বিশ্বজিত রায়, জামালগঞ্জ
জুন ১২, ২০২০
০২:২৬ অপরাহ্ন
আপডেট : জুন ১২, ২০২০
০২:২৬ অপরাহ্ন
'করোনার লাগি কোনো কাজ-কাম নাই। বালুর কাম বন্ধ থাকায় এখন ঘুরাইয়া খাওন লাগতাছে। সরকার থাইক্যা কোনো কিছু পাইতাছি না। শুধুমাত্র আমার একলা মানুষের উপর পরিবারটা চলে। খুব দুঃখ-কষ্টে দিন যাইতাছে ভাই।'
করোনায় বেকার হয়ে পড়া সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার সাচনা বাজার ইউনিয়নের দুর্লভপুর গ্রামের বালু শ্রমিক সুনু মিয়া আক্ষেপের সুরে এ কথাগুলো বলছিলেন।
অপর এক শ্রমিক জামালগঞ্জ সদর ইউনিয়নের লালপুর গ্রামের আবুল হোসেন বলেন, 'গত দুই-তিন মাস ধইরা সব লেবার বেকার। তাদের মধ্যে আমিও একজন। আমার মতো সবাই দিন আনে দিন খায়। খুব কষ্টের মধ্যে আছি। খাইয়া না খাইয়া চলন লাগতাছে। এই অবস্থায় কি কইরা চলমু খইন।'
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই করোনাকালে বেকার হয়ে পড়েছেন সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জের কয়েক হাজার বালু ও পাথর শ্রমিক। করোনার সংক্রমণে গোটা পৃথিবী বিপর্যস্ত হয়ে পড়লে বাংলাদেশেও সংক্রমণের সংখ্যা ও মৃত্যু পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। এতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন এ উপজেলার প্রায় ৪ সহস্রাধিক শ্রমিক।
করোনার কারণে কর্মহীন হয়ে পড়া বৃহৎ এই শ্রমিক শ্রেণি চোখে এখন সর্ষে ফুল দেখছেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে অভাবের অকুল সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছেন তারা। এতদিন ধার-দেনা করে কোনোরকমে দিনাতিপাত করলেও বর্তমানে অনাহারে-অর্ধাহারে দিনযাপন করার উপক্রম হয়েছে বলে জানিয়েছেন অনেকে।
দুর্লভপুর ও ফতেপুরের বেশ কয়েকটি বালুর ডাম্প এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এই সময়টায় বালুর ঘাটগুলো যেখানে কর্মব্যস্ত থাকার কথা ছিল, সেখানে সুনসান নীরবতা। শত শত শ্রমিক ও নৌকার মাঝি-মাল্লাদের হৈ-হুল্লোরে সর্বদা কর্মমুখর থাকলেও করোনায় সেই সুরমা তীর এখন পুরোদস্তুর কর্মশূন্য। প্রাণচাঞ্চল্যতা হারিয়েছে উপজেলার সবচেয়ে বড় দুর্লভপুর বালুঘাট। মরণঘাতী করোনার উদ্ভুত পরিস্থিতিতে বালুঘাটগুলোতে যেমন নিস্তব্ধ শূন্যতা দেখা দিয়েছে, তার চেয়ে বেশি শূন্য হয়ে পড়েছেন উপজেলার অগণিত বালু শ্রমিক। পরিবারের ঘানি টানতে গিয়ে প্রায় পরাস্ত শ্রমিকেরা এখন কর্মে ফেরার আকুতি জানাচ্ছেন।
জামালগঞ্জ উত্তর ইউনিয়নের সাচনা গ্রামের হেমেন্দ্র সরকার বলেন, 'একদম কষ্টের মধ্যে আছি। বালুর কাম কইরাই সংসার চালাইতে হয় আমার। এই কাম ছাড়া অন্য কোনো কাম করতাম পারি না। পোলাপানদের পড়ালেখা আর পরিবারের খরচ চালানো সম্ভব হইতাছে না। করোনায় কাম না থাকায় ঘরের বাজার-হাট করা বন্ধ হইয়া গেছে।'
