নতুন দিনের শুরু

সিলেট মিরর ডেস্ক


জানুয়ারি ২১, ২০২১
১২:২৭ পূর্বাহ্ন


আপডেট : জানুয়ারি ২১, ২০২১
০৪:২৮ পূর্বাহ্ন



নতুন দিনের শুরু

মাত্র ৩০ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বকনিষ্ঠ সিনেটর নির্বাচিত হওয়া জো বাইডেনের ট্র্যাজেডিময় এক জীবনের বহুল আকাঙ্ক্ষিত এক অধ্যায়ের যাত্রা শুরু হলো। করোনাভাইরাস মহামারিতে বিপর্যস্ত দেশের চালকের আসনে বসার এই যাত্রায় আমেরিকার হারানো বিশ্বাস আর আস্থা ফেরানোর পাহাড়সম এক চ্যালেঞ্জ প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সামনে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেনের লক্ষ্য আকাশচুম্বী হলেও সেটি অর্জন যে ততটা সহজ হবে না; বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট আপাতত তাই বলছে।

বিশ্বের শীর্ষ ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের মসনদে বসার অনুষ্ঠান সাধারণত জমকালো হলেও এবারে সেই চিত্র একেবারে ভিন্ন। করোনাভাইরাস মহামারিতে বিপর্যয়কর এক পরিস্থিতি, ট্রাম্প আমলের হটকারী নীতি আর ট্রাম্পের উগ্রপন্থী সমর্থকদের সহিংসতার আশঙ্কায় হাজার হাজার সৈন্যের উপস্থিতিতে সামরিক ঘাঁটিতে রূপ নেয়া ওয়াশিংটনের কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটল হিলের পেছনে সুউচ্চ মঞ্চে বুধবার বাংলাদেশ সময় রাত ১০টা ৫০ মিনিটে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্টের শপথ নেন জো বাইডেন এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস।

প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেশটির সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সোনিয়া সোটোমায়ারের কাছে শপথ নেন কমলা হ্যারিস। যুক্তরাষ্ট্রে ইতিহাসে প্রথম নারী, প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ এবং প্রথম দক্ষিণ এশীয় হিসেবে দেশটির ডেমোক্র্যাট দলীয় এই রাজনীতিক হোয়াইট হাউসের দ্বিতীয় প্রধানের দায়িত্ব নেন।

শৈশবে তোতলামির কারণে স্কুলে বন্ধু ও সহপাঠীদের কাছে হাসি-ঠাট্টার পাত্র, পারিবারিক নানা ট্র্যাজেডি, তরুণ বয়সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে চাওয়ার জেদ চেপে রাখা জো বাইডেন প্রথমবার একজনের বক্তৃতা চুরির দায়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী দৌড় থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে। 

শপথ নিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেয়া বেশিরভাগ নীতিমালা বাতিলে নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেন নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। 

শুধু কি তাই, যুক্তরাষ্ট্রের দেড়শ বছরের ইতিহাসে প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে উত্তরসূরীর অভিষেক অনুষ্ঠানেও উপস্থিত থাকেননি ট্রাম্প। বিদায়ী ভাষণে নির্বাচিত হওয়ার আগে যা করতে চেয়েছিলেন; তা সফলভাবে করতে পেরেছেন বলে বগল বাজালেও জো বাইডেনের নাম একবারের জন্য উচ্চারণ করেননি ট্রাম্প।

স্থানীয় সময় বুধবার সকাল ৮টায় হোয়াইট হাউস ছেড়ে ফ্লোরিডার পাম বিচে নিজের বিলাসবহুল রিসোর্ট মার-আ-লাগোতে যান তিনি। তার আগে মেরিল্যান্ডের জয়েন্ট বেইজ অ্যান্ড্রুতে যাত্রাবিরতি করে আগত সমর্থকদের উদ্দেশে ট্রাম্প বলেন, ‌‌‘আমি সবসময় আপনাদের জন্য লড়াই করবো। আমি আপনাদের দেখবো, আপনাদের কথা শুনবো। এবং আমি আপনাদের বলছি, এই দেশের ভবিষ্যৎ কখনই এর চেয়ে ভালো হবে না। তবে আমি নতুন প্রশাসনের জন্য সফলতা কামনা করছি।’

 

