১১ মাস ধরে বন্ধ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান

নিজস্ব প্রতিবেদক


নভেম্বর ৩০, ২০২০
০১:১৩ পূর্বাহ্ন


আপডেট : নভেম্বর ৩০, ২০২০
০১:১৬ পূর্বাহ্ন



১১ মাস ধরে বন্ধ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান
সিলেটে ৭ উপজেলায় নদী দখল

গোলাপগঞ্জ উপজেলার বুধবারীবাজার ইউনিয়নের চন্দরপুরে কুশিয়ারা নদীর তীরে গড়ে উঠা অবৈধ স্থাপনা।

সিলেট জেলার বিভিন্ন উপজেলায় নদী দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের ফলে অনেক ক্ষেত্রে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে। এতে নদী ভাঙ্গনও দেখা দিচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের সর্বশেষ প্রতিবেদনে জেলার ৭টি উপজেলার অবৈধ স্থাপনা ও দখলদারদের চিহ্নিত করেছে। এতে উঠে এসেছে সিলেটে সুরমা, কুশিয়ারাসহ বিভিন্ন নদীর তীর দখলের চিত্র। সিলেট সদর ছাড়াও জেলার পাঁচটি উপজেলায় এই দুটি নদীর তীর ব্যাপক দখলদারিত্বে পড়ছে। 

এর মধ্যে বালাগঞ্জ উপজেলায় ২০, গোলাপগঞ্জে ২২, বিয়ানীবাজারে ৭, কানাইঘাটে ৬৮ এবং জকিগঞ্জ জেলায় ১১ জন দখলদারের নাম রয়েছে। তবে প্রকৃতি চিত্র এর চেয়ে আরো ভয়াবহ বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এসব উপজেলার মধ্যে শুধুমাত্র জকিগঞ্জ উপজেলায় গত বছরের ২৩ ডিসেম্বরে অবৈধ দখল উচ্ছেদে অভিযান চালানো হয়। কিন্তু ১১ মাস পার হলেও বাকি উপজেলা গুলোতে এখনও অভিযান চালানো হয়নি। 

জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর সারাদেশে একযোগে নদী তীরের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে অভিযান হলে জকিগঞ্জ উপজেলায়ও এদিন অভিযান চালানো হয়। পাউবোর প্রতিবেদন অনুযায়ী উপজেলায় সুরমা নদীর ৯০ মিটার জায়গা দখল করে ১১টি অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। এসব অবৈধ স্থাপনায় দোকানকোঠা তৈরি করে চাউলের আড়ৎ, মাইকের দোকান, কাপড়, জুতার দোকান, সেলুন, ফার্ণিচার, স্বর্ণের দোকান, ফাস্টফুডের দোকান, মাংসের দোকান খোলা হয়েছে। এসব দোকানের দখলদারদের নামও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। তবে জকিগঞ্জে প্রতিবেদনে উল্লেখের চেয়েও অনেক বেশি নদী তীর দখল হয়েছে বলে স্থানীয়রা দাবি করেছেন। স্থানীয়দের দাবির প্রমাণ মিলেছে গত মাসে চালানো অভিযানের সময়। গত ২৩ ডিসেম্বরের অভিযানে জকিগঞ্জে পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গায় আটগ্রাম বাজারে সুরমা নদীর তীরের ৬৩ টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। 

অভিযান শেষে ঘোষণা দেওয়া হয় কোনোভাবেই সেখানে পুনরায় কোন অবৈধ স্থাপনা করতে দেওয়া হবে না। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হুঁশিয়ারি উপেক্ষো করে দখলমুক্ত হওয়া অনেক জায়গায়ই আবারো অবৈধ স্থাপনা বসিয়ে ব্যবসা শুরু হয়েছে। এরমধ্যে স্থানীয় সাবু আহমদ, নজরুল ইসলাম, সায়াদ উদ্দিন, কবির আহমদসহ অনেকে নদী তীরের জায়গায় অবৈধ স্থাপনা গড়ে ব্যবসা করছেন। পাশাপাশি আরো অন্তত ৪টি দোকান নির্মাণের প্রস্তুতি চলছে নদীর তীর দখল করে। 

এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের একজন উপসহকারী প্রকৌশলী বলেন, ‘যারা অবৈধভাবে সরকারি জায়গা দখল করে নদী তীরে স্থাপনা করছেন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

