আগুনে পুড়েছে আবাসস্থল, দিশেহারা লাউয়াছড়ার প্রাণীরা

সজীব দেবরায়, কমলগঞ্জ


এপ্রিল ২৬, ২০২১
০১:৩৬ পূর্বাহ্ন


আপডেট : এপ্রিল ২৬, ২০২১
০১:৪২ পূর্বাহ্ন



আগুনে পুড়েছে আবাসস্থল, দিশেহারা লাউয়াছড়ার প্রাণীরা

অপরূপ সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত জীববৈচিত্র্যে ভরপুর লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। পর্যটনক্ষেত্রে বৃহত্তর সিলেট বিভাগের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। বাংলাদেশের সাতটি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও দশটি জাতীয় উদ্যানের মধ্যে লাউয়াছড়া অন্যতম। চিরহরিৎ এ বনাঞ্চল বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকের নিরাপদ আবাসস্থল। এছাড়াও নানা ধরনের দুর্লভ প্রাণী, কীটপতঙ্গ আর গাছপালার জন্য এ অরণ্য বিখ্যাত। এই বনে রয়েছে ৪৬০ প্রজাতির দুর্লভ বন্যপ্রাণী ও গাছপালা।

গতকাল শনিবার (২৪ এপ্রিল) দুপুর ১২টার দিকে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ৩ নম্বর গেট বাঘমারা ক্যাম্পের অধীনস্থ স্টুডেন্ট ডরমেটরির বিপরীতে চারাটিলা নামক স্থানে আকস্মিক আগুন লেগে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বনের প্রায় দেড় একর জায়গা পুড়ে যায়। আরও প্রায় দেড় একর এলাকাজুড়ে বিভিন্ন গাছপালা, বাঁশ ও বেত বাগানের ক্ষতি হয়। আড়াই ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। আগুনের লেলিহান শিখায় বন এলাকার অনেক ছোট-বড় গুল্ম ও গাছ পুড়ে যাওয়ায় তা জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। নষ্ট হয়েছে পাখির বাসাসহ বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। বনের এই অংশটিতে বন্য শুকর, বানর ও বিভিন্ন প্রজাতির সাপের নিরাপদ আবাসস্থল ছিল। গাছের ডালে ডালে ছিল পাখির বাসা। আকস্মিক আগুন যেন এলোমেলো করে দিয়েছে সবকিছু। বন্যপ্রাণীরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে তাদের আবাসস্থল। 

সরেজমিনে দেখা যায়, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান সংলগ্ন বনে হঠাৎ করে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডে বন এলাকার ছোট-বড় লতা-গুল্ম ও গাছ পুড়ে গেছে। আগুনে বনের প্রায় দেড় একর জায়গা পুড়ে ছাই। আরও প্রায় দেড় একর এলাকাজুড়ে বিভিন্ন গাছপালা, বাঁশ ও বেত বাগানের ক্ষতি হয়েছে। একদিকে পানির স্বল্পতা, অন্যদিকে বনের ভেতরে রাস্তা না থাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে অনেকটাই হিমশিম খান ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। তবে দীর্ঘ চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও পুড়ে যায় বন্যপ্রাণীদের আবাসস্থলের বেশ কিছু জায়গা। আগুনের ভয়ে দিগবিদিগ ছুটোছুটি করতে থাকে বন্যপ্রাণীরা। নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য কখনও এই ঝোপে, কখনও ওই ঝোপে ছুটোছুটি করছিল তারা। এ সময় দেখা যায়, একদল বন্য শুকর রাস্তার এপারের জঙ্গলে একবার ছুটে আসে, আবার রাস্তার অপর পাশের জঙ্গলে ছুটে যায়। তাদের এ অবস্থা দেখে বোঝা গেছে তারা কতটা নিরাপত্তহীনতায় ভুগছে। বন থেকে সরে গিয়ে বেশ কয়েকটি বানর পাশের হীড বাংলাদেশের একটি ভবনের ছাদে ও গাছে আশ্রয় নিয়েছে। আরও কয়েকটি বানর রাস্তার অপরপাশের জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে। কয়েকটি সাপও ছুটোছুটি করতে দেখা গেছে।