ভীমখালী ইউনিয়নের ঘাগটিয়া গ্রামের তাজুদ আলী বলেন, 'করোনা আইছে থাইক্যাই আমরা বেকার। আইজ তিন মাস হয় কোনো কাম-কাজ নাই। কাম না থাকায় বেকার হইয়া বইয়া আছি বাড়িত। সামনের দিন যদি কাম-কাজ এইভাবে বন্ধ থা,কে তা হইলে না খাইয়া মরণ লাগব। এইরকম না খাইয়া মরণ থাইক্যা করোনায় মরণডাই ভালা।'
জানা যায়, তাহিরপুরের যাদুকাটা নদী, সুনামগঞ্জের ধোপাজান চলতি নদী, ছাতকের চেলা গাঙ ও ভোলাগঞ্জ টুকেরবাজার ছড়া থেকে উত্তোলনকৃত মূল্যবান বালু উপজেলার দুর্লভপুরের আশপাশে ডাম্পিং করে মজুদ রাখা হয়। সুরমার তীরবর্তী উঁচু জায়গা ডাম্প আকারে ভাড়া নিয়ে ব্যবসায়ীরা বর্ষাকালে সেখানে বালু জমা করে রাখেন। পরে হেমন্তকালে মূল্য বৃদ্ধি পেলে স্তুপাকৃতির এই অঢেল বালু বিক্রি করে দেন তারা।
এছাড়া ট্যাকেরঘাট ও ভোলাগঞ্জ থেকে পাথর এনে এখানে মজুদ করে রাখা হয়। পরে তা মেশিনে বিভিন্ন সাইজ করে বিক্রি করেন ব্যবসায়ীরা। সেই বালু-পাথর নৌকা থেকে উত্তোলন ও বোঝাইয়ের জন্য দলবদ্ধভাবে বহু শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। যেখানে কাজ করে প্রায় ৪ হাজারেরও বেশি শ্রমিক তাদের জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। এই বালু-পাথর জামালগঞ্জে বৃহৎ একটা কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে বলে জানা গেছে।
সাচনা বাজার ইউনিয়নের ফতেপুর গ্রামের বাসিন্দা শ্রমিক সরদার মো. জামাল উদ্দিন জানান, এখানে প্রায় ৪ হাজারেরও বেশি শ্রমিক বালির কাজ করে সংসার চালায়। এ কাজে দৈনিক ৪-৫শ টাকা রোজগার হয় তাদের। তারা বালুর কাজ ব্যতীত অন্য কোনো কাজে তেমন সক্ষম নন। এই করোনায় সবচেয়ে বেশি বিপদে আছেন হাজার হাজার বালু শ্রমিক। ঘাট বন্ধ থাকায় স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন তারা। ঘাট খুলে দিলে হয়তো তাদের রুটি-রুজি সম্ভব হবে।
জামালগঞ্জের বালু ব্যবসায়ী মো. ইমদাদুল হক আফিন্দী বলেন, 'এই করোনার কারণে ব্যবসায়ীরা যতটুকু না ক্ষতিগ্রস্ত, তার চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকরা। তারা তো দিন আনে দিন খায়। কাজ না থাকার কারণে শ্রমিকরা খুবই অসুবিধার মধ্যে আছেন, যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না।
তিনি আরও বলেন, 'বালু-পাথর বেচাকেনার মাধ্যমে এখানে প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য হয়। বছরে তা শত কোটি টাকার উপরে হবে। মালিক-শ্রমিক সর্বক্ষেত্রে এখন স্থবিরতা বিরাজ করছে। বিশেষ করে শ্রমিক শ্রেণি এখন মারাত্মক বেকায়দায় আছে।'
বিআর/আরআর-০১