লড়াকু বাইডেন

৭৮ বছর বয়সে শৈশবের স্বপ্নকে হাতের মুঠোয় পুরেছেন জো বাইডেন। তার এই স্বপ্ন পূরণের পথ ছিল কণ্টকাকীর্ণ। জীবনে একাধিকবার ঘনিষ্ঠ প্রিয়জনদের অকালমৃত্যুর স্বাক্ষী হয়েছেন তিনি। রাজনৈতিক জীবনে ওপরে ওঠার উচ্চাকাঙ্ক্ষার সিঁড়ি ভেঙেছে বারবার। ধ্বংসস্তুপ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আবারও লড়াই শুরু করেছেন তিনি।

ছোট্টবেলায় তোতলামোর কারণে বন্ধু সহপাঠীরা প্রায়ই তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করতেন। কথা বলতে গিয়ে অনেক সময় অপ্রাসঙ্গিক শব্দ মুখ ফসকে বেরিয়ে আসতো। বাকপটু হওয়ার জন্য চরম লড়াই করে আসা জো বাইডেন প্রায়ই বলেন, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা বাবার একটি কথা। 

১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বর এক নির্মম ট্র্যাজেডি নেমে আসে বাইডেনের জীবনে। ওয়াশিংটনে থাকা বাইডেনকে সেদিন টেলিফোন করেন ভাই জিমি বাইডেন। টেলিফোন হাতে নিতেই বোন ভ্যালেরি জানালেন, ছোট্ট এক দুর্ঘটনা সব তছনছ করে দিয়েছে। কিন্তু চিন্তা করে কিছুই হবে না।

কিছুক্ষণ পর বাইডেনকে জানানো হয় এক সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রী নেইলিয়া এবং শিশুসন্তান নাওমি বাইডেন মারা গেছেন। ক্রিসমাসের কেনাকাটা করতে বেরিয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে তাদের গাড়ি। লরির ধাক্কায় নেইলিয়া ও নাওমি মারা গেলেও প্রাণে বেঁচে যান দুই ছেলে বোও ও হান্টার। তবে তারা গুরুতর আহত হয়েছিলেন। সবে সিনেটর নির্বাচিত হওয়ার পর কংগ্রেস অফিসের জন্য কর্মী নিয়োগের স্বাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলেন সেদিন। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা সব তছনছ করে দেয় বাইডেনের। 

এই দুর্ঘটনার পর রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে যাজক হওয়ার চিন্তা করেছিলেন। ত্রাসকবলিত এলাকাগুলোতে সন্ধ্যাবেলা ঘুরে বেড়াতেন। বাজে ছেলেদের সঙ্গে মারপিটে জড়ানোর ইচ্ছা হতো উল্লেখ করে স্মৃতিকথায় লিখেছেন, আমার ভেতরে বিরাট ক্রোধ জন্ম নিয়েছিল। আমার মনে হতো, সৃষ্টিকর্তা আমার সঙ্গে নির্মম এক খেলা খেলছেন।

 

রাজনীতিতে পা

নেইলিয়া হান্টারের সাথে বাইডেনের পরিচয় ঘটে কলেজে পড়াশোনা করার সময়। শিক্ষাজীবনের পাঠ চুকিয়ে নিজের শহর ডেলাওয়ারের উইলমিংটন ফিরে যান তিনি। নিজের বেড়ে ওঠা শহরেই শুরু হয় রাজনৈতিক জীবন। শহরের একটি আইনী প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে গিয়ে প্রতাপশালীদের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। সাধারণ মানুষের হয়ে আইনি লড়াইয়ে নামেন তিনি। পরে নগর পরিষদের একটি আসনে নির্বাচিত হয়ে রাজনৈতিক পথচলা শুরু হয় তার। 

১৯৭২ সালে মাত্র ৩০ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বকনিষ্ঠ সিনেটর নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস গড়েন জো বাইডেন। একেবারে তরুণ জো বাইডেন রিপাবলিকানের দুই মেয়াদের এক সিনেটরকে হারিয়ে নজর কাড়েন সবার। 

 

এক নির্মমতার মুখোমুখি জো

১৯৭২ সালে দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিলেন বো বাইডেন। সেবার রক্ষা পেলেও বাইডেনের এই ছেলে ২০১৫ সালে মস্তিষ্কের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ডেলাওয়ারের অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে কর্মরত বো বাইডেন রাজনীতিতেও সরব ছিলেন।

ছেলের এই মৃত্যুর কারণে ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী দৌড়ে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটেন জো বাইডেন। সেই স্মৃতি লিখতে গিয়ে বলেছেন, মানসিকভাবে যথেষ্ট উৎসাহ পাবো কিনা, সেটি নিয়ে আমি নিশ্চিত ছিলাম না। কারণ শোক এমন এক মানসিক চাপ যা কোনও কাজের সময়ের তোয়াক্কা করে না। জীবনের নানা সময়ে এমন অভিজ্ঞতা বাইডেনকে রাজনীতির মঞ্চে পোক্ত করে তোলে।