সপ্তাহ খানেক আগে উদ্যানের ফুলবাড়ি চা-বাগানের মুখেও অল্প পরিমাণ বনে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছিল। স্থানীয় কয়েকজন জানান, এর আগেও লাউয়াছড়া বনে আগুন লেগেছে। ঘন ঘন বনে আগুন লাগার উৎস অবিলম্বে খুঁজে বের করার আহ্বান জানান তারা। 

এ বিষয়ে কমলগঞ্জ উপজেলা জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটির সভাপতি মঞ্জুর আহমেদ আজাদ মান্না বলেন, ‘ডরমেটরি ও বাঘমারা ক্যাম্পের বিভিন্ন জায়গায় মাঝে মাঝেই আগুন লাগতে দেখা যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় ভূমিদস্যুরা আগুন লাগিয়ে বন উজাড় করে লেবু বাগান গড়ে তুলেছে। আজকের ঘটনা তারই প্রতিফলন। যতটুকু জানতে পেরেছি, সুফল প্রজেক্টের গাছের চারা রোপণের উদ্দেশে বনের এই অংশটা পরিষ্কার করার জন্য বন বিভাগ শ্রমিক নিয়োগ করেছিল এবং তখনই এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ দায় বন বিভাগ এড়াতে পারে না। এই অগ্নিকাণ্ডে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলও নষ্ট হয়েছে। আবাসস্থল ধ্বংস হওয়া বন্যপ্রাণীর জন্য সবচেয়ে বড় হুমকিগুলোর একটি। আর বন উজাড় করে বন সৃজনের এই চিন্তাটাই অদূরদর্শী।’

এ বিষয়ে মৌলভীবাজারের পরিবেশবাদী সাংবাদিক রিপন দে বলেন, ‘বনে আগুন লাগায় এখানে চতুর্দিকে ক্ষতি হয়েছে। এখানে থাকা সাপসহ বিভিন্ন প্রাণী যারা মাটির গর্তে বাসা বানায়, তাদের ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন পোকামাকড় ও পাখির বাসা নষ্ট হওয়া স্বাভাবিক। সেই সঙ্গে বৃষ্টি হওয়ায় এখানে কিছু উদ্ভিদের চারা অঙ্কুরিত হওয়ার যে সম্ভাবনা ছিল, তা নষ্ট হয়ে গেল। কারণ আগুনে বীজ জ্বলে গেছে। সবকিছুর শেষে ভয়ে বন্যপ্রাণীরা পালিয়ে গেছে, বিশেষ করে শুকরদের দৌড়াদৌড়ি করতে দেখা গেছে। ভয় পেয়ে পালিয়ে গেলে এই জায়গায় ফিরে আসতে কিছুটা সময় লাগবে।’ 

বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (বাপা) সিলেট বিভাগীয় সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম বলেন, 'প্রায় দেড় বছর আগে এবারের ঘটনাস্থলের কাছে লাউয়াছড়া বনে আগুন লেগেছিল। ওই ঘটনার কোনো তদন্ত হয়নি। এখন আবার আগুন লেগে বনের ক্ষতি হলো। এর দায় বন বিভাগকে নিতে হবে।'

এ ঘটনায় বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের পক্ষ থেকে দুই সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হলেন বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা মীর্জা মেহেদী সরওয়ার ও বন মামলা পরিচালক জুলহাস উদ্দিন। দুই দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে তাদের।

লাউয়াছড়া বনবিট কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, 'এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলে বিষয়টি জানা যাবে।' 

বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা মির্জা মেহেদি সরোয়ার বলেন, 'অগ্নিকাণ্ডের কারণ উদঘাটনে আমরা এরই মধ্যে তদন্ত শুরু করে দিয়েছি। দুইদিনের মধ্যে রিপোর্ট জমা দেব। তদন্ত কাজ চলছে। তদন্ত শেষে বিস্তারিত বলা যাবে।'

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, 'দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি মাঠে কাজ করছে। প্রকৃতভাবে কারা দায়ী তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আসার পর তা জানা যাবে। সে অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।'

 

এসডি/আর আর-০৭