উজ্জ্বল ধর, ওসমানীনগর
মে ২৬, ২০২০
০৩:৩০ অপরাহ্ন
আপডেট : মে ২৬, ২০২০
০৩:৩৭ অপরাহ্ন
১৯৭১ সালের ২৫ মে বিকেলে পাকিস্তানি বাহিনী ওসমানীনগরের (তৎকালিন বালাগঞ্জ) বুরুঙ্গা ইউনিয়ন কার্যালয়ে এলে এলাকায় আতংক ছড়িয়ে পড়ে। ইউপি চেয়ারম্যান ইনজদ আলী বাজারের সবাইকে জানিয়ে দেন- ভয়ের কিছু নেই। পাকিস্তানিরা খারাপ উদ্দেশ্যে আসেনি। পাকিস্তানি বাহিনী ও চেয়ারম্যানের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ বৈঠক শেষে বুরুঙ্গা ইউনিয়নের প্রতিটা গ্রামে জানিয়ে দেওয়া হয় পরদিন সকালে বুরুঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ে শান্তি কমিটি গঠন করা হবে। শান্তি কার্ডধারীদের (ড্যাণ্ডি কার্ড) নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে পাকিস্তান সরকার। সবার আসা বাধ্যতামূলক।
২৬ মে ১৯৭১। মৃত্যুভয় নিয়েও কয়েকশ মানুষ সকাল ৮টায় স্কুল মাঠে উপস্থিত হলেন। পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাপ্টেন নূর উদ্দিন (মতান্তরে দাউদ খান) এর নেতৃত্বে একদল পাকিস্তানি সেনা সকাল ৯টায় জিপে চড়ে বুরুঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ে আসে। সকাল ১০টায় পাকবাহিনী সভার কথা বলে স্কুল মাঠে সমবেত লোকদের মধ্য থেকে হিন্দু-মুসলিমদের আলাদা করে নেওয়া হয়। তারপর হিন্দুদের বিদ্যালয়ের অফিস কক্ষে ও মুসলিমদের দক্ষিণ দিকের একটি ক্লাস রুমে ঢুকিয়ে দেয়। মুসলিম প্রত্যেককে চার কলেমা পড়তে বলে। ১০-১২ জন মুসলিমকে রেখে বাকিদের ছেড়ে দেওয়া হয়। তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়, তারা যেনো ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলতে বলতে এলাকা ত্যাগ করে। তারপর পাকবাহিনী বন্দি থাকা মুসলিমদের নির্দেশ করে ৪ জন করে হিন্দুকে এক সাথে বাঁধার। তখন গ্রামের প্রাক্তন চেয়ারম্যান বাদশা মিয়া বলেন, ‘এটাতো ইসলামের বিধান না। সবাইকে এখানে দাওয়াত দিয়ে আনা হয়েছে। দাওয়াত দিয়ে এভাবে রশি দিয়ে বাঁধা কি ঠিক?’
পাকবাহিনীর ক্যাপ্টেন নূর উদ্দিন তখন বাদশা মিয়াকে প্রচণ্ড ধমক দেয়। ধমকে ভয় পেয়ে তিনি চুপসে যান। তখনকার সময় সিলেট জজ কোর্টের প্রভাবশালী উকিল রাম রঞ্জন ভট্টাচার্যকে একটি চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়। রশি দিয়ে বাঁধার মুহূর্তে কৌশলে ভবনের জানালা খুলে প্রীতি রঞ্জন চৌধুরী ও রানু মালাকার জানালা দিয়ে পালিয়ে যান। পাকসেনা তা দেখে বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়লেও তারা নিরাপদে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। দুপুর ১২টায় পাক সেনারা আটককৃত সবাইকে ভবন থেকে মাঠে এনে হাত বেঁধে লাইনে দাঁড় করায়। সামনের দিকে ৩টি এলএমজি প্রস্তুত করা হয়। ক্যাপ্টেন নূর উদ্দিন উকিল রাম রঞ্জন ভট্টাচার্যকে বলে, ‘আপনি বৃদ্ধ লোক। আপনাকে মারবো না। আপনি বাড়ি চলে যান।’
রাম রঞ্জন ভট্টাচার্য বাঁচার আশ্বাসে চেয়ার চেড়ে বাড়ির দিকে যাত্রা করলে পেছন থেকে তাঁকে গুলি ছুঁড়ে হত্যা করে পাকবাহিনী। বালাগঞ্জ রাজাকার বাহিনীর কমাণ্ডার আব্দুল আহাদ চৌধুরী (ছাদ মিয়া) ও আব্দুল খালিক পাক ক্যাপ্টেন নূর উদ্দিনকে বলে, ‘স্যার মাঠে বাঁধা সবাই মুজিবের সমর্থক, এদের বাঁচিয়ে রেখে লাভ নেই।’ পাক বাহিনীর ক্যাপ্টেন নূর উদ্দিন চারদিকে চোখ বুলিয়ে ইশারা করতেই এলএমজিগুলো এক সঙ্গে গর্জে উঠে। তাজা রক্তে বুরুঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের সবুজ মাঠ রঞ্জিত হয়ে উঠে।
