নানা বিতর্কে ছাত্রলীগ, কমিটি নেই তিন বছর

নিজস্ব প্রতিবেদক


অক্টোবর ০৯, ২০২০
০৬:২৩ পূর্বাহ্ন


আপডেট : অক্টোবর ০৯, ২০২০
০৬:২৩ পূর্বাহ্ন



নানা বিতর্কে ছাত্রলীগ, কমিটি নেই তিন বছর

নেতিবাচক নানা কর্মকাণ্ডে সারাদেশে বিতর্কিত হচ্ছে ছাত্রলীগ। সিলেটেও তাদের একই অবস্থা। তিন বছর ধরে জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি নেই। তাই সাংগঠনিক কার্যক্রমও নেই। তবু বিতর্কিত নানা কর্মকাণ্ডে বারবারই নাম আসছে ছাত্রলীগের। সর্বশেষ এমসি কলেজ ছাত্রাবাসসহ সিলেট নগরের বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণকাণ্ডেও বিতর্কিত হয়েছে ছাত্রলীগ।

সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সবশেষ কমিটি গঠন করা হয় ২০১৪ সালে। শাহরিয়ার আলম সামাদকে সভাপতি ও এম. রায়হান চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক করা হয় ওই কমিটিতে। কমিটি গঠনের পর জেলা ছাত্রলীগে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে। কমিটির পদপ্রাপ্তদের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন পদবঞ্চিত একটি অংশ। একাধিকবার কমিটি স্থগিতও করা হয়। কেন্দ্রীয় কমিটি সামাদ ও রায়হানকে সম্মেলন করার তারিখ নির্ধারণ করে দিলেও তারা সম্মেলন করতে ব্যর্থ হন। এরপর ২০১৭ সালের অক্টোবরে টিলাগড়কেন্দ্রিক অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুন হন ছাত্রলীগ কর্মী ওমর মিয়াদ। এই হত্যায় জেলা ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এম. রায়হান চৌধুরী প্রধান আসামি হন। এ ঘটনায় ২০১৭ সালের ১৮ অক্টোবর জেলা ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। পরে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদে প্রায় দেড়শ জীববৃত্তান্ত সংগ্রহ করা হলেও কমিটি গঠন করা হয়নি। 

ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের অভিযোগ, ত্যাগী ও শিক্ষিত ছাত্রদের বাদ দিয়ে সুবিধাবাদীদের দিয়ে কমিটি গঠন করার কারণে বার বার সমালোচিত হয়েছে ছাত্রলীগ। জেলা ছাত্রলীগের মতো একই অবস্থা মহানগর শাখারও। ২০১৫ সালের ২০ জুলাই গঠন করা হয় মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি। আব্দুল বাছিত রুম্মানকে সভাপতি ও আব্দুল আলীম তুষারকে সাধারণ সম্পাদক, সজল দাস অনিক ও সৈকত চন্দ্র রিমিকে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয় কমিটিতে। কমিটির মেয়াদ ছিল এক বছর। কিন্তু তিন বছরেও তারা পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে পারেননি। নির্ধারিত সময়ে কমিটি না হওয়ায় অনেকের ছাত্রত্বই চলে গেছে। তাই অনেক ছাত্রলীগ নেতা পদবঞ্চিত হয়েই ছাত্ররাজনীতি শেষ করেছেন। এছাড়া নগর কমিটির আওতাধীন বেশিরভাগ ওয়ার্ড কমিটি ও মহানগর ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ দুই ইউনিট সিলেট এমসি কলেজ ও সরকারি কলেজে ছাত্রলীগের কমিটি গঠন না করায় ইউনিটগুলোর নেতাকর্মীদের ক্ষোভ ছিল দীর্ঘদিনের। 

এমসি ও সরকারি কলেজকে কেন্দ্র করে টিলাগড়কেন্দ্রিক ছাত্রলীগের কার্যক্রমে বার বার সমালোচিত হয়েছে সিলেট ছাত্রলীগ। ২০১৮ সালের ২১ অক্টোবর বিলুপ্ত করা হয় সিলেট মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি। এছাড়া সংগঠনের নীতি ও আদর্শ পরিপন্থী কার্যক্রম এবং নৈতিকস্খলনজনিত গুরুতর অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় বহিষ্কার করা হয় মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আলীম তুষারকে। যদিও পরে সেই বিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয়। 

ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জানান, কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় কিছু আওয়ামী লীগ নেতা সিলেট ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণ করেন। তাদের পছন্দেই হয় কমিটি। তাই পদ পেতে ওই নেতাদের গ্রুপে যোগ দিতে হয় তাদের।

সিলেট ছাত্রলীগে কমিটি গঠন থেকে শুরু করে সকল কার্যক্রমে চারটি গ্রুপের প্রভাব বেশি। এগুলো- দর্শন দেউড়ী গ্রুপ, তেলিহাওর গ্রুপ, টিলাগড় গ্রুপ ও কাশ্মীর গ্রুপ নামে পরিচিত। দর্শন দেউড়ী গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরীর হাতে। এছাড়া তেলিহাওর গ্রুপ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খান, কাশ্মীর গ্রুপ মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা বিধান চন্দ্র সাহা ও আলোচিত টিলাগড় গ্রুপ সিটি কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদ ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতা রঞ্জিত সরকার নিয়ন্ত্রণ করেন। সিলেট জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের সবশেষ দুই কমিটিতে সভাপতি-সম্পাদকসহ গুরুত্বপূর্ণ সকল পদে ছিলেন এই চার গ্রুপের নেতারা। 

গত দুই বছরে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুন হয়েছেন ছাত্রলীগের অন্তত ৫ নেতা। এমসি কলেজ ছাত্রাবাস পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে সংঘবদ্ধ ধর্ষণে অভিযুক্ত সবাই টিলাগড় গ্রুপের রঞ্জিত সরকারের অনুসারী। নগরের দাড়িয়াপাড়ায় তরুণী ধর্ষণে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা নিজু কাশ্মীর গ্রুপ থেকে বেরিয়ে যাওয়া স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা পিযুষ কান্তির অনুসারী। এছাড়াও নানা সময়ে গাড়ি চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও ধর্ষণের ঘটনায় বিতর্কিত হয়েছেন ছাত্রলীগ নেতারা।

কিন্তু সাম্প্রতিক অপকর্মে জড়িতরা ছাত্রলীগের কেউ নয় বলে দাবি করেছেন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সিলেটে ছাত্রলীগের কোনো কমিটিই নেই। ধর্ষণ ও অপকর্মের সঙ্গে জড়িতরাও ছাত্রলীগের কেউ নয়।’

জেলা ছাত্রলীগের এক নেতা বলেন, ‘ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে অতীতে অনেকে অপকর্ম করেছে। এতে ছাত্রলীগের বদনাম হয়েছে। কিন্তু তাদের চিহ্নিত করা যায়নি।’ তবে ছাত্রলীগের কিছু নেতা অপকর্মে লিপ্ত রয়েছে বলেও তিনি স্বীকার করেন। এ জন্য ছাত্রলীগের সাবেক কয়েকজন নেতাকে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘সাবেক কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতা এদেরকে ব্যবহার করছেন। যেহেতু কমিটিতে পদ-পদবি পেতে সাবেকদের সুপারিশ লাগে; ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ‘বড় ভাইদের’ নির্দেশ মানতে বাধ্য হন।’

অপকর্মের সঙ্গে ছাত্রলীগ সম্পৃক্ত নয় বলে দাবি করেছেন মদন মোহন কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি এ.কে.এম মাহমুদুল হাসান সানিও। তিনি বলেন, ‘ছাত্রলীগ অপকর্মকারীদের প্রশ্রয় দেয় না। এরা ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে অপকর্ম করছে। প্রশাসন শক্ত থাকলে তাদের পক্ষে এগুলো করা সম্ভব হতো না।’

এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে ধর্ষণের ঘটনার জন্যেও তিনি কলেজ প্রশাসনকে দায়ী করেন। 

সিলেটে ছাত্রলীগে গ্রুপিং রয়েছে বলে স্বীকার করে মাহমুদুল হাসান সানি বলেন, ‘ছাত্রলীগ স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। তাদেরকে সব সময় আওয়ামী লীগের নেতাদের ছায়ায় থাকতে হয়।’

বিএ-০৫