অবশেষে দেশে ফিরলেন তাঁরা

নিজস্ব প্রতিবেদক


নভেম্বর ০৪, ২০২০
০১:৩৫ পূর্বাহ্ন


আপডেট : নভেম্বর ০৪, ২০২০
০১:৩৬ পূর্বাহ্ন



অবশেষে দেশে ফিরলেন তাঁরা

অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে ভারতে আটক হয়েছিলেন ৪২ বাংলাদেশি। এর মধ্যে বৃহত্তর সিলেটের ৬টি উপজেলার ৭ জন ব্যক্তিও রয়েছেন। দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া শেষে গতকাল তাঁদের বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন ঘটল।

কাজের সন্ধানে ত্রিশ বছর বয়সে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন এক যুবক। ঘরে তখন ছিলেন স্ত্রী আর দুই শিশু সন্তান। ত্রিশ বছর পর সেই যুবক এখন ষাট বছরের বয়োবৃদ্ধ। কাজের সন্ধানে ভারতে যাওয়ায় অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে মাঝখানের সময়টাতে ছিলেন ভারতের কারাগারে বন্দী। এতকাল পর তিনি ফিরে এলেন নিজ দেশে, ততদিনে তাঁর ৭ বছর বয়সী মেয়ে ৩৭ বছরের যুবতী আর ৫ বছর বয়সী ছেলে আমির হোসেন ৩৫ বছরের টগবগে যুবক। বাবার স্মৃতি যে ছেলের কাছে ছিল ঝাপসা, সেই ছেলে বহুকাল পর নিজের বাবাকে পেয়ে জড়িয়ে ধরে আবেগে আপ্লুত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। বাবাও ছেলেকে বুকে আগলে ধরে চোখের পানিতে একাকার করে দেন ছেলের পিঠ। এ দৃশ্য গতকাল সোমবার দুপুরের। 

ভারতের শিলচরের কারাগারে ত্রিশ বছর ধরে বন্দী অবস্থায় থেকে সদ্য মুক্তি পাওয়া এই ব্যক্তির নাম মো. মমতাজ মিয়া। তাঁর বাড়ি কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের ভানগাদ্দা গ্রামে। মমতাজ জানান, কাজের সন্ধানে তিনি ভারতে গিয়েছিলেন। অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন তিনি। এরপর ভারতের শিলচরের কারাগারে সাজা খাটেন। কিন্তু সাজার মেয়াদ শেষ হলেও স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকায় তিনি বাংলাদেশ ফিরতে পারছিলেন না। পরে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে হাইকমিশনের মাধ্যমে তিনি তাঁর নাম-পরিচয় দেওয়ার পর দেশের পরিবারের সদস্যরা তাঁর পরিচয় নিশ্চিত করেন। এরপরই তাঁকে দেশে ফেরানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। গতকাল বেলা পৌনে ৩টার দিকে ভারতের বিভিন্ন কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া আরও ৪১ জনের সঙ্গে তিনিও বিয়ানীবাজার উপজেলার শেওলা স্থলবন্দর দিয়ে দেশে ফেরেন। মুক্তি পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে সিলেটের ৬টি উপজেলার ৭ জন ব্যক্তিও রয়েছেন। 

বিয়ানীবাজার থানা পুলিশ ও শেওলা স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, গতকাল ভারতের করিমগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার প্রশান্ত দত্ত বিয়ানীবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিল্লোল রায় ও শেওলা স্থলবন্দরের অভিবাসন পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) আবুল কালামের কাছে ৪২ জন বাংলাদেশিকে হস্তান্তর করেন। এ সময় বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। এই বাংলাদেশিরা বিভিন্ন সময়ে ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে গ্রেপ্তার হয়ে সাজা ভোগ করেছেন। কিন্তু স্বজনদের খোঁজ না পাওয়ায় এতদিন ভারতে ৫টি ডিটেনশন ক্যাম্পে (ভারতে বিদেশিদের জন্য নির্ধারিত কারাগার) আটক ছিলেন। এই ৪২ জনের মধ্যে ৩টি পরিবারের ১২ জন সদস্য আছেন। তাদের মধ্যে একাধিক শিশুও কারাগারে ছিল মা-বাবার সঙ্গে। 