সেদিন শহীদ হন ১। রাম রঞ্জন ভট্টাচার্য, ২। সমরজিৎ চক্রবর্তী, ৩। নিকুঞ্জ বিহারী চক্রবর্তী, ৪। নিত্য রঞ্জন চক্রবর্র্তী, ৫। বিশ্বতোষ চক্রবর্র্তী, ৬। দূর্গাপদ আচার্র্য্য, ৭। যোগেশ চন্দ্র দেব, ৮। রজনী কান্ত দেব, ৯। যতীন্দ্র কান্ত দেব, ১০। রেবতী মোহন দত্ত, ১১। রনজিৎ দেব, ১২। গজেন্দ্র কুমার সেন, ১৩। সুকুমার বৈদ্য, ১৪। দ্বিগেন্দ্র বৈদ্য, ১৫। হরি চরণ বৈদ্য, ১৬। সুধির বৈদ্য, ১৭। কিরণ বৈদ্য, ১৮। নীরদ বৈদ্য, ১৯। রমন চন্দ্র দাস, ২০। অশ্বিনী কুমার দেব, ২১। সুনীল মালাকার, ২২। খতর মালাকার, ২৩। চিত্ত রঞ্জন মালাকার, ২৪। ছাওধন শব্দকর, ২৫। রবীন্দ্র শব্দকর, ২৬। প্রহ্লাদ শব্দকর, ২৭। ময়নাধন শব্দকর, ২৮। বেনু শব্দকর, ২৯। দুলাল শব্দকর, ৩০। বিহারী নমঃশূদ্র, ৩১। সদয় নমঃশূদ্র, ৩২। অক্ষয় নমঃশূদ্র, ৩৩। মহেন্দ্র নমঃশূদ্র, ৩৪। হর কুমার নমশূদ্র, ৩৫। পরেশ নমঃশূদ্র, ৩৬। রাজেন্দ্র ধর, ৩৭। রাখাল দেব, ৩৮। শ্যামা ধর, ৩৯। গনেশ দেব, ৪০। গঙ্গেশ ধর, ৪১। সতীশ চন্দ্র দেব, ৪২। অভিমুন্য দেব, ৪৩। নিরঞ্জন দাস, ৪৪। যতীন্দ্র দেব, ৪৫। গোপেশ দেব, ৪৬। আনন্দ চন্দ্র দেব, ৪৭। শ্যামচরণ দেব, ৪৮। বিহারী চন্দ্র দে, ৪৯। ধীরেন্দ্র চন্দ্র দেব, ৫০। সুনীল চন্দ্র মালাকার, ৫১। গঙ্গেশ চন্দ্র দেব, ৫২। বিনয় চন্দ্র দাশ, ৫৩। রমেশ চন্দ্র দেব, ৫৪। সুনীল চন্দ্র দেব, ৫৫। অশ্বিনী কুমার দেব, ৫৬। ব্রজেন্দ্র কুমার দাস, ৫৭। পিয়ারী নমঃসূদ্র, ৫৮। নন্দ লাল পাল, ৫৯। সরধন নমঃশূদ্র, ৬০। দ্বারিকা নমঃশূদ্র, ৬১। সূর্য্যরাম নমঃশূদ্র, ৬২। বাসীরাম নমঃশূদ্র, ৬৩। পুলিন চন্দ্র দাস, ৬৪। কিরন চন্দ্র দাস, ৬৫। নীলরাম বৈদ্য, ৬৬। নীরোদ বৈদ্য, ৬৭। শচীন্দ্র চন্দ্র দেব, ৬৮। দয়াল রাম বৈদ্য, ৬৯। খোকা চন্দ্র দেব, ৭০। নদীয়া চরণ দেব, ৭১। দীনবন্ধু আচার্য্য, ৭২। বিহারী চন্দ্র দাস। মারাত্মক আহত অবস্থায় দুর্গাপদ আচার্য্য উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করলে পাকবাহিনী আবারও সবার উপর ব্রাশফায়ার করে এবং মৃত্যু নিশ্চিত করতে বুরুঙ্গা বাজার থেকে দুই টিন কেরোসিন শহীদদের গায়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। মানুষ পোড়া গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠে চারদিকে। পুরুষদের আর্তচিৎকারে চারিদিক যখন প্রকম্পিত আট-দশজন পাক দালাল তখন ব্যস্ত গ্রামের পর গ্রাম লুটপাট ও নারী নির্যাতনে। প্রায় ৩ ঘণ্টা তাণ্ডব চালিয়ে পাকবাহিনী ও দালালরা বুরুঙ্গা ত্যাগ করে।
একপর্যায়ে লাশগুলো বুরুঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন স্থানে গর্ত করে মাটিচাপা দেয় তারা। সে দিনের গণহত্যায় ৭২ জন লোক শহীদ হন, যাদের সবাই ছিলেন সনাতন ধর্মাবলম্বী।
গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নিবাস চক্রবর্ত্তী বলেন, ‘গণহত্যার মঞ্চে দাঁড়িয়ে চোখের সামনে বাবা, ভাইসহ অগণিত মানুষকে গুলি করে এবং পুড়িয়ে হত্যা করতে দেখেছি। ভাগ্যক্রমে গুলিবৃদ্ধ হয়েও বেঁচে গিয়েছিলাম। সে দিনের স্মৃতি আজও শরীর শিহরিত করে।’
উডি/বিএ-০৬