বড়লেখা হাসপাতালের সেকমো'র অনিয়ম তদন্তে কমিটি গঠন

বড়লেখা প্রতিনিধি


জুলাই ২২, ২০২০
১১:০৬ অপরাহ্ন


আপডেট : জুলাই ২৩, ২০২০
১২:৫৮ পূর্বাহ্ন



বড়লেখা হাসপাতালের সেকমো'র অনিয়ম তদন্তে কমিটি গঠন

মৌলভীবাজারের বড়লেখা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (সেকমো) নুর নবী রাজু নিজের স্ত্রী মৌসুমী কিবরিয়া ও শ্যালক-শালিকাকে নিয়ে লাইসেন্স ছাড়াই প্রায় ১ বছর ধরে চালাচ্ছেন ‘হলি লাইফ স্পেশালাইজড হসপিটাল’ নামের একটি বেসরকারি হাসপাতাল। সরকারি ওষুধ পাচার, সার্টিফিকেট বিক্রি, ভুয়া টেস্ট বাণিজ্য, ভুল চিকিৎসা, জ্বর ও গলা ব্যথার রোগীদেরকে করোনার ভয় দেখিয়ে ভর্তি ও মোটা অঙ্কের বিল আদায়সহ নানা প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে হাসপাতালটির বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগে গত ১৬ জুলাই ভ্রাম্যমাণ আদালত ওই হাসপাতালকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে লাইসেন্স গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত চিকিৎসা কার্যক্রম বন্ধ রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন।

এর আগে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার সেকমো নুর নবী রাজু কর্তৃক প্রতারিত দুই ব্যক্তি গত ১৫ জুলাই তার বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহা-পরিচালক ও উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বরাবরে পৃথক দু'টি অভিযোগ দিয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার (২১ জুলাই) বিকেলে একটি অভিযোগের তদন্তে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রত্নদ্বীপ বিশ্বাস।

সরেজমিন পরিদর্শন ও অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার নুর নবী রাজু সরকারি চাকরিজীবী হয়েও চাকরিবিধি অমান্য করে বড়লেখা পৌরশহরের দক্ষিণ বাজারে ‘হলি লাইফ স্পেশালাইজড হসপিটাল’ প্রতিষ্ঠা করেন। স্ত্রী মৌসুমি কিবরিয়াকে চেয়ারম্যান বানিয়ে ও শ্যালক-শালিকাকে গুরুত্বপূর্ণ পদে রেখে গত ১ বছর ধরে বিনা লাইসেন্সে তিনি রমরমা চিকিৎসা বাণিজ্য চালাচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রভাবশালী মহলকে ম্যানেজ করে তিনি নিজের গড়া বেসরকারি হাসপাতালে রমরমা বাণিজ্য করছেন। সরকারি হাসপাতালের ডিউটি ফাঁকি দিয়ে বেশিরভাগ সময় হলি লাইফে সময় দেন। সরকারি হাসপাতালে আগত রোগীদের ফুসলিয়ে হলি লাইফে নিয়ে যান তিনি। হাসপাতালের সরকারি মালামাল গজ, সিরিঞ্জ, জেসুকেইন, হেলোথিন পাচার করেন হলি লাইফে। বাসায় এবং হলি লাইফে বসে সরকারি হাসপাতালের ছাড়পত্র, ভুয়া সার্টিফিকেট, টেস্টের রিপোর্ট বিক্রি করেন। জ্বর ও গলা ব্যাথার রোগীদের করোনার ভয় দেখিয়ে ভর্তি রেখে ৩০-৪০ হাজার টাকা বিল আদায় করেন। হাসপাতালের ল্যাবে নেই টেস্টের যথাযথ যন্ত্রপাতি। ভুয়া রিপোর্ট বানিয়ে ইচ্ছামতো টাকা আদায় করেন তিনি।

