আহমেদ নূর
অক্টোবর ১৯, ২০২০
০৬:৪১ পূর্বাহ্ন
আপডেট : অক্টোবর ২০, ২০২০
০৩:১৫ পূর্বাহ্ন
সেলিম ভাই অসুস্থ খবরটা শুনে বুকটা ধক করে উঠল। ফোন দিলাম তাঁকে। বললেন, ‘শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। চিকিৎসক করোনাভাইরাসের পরীক্ষাসহ বিভিন্ন পরীক্ষা দিয়েছেন।’ দিনটি ছিল ৩ অক্টোবর শনিবার। তাঁকে বললাম, ‘সিলেট উন্নয়ন পরিষদের সংবাদ সম্মেলন ৫ তারিখ ঠিক করেছিলাম। এটি পিছিয়ে দিই।’ বললেন, ‘না না, ওই তারিখই থাকুক। আমি আসতে না পারলেও তুমি তো আছো, অন্যরা আছেন।’ আমি বললাম, ‘এটা কী করে সম্ভব? আপনি আহ্বায়ক আর প্রথম সংবাদ সম্মেলন আপনাকে ছাড়া কী করে হয়?’ বললেন, ‘এখনও দুদিন বাকি আছে-সুস্থ হয়ে যাব।’ আমি বললাম, ‘না, পিছিয়ে দিচ্ছি।’ দুদিন পরই তাঁর শরীরের অবনতি হলো। হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। প্রথম দিকে কিছুটা আশঙ্কার কথা শুনলেও শেষ চার দিন তাঁর সুস্থ হয়ে উঠার ব্যাপারে আমরা সকলেই আশাবাদী হয়ে উঠি। কিন্তু শনিবার সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুনলাম সেলিম ভাইয়ের অবস্থা সংকটাপন্ন। আর রবিবার রাত ৯টার দিকে খবর পেলাম সেলিম ভাই আর নেই। আমাদের ছেড়ে তিনি চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে। বুকে একটা চাপ অনুভব করছি। স্বজন হারানোর বেদনার চাপ। এটা সে-ই বুঝে যে হারায়।
গতকাল সন্ধ্যায় তাপসদা (তাপস দাশ পুরকায়স্থ) ফোন দিয়ে জানালেন, সেলিম ভাইয়ের জন্য সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল ঢাকায় একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। তারচেয়েও আশার কথা, দুপুরে নাকি ভেন্টিলেশন ছাড়া তিনি ১০ মিনিটের মতো সময় স্বাভাবিক থাকতে পেরেছেন। এটা একটা আশাব্যঞ্জক লক্ষণ, এটিও তিনি বললেন। কিন্তু দু-ঘণ্টার মধ্যে তাঁর মৃত্যুর সংবাদ পাব-এমন কল্পনাও করতে পারিনি। কিন্তু এটাই সত্য; নির্মম সত্য।
আজিজ আহমদ সেলিম একজন নিষ্ঠাবান সাংবাদিক। সৎ, নির্লোভ, দায়িত্বশীল এবং আপাদমস্তক ভদ্রলোক বলতে যা বোঝায়, তিনি তা-ই। যেটি বিশ্বাস করতেন, সেটি বলতে কখনও কুণ্ঠাবোধ করেননি। তাঁকে নিয়ে লিখতে গিয়ে এখন ‘ছিলেন’ শব্দটি ব্যবহার করতে হচ্ছে। কিন্তু ‘তিনি ছিলেন’, এ শব্দটি লিখতে গিয়েও যে লিখতে পারছি না। কেন পারছি না সেটা আমার সহকর্মীরা কিংবা যাঁরা সেলিম ভাইকে কাছে থেকে দেখেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পারছেন।
সেলিম ভাইয়ের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। পেশাগত সম্পর্ক, ব্যক্তিগত সম্পর্ক। পেশাগতভাবে তিনি ছিলেন আমার অগ্রজ। বয়সেও তাই। কিন্তু তাঁর সঙ্গে ছিল আমার এক আত্মিক সম্পর্ক। আমাকে এত পছন্দ করতেন যে, আমি কিছু বললে সেটি তিনি অন্যভাবে মূল্যায়ন করতেন। এমনকি পেশাগত বৈরীসময়েও আমার অবস্থান তাঁর কাছে ছিল ঠিক আগের মতোই। সিলেটের সাংবাদিকতার স্মারক প্রতিষ্ঠান সিলেট প্রেসক্লাবে আমরা দীর্ঘদিন একসঙ্গে ছিলাম। সিলেট প্রেসক্লাবে তিনি থাকাবস্থায় শেষ দিন পর্যন্ত আমরা ছিলাম একই গ্রুপের অনুসারী। বিভিন্ন মেয়াদে প্রেসক্লাবের কোষাধ্যক্ষ, সাধারণ সম্পাদক এবং সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। একটি অশুভ চক্রান্তে মাঝখানে সিলেট প্রেসক্লাবকেন্দ্রিক আমাদের পথচলা বিঘিœত হলেও