জকিগঞ্জ উপজেলায় অভিযান হলেও গোলাপগঞ্জ উপজেলায় এখনও অভিযান হয়নি। পাউবোর প্রতিবেদন অনুযায়ী এই উপজেলায় ২২ জন দখলদার কুশিয়ারা নদী তীরে ২৪টি অবৈধ স্থাপনা গড়ে তুলেছেন। তবে স্থানীরা বলছেন অবৈধ স্থাপনার প্রকৃতি সংখ্যা আরো বেশি হবে। উপজেলার বুধবারীবাজার ইউনিয়নের কুশিয়ারা নদী পাড় দখল করে গড়ে উঠেছে অসংখ্য অবৈধ স্থাপনা। সুনামপুর-চন্দরপুর ব্রীজের পূর্ব দিকের চন্দরপুর অংশে গড়ে উঠা বাজারে বছরের পর বছর ধরে দোকানকোটাসহ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেছে ব্যবসা চালাচ্ছেন ও ভাড়া দিচ্ছেন দখলদাররা। বিভিন্ন সময়ে একাধিকবার উচ্ছেদ অভিযান হলেও উপজেলার বুধবারীবাজার ইউনিয়নের চন্দরপুর এলাকায় কুশিয়ার নদী তীরে দখলদাররা পুনরায় অবৈধ স্থাপনা উঠিয়ে বহাল তবিয়তে আছেন। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসব জায়গায় দখলদাররা মার্কেট, পোলট্রি খামার, রেস্তোরা, ফার্মেসীসহ বিভিন্ন ধরণের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। এসব প্রতিষ্ঠান নদীর উপর নির্মিত হওয়ায় স্বাভাবিক গতিপথ বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে। বেশি দখলের শিকার কানাইঘাট উপজেলার সুরমা নদী। নদীর প্রায় ১ হাজার ১৪০ মিটার জায়গায় গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা। বাউবোর তালিকা অনুয়ায়ী এসব স্থানে ৮৫টি অবৈধ স্থাপনা তৈরি করেছেন ৬৮ জন দখলদার। তবে প্রকৃতি সংখ্যা এই উপজেলায়ও অনেক বেশি বলেই স্থানীয়রা জানিয়েছেন। কাঁচা, আধা পাকা ও টিনশেডের এসব স্থাপনায় কাঠের দোকান, ফার্ণিচার, চালের আড়ৎ, পোল্ট্রিফার্ম, ফার্ণিচার, মিষ্টির দোকান, হোটেল, স্নেক্সবার, ভাঙ্গারী, কামার, ওয়ার্কশপ, সেলুন, হোটেলসহ বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। দখলদাররা নিজেরা আবার অনেকে দখল করে ভাড়া দিয়ে মাসোহারা নিচ্ছেন। এ উপজেলায় দখলদারদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা রয়েছে পাউবোর প্রতিবেদনে। 

পাউবোর প্রতিবেদন অনুযায়ী সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলায় কুশিয়ারা নদী তীরের ১৫০ মিটার জায়গায় অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। এর মধ্যে ২০ অবৈধ স্থাপনা তৈরি করে তাতে ফর্মেসী, হোটেল, মোবাইলের দোকান, রাইস মিল গুদামসহ বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব অবৈধ স্থাপনার দখলদার হিসেবে রয়েছে বালাগঞ্জের মো. কামাল মিয়া, আনোয়ার মিয়া, মতি মিয়া, নুর মিয়া, ইব্রাহিম মিয়া, মতিন মিয়া, ও মকসুদ মিয়ার নাম। রাজনগর এলাকায় সন্তর মিয়া, নিপু, পলঙ্গ বাবু, আকমল, আব্দুল কালাম মিয়া, লিয়াকত মিয়া ও তৈয়ব আলীর নাম রয়েছে। এছাড়া অবৈধ স্থাপনা বানিয়ে রাইসমিল বসিয়েছেন বালাগঞ্জের ইমরান মিয়া। এছাড়াও তিনটি স্থাপনার দখলদারের নামের জায়গায় অজ্ঞাতনামা উল্লেখ রয়েছে। 

জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলায় সবচেয়ে কম অবৈধ স্থাপনার উল্লেখ রয়েছে। এখানে কুশিয়ারা নদীর তীরে মাত্র ৭টি অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। আধাপাকা ও টিনশেডের এসব অবৈধ স্থাপনায় মুদির দোকান, ইলেকট্রিক সামগ্রী, পানের দোকান, সেলুন, হোটেল ও স্টেশনারী সামগ্রীর দোকান রয়েছে। মূলত উপজেলার ফাড়ীরবাজার ও কুড়ারবাজার এলাকায় দখল হয়েছে কুশিয়ারর তীর। এরমধ্যে ফাড়ীরবাজার এলাকায় আলীম উদ্দিন, বাধাই মিয়া, বাচ্চু মিয়া, কুতুব আলী, হোসেন মিয়া শংকর এবং কুড়ারবাজার এলাকায় বাহার মিয়া ও আব্দুস শুকুর এসব স্থাপনার দখলদার। 

পানি উন্নয়ন বোর্ডের সর্বশেষ প্রতিবেদনের তুলনায় অবৈধ স্থাপনার সংখ্যা বেশি থাকার বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ শহীদুজ্জামান সরকার বলেন, ‘প্রকৃত তালিকা এরচেয়েও বেশি সন্দেহ নেই। কারণ এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। তথ্য আপডেট করতে আমাদের কাজ চলমান রয়েছে।’ উচ্ছেদকৃত অনেক জায়গায় আবার নতুন করে দখল হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কিছু কিছু জায়গায় পুনরায় দখল হচ্ছে। বিষয়টি আমাদের নোটিসে আছে। যেকোন সময় সেগুলো আবার উচ্ছেদ করা হবে।’ উচ্ছেদ শুরু হওয়ায় এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘মানুষ এখন বুঝে গেছে যে দখল করা জায়গা সে শেষপর্যন্ত রাখতে পারবে না। আজ হোক কাল হোক তাকে সরতে হবেই। ফলে আমাদের কাজ আগের চেয়ে সহজ হয়েছে।’

জেএসএস/বিএ-০৩