, ৬ প্রজাতির সরিসৃপ, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী ও ২৪৬ প্রজাতির পাখি। 

এ উদ্যানকে দেখাশোনা ও ব্যবস্থাপনার জন্য জাতীয় উদ্যান সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়েছিল। আর জাতীয় উদ্যান ব্যবস্থাপনার মূল দায়িত্বে প্রথমে ছিল নিসর্গ, দ্বিতীয় পর্যায়ে ছিল আইপ্যাক, এখন রয়েছে ইউএসএআইডি। মূলত এসব সংস্থা লাউয়াছড়ায় পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে চাওয়ায় পরবর্তীতে এ উদ্যান থেকে বাণিজ্যিক আয়ের চিন্তায় প্রবেশমূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। তারপর লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে পর্যটকদের আগমন বেড়ে যায়। পর্যটকদের পাশাপাশি এ উদ্যান শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সফরের ও বনভোজনকারীদের পছন্দের একটি স্থান। স্বাভাবিকভাবে এ উদ্যানে মানুষজনের উপস্থিতি ও তাদের সঙ্গে নিয়ে আসা সাউন্ড সিস্টেমের কারণে বনের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল। কোনোভাবেই তা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না। দূর-দূরান্ত থেকে আসা প্রকৃতিপ্রেমীরা একটু শান্ত নিবিড় বনের মাঝে বন্যপ্রাণী দেখার জন্য লাউয়াছড়া উদ্যানে আসতেন। তবে অস্বাভাবিক হারে পর্যটকদের আগমনে ও চিৎকারে বন্যপ্রাণী পর্যটকদের নাগালের বাইরে অবস্থান করত।

বর্তমানে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সরকারিভাবে নিষেধাজ্ঞা থাকায় লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান এখন পর্যটকশূন্য। আজ বুধবার (১৫ এপ্রিল) সকালে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে গেলে এ বনের বন্যপ্রাণীদের মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। বানরগুলো এক গাছ থেকে আরেক গাছে লাফিয়ে বেড়ায়। চশমা পরা বানর বসে থাকতে দেখা যায় বনের বাঁশ গাছে। আগে যেখানে মানুষজনের উপস্থিতিতে বন মোরগের দেখা মিলত না, সেখানে এখন সারাদিন বনের ভেতরে ঘুরে বেড়ায় বন মোরগ। বনের মধ্যে থাকা মায়া হরিণের দর্শন পাওয়া যেখানে দায় ছিল, সেখানে স্থানীয়রা এখন প্রায়ই মায়া হরিণের দেখা পাচ্ছেন। সকাল থেকে দুপুর অব্দি শোনা যাচ্ছে মহাবিপন্ন উল্লুকের আওয়াজ। এর সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির কিচিরমিচির শব্দ।

কমলগঞ্জ জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটির সভাপতি মনজুর আহমদ আজাদ মান্না বলেন, পর্যটকের হৈ-হুল্লোড়, গাড়ির হর্ণ ইত্যাদির কারণে লাউয়াছড়ার বণ্যপ্রাণীগুলো হাঁপিয়ে উঠেছিল। মানুষের উপস্থিতি, তাদের সঙ্গে নিয়ে আসা সাউন্ড সিস্টেম, গাড়ির হর্ণের কারণে বনের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল। যার ফলে বন্যপ্রাণী পর্যটকদের নাগালের বাইরে অবস্থান করত। সম্প্রতি করোনাভাইরাসের কারণে পর্যটকশূন্য হয়ে পড়েছে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। পর্যটকশূন্য লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান এখন তার হারানো পরিবেশ ফিরে পেয়েছে। মনের আনন্দে উদ্যানের ভেতরে বন্যপ্রাণীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। করোনা পরিস্থিতি শেষ হওয়ার পর প্রতিবছর নির্দিষ্ট কোনো মাসে এই উদ্যান বন্ধ রাখলে বনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে বলে মনে করি।

লাউয়াছড়া খাসিয়া পুঞ্জির বাসিন্দা সাজু মারছিয়াং বলেন, ১৯৯৬ সালের পর এই প্রথম এই উদ্যান বনের পরিবেশ ফিরে পেয়েছে। এখানে নেই মানুষজনের হৈ চৈ। বন যেন তার হারিয়ে যাওয়া পরিবেশ ফিরে পেয়েছে। আগের পরিবেশ পেয়ে এ বনের বন্যপ্রাণীরাও মহাখুশি। তারা আনন্দে নির্ভয়ে ছোটাছুটি করছে বনের ভেতরে।

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ মৌলভীবাজারের সহকারী বন সংরক্ষক আনিসুর রহমান বলেন, এ উদ্যানের জীববৈচিত্র্য এখন সঠিক অবস্থানে আছে। বনের প্রাণীগুলো এখন মহাআনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যানবাহন চলাচল ও রেল চলাচল বন্ধ থাকায় অবাধে বনে বন্যপ্রাণী বিচরণ করছে। নেই যানবাহনের আওয়াজ কিংবা কোনো গাড়ি ও ট্রেনে কাটা পরে প্রাণীর মৃত্যুর খবর। করোনাভাইরাস প্রতিরোধ শেষে দেশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরলে এ উদ্যানে পর্যটকদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নিয়ন্ত্রিতভাবে প্রবেশ করলে বনের পরিবেশ ও বন্যপ্রাণীর জন্য তা ভালো হবে।

লাউয়াছড়া বনবিট কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধের কারণে গত ১৯ মার্চ থেকে এ উদ্যানে পর্যটকদের প্রবেশ বন্ধ করা হয়েছে। এখন আসলেই বন বনের মতো আছে। একটি প্রবাদ আছে- বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। তেমনি পর্যটকশূন্য অবস্থায় লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে বন্যপ্রাণীরা মাতৃক্রোড়ে আছে।

 

এসডি/আরআর