 

হোয়াইট হাউসের দৌড়

১৯৮৭ সালে হোয়াইট হাউসের দৌড়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দেয়ার পর সরে দাঁড়ান জো বাইডেন। নির্বাচনের মাত্র তিন মাস আগে প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে বাইডেন বলেন, আমি নিজে এজন্য দায়ী। রাগ আর হতাশায় ভুগছি। আমেরিকার মানুষকে আমি কীভাবে বোঝাবো এটাই জো বাইডেনের আসল পরিচয় নয়। এটা শুধু আমার মস্ত একটা ভুল। 

আইওয়ায় এক বিতর্ক সভায় সমাপনী ভাষণে বাইডেন যে কথাগুলো বলেছিলেন, তা ছিল ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতা নিল কিনকের একটি ভাষণের প্রতিটি শব্দের হুবহু উচ্চারণ। কিনক তার শ্রমিক পরিবারে বড় হয়ে ওঠা নিয়ে তার ভাষণে যা বলেছিলেন তা প্রায় হুবহু আওড়ে যান বাইডেন।

এর আগের এক ভাষণে একই বক্তব্য প্রসঙ্গে তিনি কিনকের নাম উল্লেখ করলেও আইওয়ার সভায় সে কথা বলেননি। তারই এক ডেমোক্র্যাট প্রতিপক্ষ বিষয়টি সামনে আনেন। এই অভিযোগের সূত্র ধরে সামনে আনা হয় তার ছাত্র জীবনের একটি ঘটনা, যখন তিনি আইনের ছাত্র হিসাবে তার সাইটেশন পেপারে আরেকজনের লেখা হুবহু ব্যবহার করেছিলেন। তিনি তখন বলেছিলেন সেটা যে নিয়ম বহির্ভূত তা তিনি জানতেন না।

এই ঘটনা বাইডেনের সততা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বড় রকমের ধাক্কা খায়। পরে তার এক জীবনীকারকে বাইডেন বলেছিলেন, ওই ঘটনা তাকে কুরে কুরে খেয়েছে। নিজেকে আমি চিরকাল একজন সৎ মানুষ হিসাবে মনে করেছি। সেই জায়গাটা বিরাট ধাক্কা খেয়েছে।

 

ফের লড়াই

বিশ বছর পর আবার নতুন করে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হওয়ার লড়াইয়ে নেমেছিলেন বাইডেন ২০০৮ সালে। তখন তিনি রাজনীতিতে আর নতুন হলেও একজন প্রবীণ রাজনীতিক ছিলেন। তিনি বলেন, ১৯৮৭ সালে তার প্রচারণা ছিল বড় বড় বুলি আর ছবিতে ভরা। বিশ বছর পর তিনি তার প্রচারণার ভাষা বদলে ফেলেন।

বলেন, গত বিশ বছর আমার জীবনযাত্রা দেখে আপনাদের নিশ্চয়ই বিশ্বাস জন্মেছে যে আমি একজন বিশ্বাসযোগ্য মানুষ। আর সে কারণেই আবার এই পদে প্রার্থী হওয়ার লড়াইয়ে আমি ফিরে এসেছি। তবে সেই লড়াইয়ে তিনি সফল হননি। বারাক ওবামা ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মনোনয়ন পান প্রেসিডেন্ট পদে লড়ার জন্য।

কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে বারাক ওবামা তার ভাইস প্রেসিডেন্ট রানিং মেট হিসাবে বেছে নেন জো বাইডেনকে। সাংবাদিক ও ভাইস-প্রেসিডেন্সি বইয়ের লেখিকা কেট অ্যান্ডারসন ব্রাওয়ার বলেন, তারা দু’জনে খুবই আলাদা প্রকৃতির মানুষ। ওবামা খুব সতর্কতার সাথে কথা বলেন, খুব ভাবনা চিন্তা করে মন্তব্য করেন। কিন্তু বাইডেন একেবারে উল্টো। না ভেবেই হুটহাট কথা বলা তার স্বভাব, যে কারণে অনেকবার তাকে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। বাইডেন ওবামাকে বলেছিলেন, তিনি বদলাবেন না আমি যেমন আমি তেমনই থাকব।

 

সূত্র: বিবিসি, সিএনএন, নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট

 

এএফ/