কৃষকের কষ্টের ধানের টাকা যাচ্ছে মহাজনদের ঘরে

আবির হাসান-মানিক, তাহিরপুর (সুনামগঞ্জ)


মে ০২, ২০২০
০৭:১৫ অপরাহ্ন


আপডেট : মে ০২, ২০২০
০৭:৪৭ অপরাহ্ন



কৃষকের কষ্টের ধানের টাকা যাচ্ছে মহাজনদের ঘরে

হাওর অঞ্চল সুনামগঞ্জ তথা তাহিরপুরের অর্থনৈতিক অবস্থার অনেকাংশেই নির্ভর করে বোরো ফসলের উপর। এবার করোনা পরিস্থিতিতে শ্রমিক সংকট এবং আবহাওয়ার বৈরি হয়ে উঠার শঙ্কা থাকায় এবার ফসল যথাসময়ে ঘরে তোলা নিয়ে এক ধরণের শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে শেষপর্যন্ত ধান কাটা গেলেও প্রান্তিক কৃষকের গোলা তা উঠবে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। কারণ মহাজনদের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে ফসল ফলানোর কারণে এখন সরকারী রেটের অর্ধেকেরও কম দামে ধান তুলে দিতে হচ্ছে তাদের হাতে। এতে কৃষকের হাড়ভাঙা খাটুনির ফসলে ভবে উঠবে মহাজনদের গোলা।

তাহিরপুরে ছোটবড় প্রায় ২৩টি হাওরেই এ বছর বোরো ধানের বাম্পার ফলন হওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন এ অঞ্চলের মানুষ। করোনা পরিস্থিতিতে শুরুতে ধারণা করা হয়েছিল শ্রমিক সংকট দেখা দেবে। তাছাড়া ঘূর্ণিঝড়সহ ভারী বর্ষণের পূর্বাভাসও ছিল। কিন্তু আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ততটা প্রভাব পড়েনি তাতে। তাছাড়া সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক এ বছর ধান কাটায় ছাত্র, শিক্ষক থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লোকজনের অংশগ্রহণছিল স্বতঃষ্ফুর্ত । 

ইতোমধ্যেই হাওরের প্রায় ৬৫ থেকে ৭০ ভাগ ধান কাটা শেষ হয়েছে, এখন পুরোদমে চলছে ধান মাড়াই এবং খলাগুলোতে ধান শুকানোর কাজ। কৃষক ও তাহিরপুর কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, আর সপ্তাহ ১০ দিন আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে হাওরের প্রায় সব ধান কাটা শেষ করা যাবে।

এদিকে ফলন আশানুরূপ হলেও সোনার ফসল নিজেদের গোলায় উঠানোর সুযোগ কম পাচ্ছে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকেরা। শুরুতেই মহাজনের নিকট থেকে টাকা ধার নিয়ে ফসল ফলানোর কারণে কৃষকের হাড়ভাঙা খাটুনির ফসল অর্ধেকের কম দামেই নিয়ে নিচ্ছে এক শ্রেণির মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। টাকা পরিশোধ করতে কোনো কোনো কৃষক আবার  মাড়াইয়ের পূর্বেই কম দামে ধান বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে করে কৃষকের গোলা ধানশূণ্য থেকে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। 

এদিকে গত ২৮ এপ্রিল সরকারীভাবে ধান চাল ক্রয় উদ্বোধন করা হয়েছে। তাহিরপুর খাদ্য গুদামে প্রতি কৃষক ধান দিতে পারবে ১ মেট্রিক টন করে। প্রতি মন ধানের সরকারী দর নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ৪০ টাকা।

আর এ ধান ক্রয় করা হবে উপজেলার ৭ টি ইউনিয়নের প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষীদের কাছ থেকে। বর্তমানে উপজেলা কৃষি অফিস প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকদের একটি তালিকা করছে। আগামী ১০ মে’র মধ্যে তালিকার কাজ শেষ হবে। তালিকাকৃত কৃষকদের থেকে লটাারীর মাধ্যমে নির্বাচিতদের কাছ থেকে ধান ক্রয় করা হবে।

সরকারী দর ১ হাজার ৪০ টাকা হলেও বর্তমানে স্থানীয় হাটে ধানের বাজার দর ৭’শ থেকে ৭’শ ৫০ টাকা মণ। অথচ যারা মহাজনদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলেন তাদের এখন ৫শ টাকা মণ দরে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে। ফলে কৃষকের পরিশ্রমের ধানে লাভবান হবেন এসব মহাজনরা। 

হাতে নগদ টাকা না থাকায় ধান কাটা মাড়াইর পূর্বেই ২০ মণ ধান ৫শ টাকা ধরে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছেন তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওর পাড়ের উজান তাহিরপুর গ্রামের কৃষক জাক্কার মিয়া। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘হাড়ভাঙা পরিশ্রম আর সময়মত ধান তোলা যাবে কিনা সেই সংশয় নিয়ে দিনপার করতে হয়। কিন্তু সবশেষে যখন ফসল কাটা হয় তার সুফলও ভোগ করা হয় না। পানির দরে বিক্রি করে দিতে হয় উপায় না থাকায়।’

তাহিরপুর গ্রামের আরেক কৃষক আল-আমিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘প্রতি বছরই ২-৩ শ মণ ধান পাই। কিন্তু কখনোই খাদ্য গুদামে ধান দিতে পারিনি। লটারীতে যাদের নাম উঠে ততক্ষণে তাদের অধিকাংশের ঘরেই খাদ্য গুদামে দেওয়ার মত ধান থাকে না, খাদ্য গুদামে তখন ধান দেয় এক শ্রেণির মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। 

উপজেলা খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা মফিজুর রহমান বলেন,`খাদ্য গুদামে ধান ক্রয় উদ্বোধন করা হয়েছে। আগামী ১২ মে থেকে কৃষকরা সরাসরি খাদ্য গুদামে ধান দিতে পারবেন। তাছাড়া ইচ্ছে করলেই আমরা এখন-ই ধান নিতে পারি না। সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক নির্ধারিত সময়ে ধান সংগ্রহ করা হবে।’

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হাসান-উদ-দৌলা বলেন, ‘চলতি বোরো মৌসুমে তাহিরপুর উপজেলায় ১৭ হাজার ৫২৭ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৮ হাজার ৩০০ হেক্টর। এবং ধারণা করা হচ্ছে অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর ফলন ভাল হওয়ায় সর্বোচ্চ পরিমাণ ধান কৃষকরা ঘরে তুলতে পারবেন। কৃষকদের তালিকা তৈরির কাজ চলমান। প্রকৃত কৃষকরা যেন খাদ্য গুদামে ধান দিতে পারে সে লক্ষ্যেই আমরা কাজ করছি।’

 

এএফ-০৮