ভোলাগঞ্জে পাথর লুটের মচ্ছব

কবির আহমদ, কোম্পানীগঞ্জ


মে ০৪, ২০২১
১১:২৬ অপরাহ্ন


আপডেট : মে ০৫, ২০২১
০২:৩৪ পূর্বাহ্ন



ভোলাগঞ্জে পাথর লুটের মচ্ছব

সিলেটের সবক'টি পাথর কোয়ারিসহ কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পাথর কোয়ারিগুলো থেকে উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় বন্ধ রয়েছে পাথর উত্তোলন। কিন্তু আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন চলছে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ সংরক্ষিত রোপওয়ে এলাকায়। অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের মচ্ছব চলছে সরকার নির্ধারিত সংরক্ষিত ওই এলাকায়। রোপওয়ের (বাংকার) নিরাপত্তাবাহিনী আরএনবি'র উপস্থিতিতে দিনে-রাতে প্রকাশ্যে চলছে পাথর লুটের ঘটনা।

সরেজমিনে গত রবিবার দুপুর ১২টায় রোপওয়ে বাংকার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, আরএনবি'র সদস্যদের উপস্থিতিতে দুই শতাধিক মানুষ পাথর উত্তোলন করে অর্ধশতাধিক নৌকার মাধ্যমে ধলাই নদী দিয়ে সেই পাথর পরিবহন করছে। 

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রোপওয়ের সংরক্ষিত এলাকা থেকে পাথর উত্তোলনের জন্যে আরএনবি'র কতিপয় দুর্নীতিবাজ সদস্যদের মদদে কালীবাড়ি গ্রামের বাবুল মিয়ার ছেলে রুবেল মিয়ার নেতৃত্বে প্রতিদিনই চলছে পাথর উত্তোলন। নৌকাপ্রতি পাথর উত্তোলনের জন্য রুবেলের মাধ্যমে আরএনবিকে দিতে হয় ২ হাজার টাকা। পাথর উত্তোলনের সময় রুবেল ছাড়াও থাকেন ধলাই নদীর পূর্বপাড়ে তার অন্যতম সহযোগী নাজিরগাঁওয়ের অফিক আহমদ ও ধলাই নদীর পশ্চিমপাড়ে পাড়ুয়া গ্রামের মৃত উছমান আলীর পুত্র মীর হোসেন। ভোলাগঞ্জ রোপওয়েতে পাথর লুটের সঙ্গে সরাসরি জড়িত তারা। আরএনবি'র ক্যাশিয়ার হিসেবে নদীতে এদের দৌড়াত্ম চলে। তাদের এসব কর্মকাণ্ডের কিছু অডিও এবং ভিডিও এই প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। এদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী কিছু নেতা। বিনিময়ে তারা পান মোটা অংকের ঘুষ।

অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের সময় প্রায়ই ঘটে দুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনায় হতাহতদের সংখ্যার হিসাব নেই কোথাও। গত ১৫ এপ্রিল ভোরে ভোলাগঞ্জ রোপওয়ের সংরক্ষিত এলাকা থেকে পাথর উত্তোলনকালে ঝড়ের কবলে পড়ে নৌকা উল্টে জহিরুল আলম (২৪) নামের এক শ্রমিক নিহতের ঘটনা ঘটে। তারপরও থেমে নেই পাথর উত্তোলনের মচ্ছব। নিহতের ঘটনার পরে দুই-তিন বন্ধ থাকলেও আবার চালু হয় পাথর উত্তোলন। ওই ঘটনায় নিহতের মা রিনা বেগম বাদী হয়ে রাসেল আহমদ, সাহাব উদ্দিন ও কেফায়াত উল্লাহকে আসামি করে কোম্পানীগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন (মামলা নম্বর- ১৫)। শ্রমিক নিহতের পর থেকেই আসামিরা পলাতক রয়েছে।

ওই শ্রমিক নিহতের ঘটনার রেশ কাটতে বা কাটতেই আবারও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে পাথরখেকো চক্র। এখন দিনের বেলাতেই চলছে পাথর লুটপাট। ছোট ছোট বারকি নৌকায় বোঝাই করে নদীরপাড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে লুটপাটকৃত পাথর। প্রতিটি বারকি নৌকা থেকে আদায় করা হয় দুই থেকে তিন হাজার টাকা। আর এসব অবৈধ টাকার বড় অংশটি আরএনবি'র কাছে গেলেও বিজিবি সদস্যদের পকেটেও যায় কিছু টাকা। বিনিময়ে রুবেল, মীর হোসেন ও অফিক আহমদ নৌকাপ্রতি ৫০০ টাকা পাচ্ছে। প্রতিদিন গড়ে শতাধিক নৌকা দিয়ে পাথর লুট করা হচ্ছে। কখনও কখনও স্থানীয় সংবাদকর্মীরা পাথর লুটপাটের তথ্য সংগ্রহ ও ছবি তুলতে গেলে তাদের হাতে লাঞ্ছিত হতে হয়। শ্রমিক নিহতের ৪ দিন আগে গত ১১ এপ্রিল বিকেলে ভোলাগঞ্জ রোপওয়েতে রুবেল গংদের পাথর লুটপাট ও চাঁদাবাজির তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে স্থানীয় সংবাদকর্মী আব্দুল জলিল ও ফখর উদ্দিনকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে হামলা ও আটকে রাখার অভিযোগ ওঠে তাদের বিরুদ্ধে।  

এ ব্যাপারে ভোলাগঞ্জ রোপওয়ের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আরএনবি'র ইনচার্জ তাজবির আহমদ আরএনবি সদস্যদের উপস্থিতিতে পাথর উত্তোলনের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, 'আমাদের সামনেই পাথর উত্তোলন হচ্ছে। কিন্তু আমাদের কিছু করার নেই।'

কিছু করার নেই কেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'বাংকারের চারপাশে পানি থাকে ১২ মাস। কিন্তু আমাদের কোনো নৌকা না থাকায় পাথরখেকোদের আটক করতে পারি না।'

চাঁদা আদায়ের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, 'রুবেল, মীর হোসেন ও অফিক নামের কাউকে চিনি না। তবে সাহাব উদ্দিন, রাসেল আহমদ ও কেফায়েত উল্লাহকে চিনি। গত বছর লকডাউনের সময় যখন রোপওয়ের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলাম, তখন তারা আমাদেরকে খরচপাতি দিয়েছে।'

এ ব্যাপারে কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কে এম নজরুল বলেন, 'কিছু পাথরখেকো পাথর উত্তোলনের চেষ্টা করছে। তবে কোম্পানীগঞ্জে কোনোভাবেই অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করতে দেওয়া হবে না। এসপি স্যারের নির্দেশনা রয়েছে পাথর উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। এমনকি যদি কোনো পুলিশ সদস্য জড়িত থাকে, তাহলে তাকেও ছাড় দেওয়া হবে না।'

 

এমকে/আরআর-০৪