জিয়াউল হক জিয়া, কুলাউড়া
ফেব্রুয়ারি ০১, ২০২১
১২:০৭ পূর্বাহ্ন
আপডেট : ফেব্রুয়ারি ০১, ২০২১
০১:৫৬ পূর্বাহ্ন
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলায় ফানাই নদীর খনন কাজে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ করেছেন নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষ। কাজের দায়িত্বে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজনের স্বেচ্ছাচারিতা ও অনৈতিক ফায়দা হাসিলের অপচেষ্টায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শতাধিক ঘরবাড়ি। রক্ষা পাচ্ছে না মসজিদ, মন্দির কিংবা কবরস্থান।
উপজেলার লংলা পাহাড় থেকে ফানাই নদীর উৎপত্তিস্থল হওয়ায় বর্ষায় নদীর পানির গতিপ্রবাহ থাকে বেশি। ফলে বর্ষা মৌসুমে প্রায় প্রতিবছর নদীর পানি উপচে উভয় তীরের ফসল ও বাড়িঘরের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। হাকালুকি হাওরের সঙ্গে মিলিত হওয়া নদীটিতে ২০১৯ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড খননসহ প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণে প্রকল্প গ্রহণ করে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদীটির খনন কাজ ও প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প শুরু হয়। এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ১৭ কোটি টাকা। হাকালুকি হাওর থেকে শুরু করে এই ৪০ কিলোমিটার উপজেলার ভুকশিমইল, কাদিপুর, ব্রাহ্মণবাজার, রাউৎগাঁও, কুলাউড়া সদর ও কর্মধা ইউনিয়ন দিয়ে নদীটির খনন কাজ গিয়ে শেষ হবে পাহাড়ি এলাকা মহিষমারায়।
সরেজমিনে পরিদর্শনে গিয়ে জানা যায়, ইতোমধ্যে নদীটির খনন কাজ ৪ ভাগের ৩ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। বড় বড় ইউটার্ন রেখে নদী খনন করা হচ্ছে, যা বর্ষা মৌসুমের শুরুতে পানির স্রোতে ভেঙে যাবে। ফলে বর্ষা মৌসুমে নদীভাঙন দেখা দেবে। তাছাড়া কাজ শেষ করে সামনে এগোনোর ৩-৪ দিনের মাথায় নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ নদীগর্ভে ধসে পড়ছে। রাউৎগাঁও, কুলাউড়া সদর ও কর্মধা উইনিয়নে কমপক্ষে ৮টি সেতু ঝুঁকির মুখে রয়েছে।
খনন কাজ রাউৎগাঁও ইউনিয়নে আসার পর খনন কাজে নিয়োজিত মাটি কাটার এক্সকেভেটরচালকরা জড়িয়ে পড়েন নানা অপকর্মে। নদী খনন করতে গিয়ে রাউৎগাঁও ইউনিয়নের চৌধুরী বাজার মুকুন্দপুর রাস্তার মরহুম ছলিম মিয়ার বাড়ির সম্মুখ থেকে ফানাই নদীর সেতু পর্যন্ত রাস্তা কেটে চলাচলের পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে চৌধুরী বাজারের সঙ্গে এ আঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ বিছিন্ন রয়েছে দেড় মাস ধরে। রাস্তাটি রক্ষা করে নদী খননের কাজ করার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বরাবরে লিখিত আবেদন দেওয়া হয় গত ২৪ ডিসেম্বর। কাজের ঠিকাদার ও সাইট ঠিকাদারকে বিষয়টি বলার পরও কোনো কাজ হয়নি।