আমার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল আত্মার আত্মীয়ের মতো। তিনি আমাকে দেখতেন ছোটো ভাইয়ের মতো। আমার সম্পাদনায় যখন সিলেট মিরর পত্রিকার আত্মপ্রকাশের প্রস্তুতি চলছে, তখন সেলিম ভাই সবার আগে ফোন করে শুভকামনা জানিয়েছিলেন। এইতো সেদিনও সিলেট মিরর-এর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। নিজে একটি পত্রিকার (দৈনিক উত্তরপূর্ব) প্রধান সম্পাদক হওয়া সত্বেও সিলেট মিরর-এর প্রশংসা করতে কখনও কুণ্ঠাবোধ করেননি। আমার কাছে নয়-অন্য অনেকের কাছেই তিনি অবলীলায় তা বলে গেছেন। এটাই সেলিম ভাইয়ের বড়ো গুণ। এখানেই সেলিম ভাইয়ের সঙ্গে অন্যদের পার্থক্য।
সিলেট সবসময়ই বৈষম্যের শিকার হয়েছে। সেটা স্বাধীনতার আগ থেকেই এবং স্বাধীনতার পরেও। কখনও বেশি কখনও কিছুটা কম। কখনও প্রত্যক্ষভাবে. কখনও পরোক্ষভাবে। সিলেটবাসীর (বৃহত্তর সিলেট) ন্যায্য দাবি-দাওয়া উপেক্ষিত হয়েছে বার বার। অতিসম্প্রতিও আমরা লক্ষ করলাম একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। তাই সিলেটের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন নিশ্চিত করতে একটি প্ল্যাটফর্ম গঠনের তাগিদ অনুভব করলাম সবাই। দৈনিক উত্তরপূর্ব-এর প্রধান সম্পাদক হিসেবে তিনিই ডাক দিলেন ঐক্যবদ্ধ হওয়ার। জোরে আওয়াজ তোলার। আমরা একমত হলাম। গঠন করলাম একটি সংগঠন। নাম-‘সিলেট উন্নয়ন পরিষদ’। তাঁকেই আমরা সংগঠনের আহ্বায়ক করলাম। তাঁর নেতৃত্বে সংগঠনটি ইতোমেধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে। বর্তমান সরকারে থাকা বৃহত্তর সিলেটের ৫ জন মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে আমাদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরা হয়েছে। এর ফলও মিলেছে। অনেকগুলো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড যেগুলো থমকে গিয়েছিল, সেগুলো গতি পেয়েছে। সেলিম ভাইকে আমি বলেছিলাম, সিলেট উন্নয়ন পরিষদ একটি ‘থিঙ্ক ট্যাংক’ হিসেবে কাজ করবে। তিনি আমার সঙ্গে একমত হন। সেলিম ভাই সর্বশেষ গত ২৪ সেপ্টেম্বর আমার কার্যালয়ে (দৈনিক সিলেট মিরর) এসেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন তাপসদা। ব্যবসায়ী নেতা আব্দুল জব্বার জলিলও ছিলেন। সিলেট উন্নয়ন পরিষদের ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনা ঠিক কলেছিলাম আমরা। বেশ সুদূরপ্রসারী এবং কার্যকর পরিকল্পনা। ২৮ সেপ্টেম্বর আমরা উন্নয়ন পরিষদের সভায় মিলিত হই। সেলিম ভাই সভাপতিত্ব করেন। কিন্তু সেটাই যে ছিল সেলিম ভাইয়ের সঙ্গে শেষ সভা, তা কি আর জানতাম?
আমি সবসময়ই নিভৃতচারী মানুষ। সত্যি বলতে কী, সেলিম ভাই সিলেটের উন্নয়নে সবাইকে ডাক দিয়েছিলেন এবং এ সংগঠনের আহ্বায়ক হিসেবে তিনি থাকায়ই আমি নিশ্চিন্তচিত্তে সংগঠনটির সদস্যসচিবের দায়িত্ব নিয়েছিলাম। কিন্তু সেই সেলিম ভাই আর নেই। হুট করেই মাঝপথে তিনি চলে গেলেন। তাঁর মৃত্যু সংবাদ শুনে এখন একটিই কথা মনে হচ্ছে-কী হবে এখন?
কী এমন তাড়া ছিল সেলিম ভাই? এখনও তো আমাদের অনেক কাজ বাকি। শুরুর আগেই শেষ! আপনি এভাবে চলে যেতে পারলেন? মনে পড়ে, গত ৮ সেপ্টেম্বর আমরা একসঙ্গে ঢাকা গিয়েছি। রাতে এক রুমে দুজন থেকেছি। কত কথা, কত পরিকল্পনা। একসঙ্গে ঢাকা থেকে সিলেট ফিরেছি। এখন এসবের কী হবে সেলিম ভাই?
লেখক : সম্পাদক, সিলেট মিরর