টাকা দিলেই মিলছে সনদ!

সাইফুল্লাহ হাসান, মৌলভীবাজার


মার্চ ১৬, ২০২১
১১:২২ অপরাহ্ন


আপডেট : মার্চ ১৬, ২০২১
১১:২২ অপরাহ্ন



টাকা দিলেই মিলছে সনদ!
মৌলভীবাজার কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র

যারা কাজের জন্য দেশের বাইরে যাবেন, তাদেরকে প্রশিক্ষণ নিতে হবে। প্রশিক্ষণ শেষে শ্রমিকদের দেওয়া হবে সনদপত্র। সাধারণ নিয়ম এটাই। কিন্তু মৌলভীবাজার কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চলছে এ নিয়মের সম্পূর্ণ বিপরীতে। প্রশিক্ষণ না নিয়েই এই কেন্দ্র থেকে মিলছে সনদপত্র।

দেশের বাইরে গিয়ে শুরুতেই যেন রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের ধাক্কা খেতে না হয়, সেজন্য বাধ্যতামূলক কর্মশালার ব্যবস্থা করেছে সরকার। পুরুষ শ্রমিকদের ৩ দিনের আর নারীদের জন্য ৩০ দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বিদেশে গমনেচ্ছু শ্রমিকদের ওই দেশের ভাষা, আইন-কানুন, কাজের ধরন থেকে শুরু করে প্রাথমিক কিছু ধারণা দেওয়া হয় এ প্রশিক্ষণে। টাকার বিনিময়ে এই সনদ নিয়ে ইতোমধ্যে যারা বিদেশে গেছেন, তাদের অনেককেই বিপাকে পড়তে হয়েছে। আবার কেউ কেউ চাকরি হারিয়ে দেশেও ফিরেছেন। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, অফিসে দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের যোগসাজশে প্রতিনিয়ত দুই থেকে আড়াই হাজার টাকার বিনিময়ে প্রশিক্ষণ ছাড়াই এই (পুরুষ যাত্রীদের) সনদ বিক্রি হচ্ছে। রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের স্বজনরা বলেন, প্রশিক্ষণ না নেওয়ায় প্রবাসে গিয়ে তাদের হয়রানির শিকার হতে হয়। অনেকেই আবার চাকরি হারিয়েছেন।

মৌলভীবাজার কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সিলেট বিভাগের বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর, ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা, পুরো হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলা এবং ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার কয়েকটি উপজেলার বিদেশযাত্রীরা প্রশিক্ষণ নেন। করোনায় দীর্ঘদিন ভিসা প্রদান কার্যক্রম বন্ধ থাকার পর সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ওয়ার্ক পারমিটে লোক নেওয়া হচ্ছে। সেজন্য প্রতিনিয়ত ওই কেন্দ্রে প্রশিক্ষণার্থীদের ভিড় বাড়ছে।

মৌলভীবাজার কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেলে কথা হয় হবিগঞ্জ জেলার সিকন্দরপুর গ্রামের মো. মাসুদ মিয়ার ছেলে আব্দুল্লাহ মিয়া, বাহুবল উপজেলার পশ্চিম ভাদেশ্বর গ্রামের আনু মিয়া, উত্তর দৌলতপুর গ্রামের রুবেল মিয়া এবং চুনারুঘাটের গফুর মিয়ার ছেলে আব্দুল করিমের সঙ্গে। তারা সবাই জনপ্রতি ২ হাজার টাকা দিয়ে প্রশিক্ষণ সনদ কিনেছেন।

বিদেশযাত্রী কুলাউড়া উপজেলার ভুকশিমইল গ্রামের সৌদি আরব প্রবাসী ইসলাম উদ্দিন বলেন, '২ হাজার টাকা দিলে পুরুষ বিদেশযাত্রীদের প্রশিক্ষণ নিতে হয় না। ঘরে বসেই সনদ পাওয়া যায়।'

জুড়ী উপজেলার ময়না মিয়া, শ্রীমঙ্গলের রিয়াদ হোসেনসহ অনেকের সঙ্গে কথা হলে তারাও একই কথা বলেন।  

এদিকে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারী একাধিক প্রশিক্ষণার্থীর অভিযোগ, ২/৪ জন প্রশিক্ষণ নিলেও গল্প-গুজব ব্যতিত এখানে আর কিছুই শেখানো হয়নি। সবাই বসে আড্ডা দেয়। এখানে সময়ক্ষেপন ছাড়া কিছুই হয় না।

ভুক্তভোগীরা জানান, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বিদেশগামী শ্রমিকদের তিনদিনের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করলেও অনেকক্ষেত্রেই কর্মীকে কর্মশালায় অংশগ্রহণ না করিয়েই বিদেশে পাঠানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে ট্রেনিং সেন্টারে ভর্তির পর উপস্থিত দেখিয়ে টাকার বিনিময়ে সনদ দেওয়া হচ্ছে। মৌলভীবাজার টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের (টিটিসি) কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে রিক্রুটিং অ্যাজেন্সির মালিক তাদের মনোনীত দালালদের মাধ্যমে এসব সনদপত্র সংগ্রহ করে দিচ্ছেন।

এদিকে মৌলভীবাজার টিটিসিকে কেন্দ্র করে একটি দালাল চক্র গড়ে উঠেছে। টিটিসির সামনের বেশ কয়েকটি দোকান সনদ বিক্রি বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। পরিচয় গোপন রেখে মা লাইব্রেরি ও স্পোর্টস অ্যান্ড কম্পিউটার নামক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন, পুরুষের প্রশিক্ষণের জন্য ২ হাজার টাকা এবং নারীদের ১ মাসের প্রশিক্ষণের জন্য ১০ হাজার টাকা দিলে প্রশিক্ষণ ছাড়াই সনদ দেওয়া যাবে।

পরিচয় গোপন রেখে জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসে গেলে সেখানে অনেক বিদেশযাত্রীর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। এর মধ্যে দেখা যায় অনেকেই প্রশিক্ষণ না নিয়ে টাকার বিনিময়ে টিটিসি থেকে সনদ এনে ফিঙ্গার দিতে এসেছেন। 

পরিচয় গোপন রেখে মৌলভীবাজার কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কর্মচারী মিজানের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, 'সনদ নিতে প্রশিক্ষণ নিতে হবে না। পুরুষের ৩ দিনের প্রশিক্ষণের জন্য ২ হাজার টাকা ও নারীদের ১ মাসের প্রশিক্ষণের জন্য ১০ হাজার টাকা দিলেই সনদ পাওয়া যাবে। শুধু প্রয়োজনীয় কাগজ দিয়ে সনদ নিয়ে যাবেন। একদিনও আসতে হবে না।'

এ বিষয়ে মৌলভীবাজার কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অধ্যক্ষ শেখ মোহাম্মদ নাহিদ নিয়াজ বলেন, 'আমি ১২ দিনের প্রশিক্ষণে মৌলভীবাজারের বাইরে আছি। বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নই।'

এ রেওয়াজ তো ১২ দিন ধরে চলছে না, কয়েক বছর ধরে চলছে- এমন কথার জবাবে তিনি বলেন, 'তাহলে আমি অবগত ছিলাম না।'

 

এসএইচ/আরআর-০১