জানা গেছে, ইতোপূর্বে এক পুলিশ অফিসারকে এইচবিএইচএজি’র ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে বেকায়দায় পড়েছিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পরে নুর নবী রাজু তা আপসে মীমাংসা করেন। একজন সিজারিয়ান রোগীকে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কম দেখিয়ে রক্ত দেওয়ার কথা বলে করেছেন ক্রসম্যাচিং টেস্ট বাণিজ্য। প্রত্যেক ক্রসম্যাচিংয়ে নেওয়া হচ্ছে ১৫০০ থেকে ২৫০০ টাকা পর্যন্ত। কিছুদিন পূর্বে একজন গলব্লাডারের রোগীকে ঢাকা থেকে আসা ডা. তানোয়ারুল ইসলামকে দিয়ে অপারেশন করানো হয়। রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় স্বজনদের সন্দেহ হচ্ছে ওই চিকিৎসক আদৌ সার্জন ছিলেন কি না।

ভুক্তভোগী গিয়াস উদ্দিন অভিযোগ করেন, ১২ মে মোটরসাইকেল দূর্ঘটনায় তার ভাই ছইফ উদ্দিনের হাত ভেঙে যায়। তাকে সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান তিনি। তখন ইমার্জেন্সিতে বসা সেকমো নুর নবী রাজু বলেন, 'এখানে কিছু করা সম্ভব নয়।' তাদের ফুসলিয়ে তিনি হলি লাইফ হসপিটালে নিয়ে যান। পরে বিভিন্ন কায়দায় ১৮,৫০০ টাকা আদায় করেন। কিন্তু ২০-২৫ দিন গেলেও হাতের উন্নতি হয়নি। তারা নুর নবী রাজুর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি আরও ২ মাসের ওষুধ দেন। হাতের অবস্থার অবনতি ঘটায় গত ২৮ জুন একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এক্সরের পর দেখা যায় ভাঙা হাত ভাঙাই রয়ে গেছে, জোড়া লাগেনি। তারা আবারও নুর নবী রাজুর কাছে গেলে তিনি চরম অসদাচরণ করেন। তখন তাঁদের বুঝতে বাকি থাকে না যে ভুল চিকিৎসায় তার ভাইয়ের হাতের অবস্থার অবনতি ঘটেছে। পরে সিলেটের একজন অর্থোপেডিকস চিকিৎসককে দেখিয়ে জানতে পারেন ভুল চিকিৎসায় মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। অপারেশন ছাড়া হাড় জোড়া লাগার সম্ভাবনা নেই। অপারেশন করতে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা গুনতে হবে। এ ব্যাপারে তিনি গত ১৫ জুলাই নুর নবীর বিরুদ্ধে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার নিকট লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। 

অভিযুক্ত উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার নুর নবী রাজু জানান, হলি লাইফ স্পেশালাইজ হাসপাতালটির চেয়ারম্যান তার স্ত্রী মোসুমী কিবরিয়া। কিন্তু ভবনের মালিক কোনো নারীর সঙ্গে চুক্তি করতে রাজি হননি। তাই তিনি (নুর নবী রাজু) চেয়ারম্যান হয়ে মালিকের সঙ্গে ডিড (চুক্তি) করেছেন। তবে পরক্ষণেই তিনি তা স্ত্রীর নামে ফেরত দিয়েছেন।

বিভিন্ন অভিযোগের ব্যাপারে তিনি জানান, হাসপাতালের ম্যানেজিং ডিরেক্টর আব্দুর রহমান গত ৮ মাসের হিসাব দেননি। তিনি মালিকানা দাবি করায় তার সঙ্গে সমস্যা হয়েছে। এজন্য তিনিই তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। লাইসেন্স না থাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্দেশনায় হাসপাতালটি বন্ধ রেখেছেন।

এ ব্যাপারে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রত্নদ্বীপ বিশ্বাস জানান, ভ্রাম্যমাণ আদালত হলি লাইফ স্পেশালাইজ হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে লাইসেন্স পাননি। সরকারি ওষুধ, মেয়াদোত্তীর্ণ পরীক্ষাসামগ্রী পাওয়াসহ নানা অনিয়মের দায়ে হাসপাতালকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সেকমো নুর নবী রাজুর বিরুদ্ধের একটি অভিযোগ তদন্তের জন্য মঙ্গলবার তিনি ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছেন। সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে কমিটিকে নির্দেশ দিয়েছেন।

 

এজে/আরআর-১৫