এক ভিক্ষুকের জীবন বদলে দিতে মানবিক উদ্যোগ

মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী, দোয়ারাবাজার


জুন ১০, ২০২০
০৯:৪৮ অপরাহ্ন


আপডেট : জুন ১০, ২০২০
০৯:৪৮ অপরাহ্ন



এক ভিক্ষুকের জীবন বদলে দিতে মানবিক উদ্যোগ

ভিক্ষুক মো. আবদুল হক

মো. আবদুল হক জন্ম থেকে অন্ধ। অসচ্ছল পরিবারে জন্ম নেওয়া এই হতদরিদ্র মানুষটি একজন ভিক্ষুক। বসতবাড়ি সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার সদর ইউনিয়নের নৈনগাঁও গ্রামে।

বোধ-বুদ্ধির পর থেকে ভিক্ষাবৃত্তি করেই জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন মো. আবদুল হক। প্রতিদিন সকালে এক হাতে লাঠি ও অপর হাতে থালা নিয়ে ঘর থেকে বের হন তিনি। সারাদিন ভিক্ষা করে যা পান, তা দিয়েই চলে তাঁর সংসার। পরিবারে স্ত্রী ও ৪ কন্যা ব্যতিত আর কেউ নেই। ফলে পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি তিনি। প্রতিদিন উপজেলা সদর ও আশপাশের এলাকায় দেখা যায় তাকে। লাঠিতে ভর করে থালা হাতে চিরচেনা সুরে গজল গেয়ে ভিক্ষা করেন আবদুল হক।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আবদুল হক চোখে দেখেন না জন্ম থেকেই। দুই চোখ ভরে এ পৃথিবীর আলো কিংবা প্রকৃতির কিছুই দেখা তার ভাগ্যে জোটেনি। চেনাজানা নেই কোনো রাস্তাঘাটও। সেই বাল্যকাল থেকে অন্যদের হাত ধরে তার চেনা হয়েছে কেবল বাড়ি থেকে উপজেলা সদরে আসা-যাওয়ার রাস্তাটি।

ভিক্ষা করতে এখন তার কারও সহায়তা নিতে হয় না। একমাত্র বিশ্বস্ত লাঠিই তাকে পথ দেখায়। লাঠি আর থালাই তার নিত্যদিনের সঙ্গী। তিনি চোখে না দেখলেও জন্মের পর মননের চোখ দিয়ে ও অনুভূতিতে অনেক কিছু দেখতে পান।

অতীতে দোয়ারাবাজার থেকে সুনামগঞ্জ জেলা শহর পর্যন্ত এখনকার মতো সড়ক যোগাযোগ ছিল না। জেলা শহরে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম ছিল তখন লঞ্চ কিংবা ইঞ্জিনচালিত নৌকা। সেই সময়ে তিনি ভিক্ষা করতেন লঞ্চযোগে। সকালে দোয়ারাবাজার থেকে ছেড়ে যাওয়া লঞ্চে উঠতেন। সারাদিন ভিক্ষা করে বিকেলে সুনামগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা লঞ্চে উঠে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতেন। প্রতিদিন এলাকার লোকজনের কথা শুনতে শুনতে অনেকের নাম তার আত্মস্থ হয়ে যায়। সেই থেকে চোখে না দেখলেও এলাকার অনেক লোকের কন্ঠ শুনেই তিনি অকপটে নাম বলে দিতে পারেন। আজ অবধি পূর্বে শোনা কন্ঠ বহু বছর পরেও দূর থেকে শুনে তিনি নাম ধরে ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করেন। এমন এক অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী ভিক্ষুক আবদুল হক।

এখন জেলা শহরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য সড়ক হওয়ায় সুরমা নদীতে লঞ্চ চলাচল করে না। তাই তিনি লঞ্চযোগে আর ভিক্ষাবৃত্তি করতে পারেন না। প্রায় দেড় যুগ ধরে উপজেলা সদরেই ভিক্ষা করছেন থালা হাতে নিয়ে। ভিক্ষা করতে গিয়ে তার উচ্চারিত চিরাচরিত শব্দগুলো এখানকার সকলের কাছে পরিচিত। দূর থেকে যে কেউ বলতে পারবেন এটি আবদুল হকের কণ্ঠ।