৪২ বাংলাদেশিকে হস্তান্তর করার পরপরই বিয়ানীবাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা কর্মকর্তা নয়ন কুমার মল্লিক তাঁদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং ভারতে করা করোনা পরীক্ষার সনদ দেখেন। বিয়ানীবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিল্লোল রায় জানান, যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া ও নিয়ম মেনে ৪২ বাংলাদেশিকে গ্রহণ করা হয়। এরপর তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মমতাজ ছাড়াও যে ৪১ জন বাংলাদেশি গতকাল দেশে ফিরেছেন, তারা হচ্ছেন, চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির উত্তর পানুয়া গ্রামের দেলোয়ার হোসেন ও আবু তাহের, জলন্তী গ্রামের মো. কামাল হোসেন, মোহাম্মদপুর গ্রামের মো. মনির হোসেন, ইসলামপুর গ্রামের মো. রুবেল হোসেন, হালুদিয়া গ্রামের আকরাম হোসেন, বাগেরহাটের তাজিনুর বেগম, বাবু পালন, রাজু হাওলাদার, সিলেটের জকিগঞ্জের আফতাব উদ্দিন ও শাহীন আহমেদ, কানাইঘাটের মো. মজির উদ্দিন, গোলাপগঞ্জের লায়েছ আহমেদ, ওসমানীনগরের নজির আহমেদ, মৌলভীবাজারে বড়লেখার দেলোয়ার হোসেন, রাজনগর চা-বাগানের রণবীর সিংহ, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের আজিজ মিয়া, গোপালগঞ্জের কাশিয়ানির মোশারফ মোল্লা, মাগুরার উজাগ্রামের মো. রুবেল শেখ, দিনাজপুর সদরের রহিম উদ্দিন, নেত্রকোণার কেন্দুয়ার মো. সাইদুর রহমান, নবাবগঞ্জের জলিল হোসেন, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের সুভাস চন্দ্র দাস, বগুড়ার আদমদিঘির মো. শহিদুল ইসলাম, গাজীপুরের শ্রীপুরের নুরুজ্জামান, পিরোজপুরের মাঠবাড়িয়ার জাহাঙ্গীর আলী, স্ত্রী আয়েশা বেগম, ছেলে মো. আরিফ, মেয়ে জান্নাতি আক্তার, পিরোজপুরের জিয়ানগরের জামাল ফারাজি, স্ত্রী শিমুল বেগম, মেয়ে সাবিনা আক্তার, ছেলে সাকিবুল ইসলাম, ভনারিয়ার হরিণপালা গ্রামের মো. মাসুম হাওলাদার, মিনারা বেগম, মো. মিজান, মাসুমা আক্তার, মাঠবাড়িয়ার দুলাল মিয়া হাওলাদার, ছেলে মো. হানিফ হাওলাদার, স্ত্রী হানুফা বেগম ও মেয়ে মরিয়ম আক্তার। 

মুক্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে মো. কামাল হোসেন, মো. আবু তাহের, মো. ময়নুল হোসেন, রুবেল হোসেন, আকরাম হোসেন ও দেলোয়ার হোসেনও রয়েছেন। তাঁদের বয়স ২০ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে। তাঁরা সবাই দালালদের খপ্পরে পড়ে ভারতে গিয়েছিলেন। দেলোয়ার জানান, প্রায় ২ বছর আগে দালালদের খপ্পরে পড়ে তিনি ভারতে গিয়েছিলেন। সে সময় দালালেরা তাঁকে ভারতে প্রচুর সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়েছিল। কিন্তু ভারতে যাওয়ার পরই তাঁকে সেখানকার পুলিশ অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে আটক করে। প্রায় ১৮ মাস কারাগারে থেকে তিনি গতকাল দেশে ফিরেছেন। এই ছয় তরুণ ছাড়া উন্নত সুযোগ-সুবিধার আশায় ৩টি পরিবারের ১২ জন সদস্য ভারতে পাড়ি জমিয়েছিলেন। গতকাল তাঁরা দেশে ফিরেছেন। দেশে ফেরার পর দীর্ঘকাল অদেখা স্বজন ও পরিবারের সদস্যদের দেখা পেয়ে তাঁরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। 

মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, তিনি ভারতের গৌহাটিতে এক স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে চেন্নাইয়ে যাওয়ার পথে ভুলে পাসপোর্ট ফেলে যান। পরে পুলিশ তাঁকে আটক করে কারাগারে দেন। প্রায় ২ বছর তিনি কারা ভোগ করেন। কারাগারে থাকার সময়ই তাঁর পাসপোর্টের মেয়াদও শেষ হয়ে যায়। দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া শেষে তিনি দেশে ফিরেছেন।

মুক্তি পাওয়াদের কয়েকজন স্বজন জানিয়েছেন, মৌলভীবাজারের বাসিন্দা সমাজকর্মী অমলেন্দু কুমার দাশের সুবাদে তাঁরা নিজেদের স্বজনদের খবর পেয়েছেন। অমলেন্দুই জানান, ভারতের বিভিন্ন জেলে বাংলাদেশিরা আটক আছেন। সাজার মেয়াদ শেষ হলেও তাঁরা নানা জটিলতায় দেশে ফিরতে পারছেন না। এ অবস্থায় অমলেন্দু ভারতের গৌহাটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনার শাহ মো. তানভীর মনসুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর সহায়তায় ভারতের ৫টি ডিটেনশন ক্যাম্প কোকরা ঝাড়, গোয়ালপাড়া, তেজপুর, জোরহাট ও শিলচরে গিয়ে বাংলাদেশি বন্দীদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করেন। এরপর তিনি দেশে ফিরে ওই বন্দীদের স্বজনদের খুঁজে বের করে ভারতে নিযুক্ত সহকারী হাইকমিশনারের মাধ্যমে বিভিন্ন আইনি প্রক্রিয়া শেষে তাঁদের দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। 

অমলেন্দু কুমার দাশ জানান, এর আগেও প্রচুরসংখ্যক বাংলাদেশিকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এবারই প্রথম এত বেশিসংখ্যক বাংলাদেশি দেশে প্রত্যাবর্তন করেছেন। তবে আরও প্রায় ৭০ জন বাংলাদেশি ভারতের বিভিন্ন কারাগারে বন্দী হিসেবে রয়েছেন বলে তিনি দাবি করেছেন।

অমলেন্দু বলেন, ‘ভারতে থাকা বন্দীদের স্বজনদের সন্ধান করেছি। তাঁদের ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগ নেব। কোনো কিছু পাওয়ার জন্য নয়, মনের তৃপ্তিতে বন্দীদের ফিরিয়ে আনছি।’

ভারত থেকে দেশে ফিরে মো. মমতাজ মিয়া বলেন, ‘আর পরিবারের সদস্যদের ছেড়ে কোথাও যাব না। বাকিটা জীবন তাঁদের সঙ্গেই কাটিয়ে দেব। পরিবার ছাড়া এতকাল কতটা কষ্টে আমার কেটেছে, তা কেবল আমিই জানি।’

বিএ-১০