গত শুক্রবার কর্মধা ইউনিয়নের হাসিমপুর-রাঙিছড়া রাস্তা এবং হাসিমপুর কবিরাজি ইট সলিং রাস্তাটিও কেটে সরানো হয়েছে। ফলে এই দু'টি রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী মানুষ চরম দুর্ভোগের শিকার হবেন। তাছাড়া এই রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে দু'টি প্রধান সড়কসহ ৫টি সংযোগ সড়ক বন্ধ করা হয়েছে। নদী খননের ফলে মুকুন্দপুর কোরআন শিক্ষাকেন্দ্র (স্থানীয়দের ভাষায় মক্তব), পূর্ব হাসিমপুর মসজিদ, পূর্ব হাসিমপুর কবরস্থান এবং পূর্ব কবিরাজি কালিমন্দির ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
রাউৎগাঁও ইউনিয়নের সদস্য মো. আনু মিয়া জানান, নদী খননের ফলে রাউৎগাঁও ইউনিয়নের বাগাজুরা, মুকুন্দপুর, গুতগুতি, কবিরাজি ও লক্ষীপুর গ্রামের শতাধিক পরিবার জমি হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া কমপক্ষে ১৫-২০টি পরিবার সম্পূর্ণরূপে বাড়িঘর হারিয়েছে। হাসিমপুর গ্রামের কনই বেগম, মুকুন্দপুর গ্রামের সুফিয়া বেগম, রাতিব মিয়া, রকিব মিয়া ও ছালেক মিয়া বলেন, আমরা বাপ-দাদার আমল থেকে বসবাস করে আসছি। আমাদের ভিটেমাটি সব চলে গেছে নদীগর্ভে। এখন আমরা কোথায় যাবো? মাথাগোঁজার কোনো ঠাঁই নেই।
কবিরাজি গ্রামের বিজয় মল্লিক, বিকাশ মল্লিক, গুতগুতি গ্রামের ইদরিছ মিয়া ও মঞ্চব মিয়া বলেন, নদী খননের ফলে আমরা ভূমিহীন হয়ে গেলাম। আমাদের বসতঘর, জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। আমরা গরিব মানুষ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে আমরা ক্ষতিপূরণ চাই। এছাড়া বিভিন্ন এলাকায় মানুষকে মাটিবন্দি করে রাখা হয়েছে। খনন কাজে নিয়োজিত লোকজন আমাদের কোনো কথা শুনছে না।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, অপরিকল্পিতভাবে খনন কাজের ফলে গাছ, বাঁশ, সবজি আবাদ নষ্ট করে দিচ্ছে। নদীর খনন কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা বিত্তবানদের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে নদীর গতিপথ পরিবর্তন করছে। ইচ্ছামতো খননকৃত মাটি ফেলা হচ্ছে, কাজের সঙ্গে ড্রেসিং না করায় শত শত পরিবার মাটিবন্দি। ঘর বাঁচিয়ে দেবে, জমি কম কাটবে এসব কথা বলে অনৈতিক ফায়দা নিয়ে পকেট ভারী করছে এসকেভেটরচালকরা।
জানা গেছে, রাস্তা, মসজিদ, কবরস্থান রক্ষাসহ বিভিন্ন দাবি নিয়ে উপজেলা নির্বাহী নির্বাহী কর্মকর্তা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে লিখিত আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত ২৭ জানুয়ারি পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী, কুলাউড়া উপজেলার চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এলাকা পরিদর্শন করে গেছেন। কিন্তু তাতে কোনো সুফল হয়নি।
এ ব্যাপারে মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক আক্তারুজ্জামান বলেন, 'কুলাউড়া উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এই নদীটির খনন কাজ কুলাউড়া উপজেলার চেয়ারম্যান ও ইউএনওসহ আমি সরেজমিনে পরিদর্শন করে এসেছি। কাজে কোথাও কোনো অনিয়ম হচ্ছে না। নদীর লোপ কাটিংয়ের কোনো সুয়োগ নেই। নদীর ভেতরে যাদের বাড়িঘর পড়েছে, তারা স্বেচ্ছায় সরে যাচ্ছে। তাছাড়া যারা দীর্ঘদিন থেকে দখল করে থাকে, তাদের ব্যাপারে আমাদের করার কিছু নেই। আমরা কাউকে উচ্ছেদ করছি না। কেউ ভিটেমাটিহারা হয়ে গেলে সরকারের গ্রহায়ণ প্রকল্পের ঘরের জন্য আবেদন করতে পারে।'
জেএইচ/আরআর-০১