আবদুল হকের বয়স এখন প্রায় চল্লিশ। এখনও থেমে নেই এই অন্ধের জীবনযুদ্ধ। আজও তিনি ভিক্ষা করেন। দেশ স্বাধীনের ৪ দশক পেরিয়েছে। পাল্টেছে এখানকার অতীত চিত্রপট। অনেকের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেছে। কেবল ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি আবদুল হকের। এখনও তিনি ভিক্ষা করেই চলেছেন।

কখনও উপজেলার প্রধান সড়ক, কখনও থানার সামনে, কখনও উপজেলা পরিষদের সামনে দাঁড়িয়ে কিংবা বসে, আবার কখনও বা উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ের সামনে থেকে মধ্যবাজার পর্যন্ত লাঠিতে ভর করে চিরাচরিত শব্দ বুননের মাধ্যমে সচরাচর ভিক্ষা করতে দেখা যায় তাকে।

সম্প্রতি দোয়ারাবাজার উপজেলা পরিষদের সামনে তার সঙ্গে দেখা হয় সমাজকর্মী আবুল হাসনাত সোলায়মানের। তার কন্ঠ শুনেই ভিক্ষুক আবদুল হক এগিয়ে যান। অকপটে তার নাম ধরে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করতে শুরু করেন। সেই কবে ছাত্র থাকাকালে লঞ্চে ভিক্ষা করার সময় তিনি সোলায়মানের নাম জেনেছিলেন। আজও তার কন্ঠ মনে রেখেছেন আবদুল হক। সেই থেকে আবুল হাসনাত সোলায়মানের মধ্যে মানবিক জাগৃতি ঘটে। আবদুল হকের স্থায়ী পুনর্বাসনে নিজে থেকেই মানবিক উদ্যোগ গ্রহণ করেন সোলায়মান। তিনি উপজেলার বিভিন্ন এলাকার সিনিয়র-জুনিয়র বন্ধু-বান্ধব, সহপাঠী, রাজনৈতিক ও সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দের সহায়তা চেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দেন। এমন আহ্বানে মাত্র কয়েকদিনেই বেশ সাড়া পান সোলায়মান। সবার মতামতের ভিত্তিতে গঠন করেন ‘আবদুল হক সহায়তা ফান্ড’। 

ফান্ড কালেকশনের দায়িত্বে রয়েছেন দোয়ারাবাজার উপজেলার সমাজকর্মী আবুল হাসনাত সোলায়মান ও ছাতক উপজেলার সমাজকর্মী রেজাউল হক রেজা। তাদের উদ্দেশ্য- আর ভিক্ষাবৃত্তি নয়, নিজেদের আর্থিক সহায়তায় আবদুল হককে সচ্ছলতা এনে দিয়ে স্থায়ীভাবে পুনর্বাসিত করবেন। এমন মহৎ উদ্যোগ এ পর্যন্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ সাড়া পেয়েছে। স্থানীয়রাসহ দেশ-বিদেশের অনেকে এই মানবিক সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন।

আবদুল হক সহায়তা ফান্ডের উদ্যোক্তা আবুল হাসনাত সোলায়মানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত (৯ জুন)  সহায়তা ফান্ডে দেশ-বিদেশের অনেকে আর্থিক সহায়তা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এখন পর্যন্ত সর্বমোট ২ লাখ ১৭ হাজার ৫০০ টাকা তালিকাভুক্ত হয়েছে এবং ফান্ডে জমা হয়েছে মোট ৬৪ হাজার ৫০০ টাকা। তিনি এই অসহায় মানুষটির স্থায়ী পুনর্বাসনে দেশ-বিদেশের বিত্তবানদের প্রতি সহায়তা কমনা করেছেন। আবদুল হক সহায়তা ফান্ডে টাকা পাঠানো যাবে ০১৭৪৮৯৮৮৬৬৮ (বিকাশ), ০১৭১০৪৪৩৯৫৩ (বিকাশ) এবং ০১৭২৩৫০৮৫৭৩ (নগদ) নম্বরে।

 

এইচএইচ/আরআর-০২