দখলমুক্ত হয়নি বড়লেখার পানজুম, দুইজন গ্রেপ্তার

এ.জে লাভলু, বড়লেখা


জুন ০৩, ২০২১
১১:০১ অপরাহ্ন


আপডেট : জুন ০৩, ২০২১
১১:০১ অপরাহ্ন



দখলমুক্ত হয়নি বড়লেখার পানজুম, দুইজন গ্রেপ্তার

মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউনিয়নের বনাখলাপুঞ্জির পানজুম দখলের পর স্থানীয় একটি চক্র ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। জুম দখলের পর সেখানে তারা একটি ঘরও নির্মাণ করেছে। এক সপ্তাহের মধ্যে তাদের দাবিকৃত টাকা না দিলে খাসিয়াদের তারা জুমে প্রবেশ করতে দেবে না বলেও জানিয়ে দিয়েছে।

গত শুক্রবার (২৮ মে) সকালে বনাখলাপুঞ্জির জুম দখলের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় গত রবিবার (৩০ মে) পুঞ্জির নারী মান্ত্রী (পুঞ্জিপ্রধান) নরা ধার ও ছোটলেখা বাগানের প্রধান টিলা করণিক মো. দেওয়ান মাসুদ থানায় পৃথকভাবে দু'টি মামলা করেছেন।

পানজুম দখলের ঘটনায় পুলিশ দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছে। গতকাল বুধবার (২ জুন) দিবাগত রাত ৩টার দিকে বড়লেখা থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) রতন দেবনাথের নেতৃত্বে একদল পুলিশ উপজেলার উত্তর ডিমাই গ্রামে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে।  

গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- মুখলেছ আলী (৪০) ও মহরম আলী ওরফে কুটুন মিয়া (২২)। তারা দু'জন বড়লেখা সদর ইউনিয়নের উত্তর ডিমাই গ্রামের বাসিন্দা। 

আজ বৃহস্পতিবার (৩ জুন) বিকেলে গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বড়লেখা থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) রতন দেবনাথ। তিনি বলেন, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে।

এদিকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত পানজুম দখলমুক্ত হয়নি। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান গতকাল বুধবার ২৪ ঘন্টার মধ্যে দখলদারদের সরিয়ে নেওয়ার কথা জানালেও তিনি তা দখলমুক্ত করতে পারেননি। এতে ভয়ে জুমে প্রবেশ করতে পারছেণ না খাসিয়ারা। জুম থেকে পান তুলতে না পেরে তারা কষ্টে দিন পার করছেন।

পুলিশ জানিয়েছে, তারা দখল হওয়া বনাখলাপুঞ্জির পানজুম আইনি পক্রিয়ায় দখলমুক্তের পাশাপাশি জড়িতদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে। ইতোমধ্যে দুইজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া আগারপুঞ্জির খাসিয়াদের সহস্রাধিক পানগাছ কাটার ঘটনায় জড়িতদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ।  

পানজুম দখল ও পানগাছ কাটার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আদিবাসী নেতারা। তারা দ্রুত জুম দখলমুক্ত করে খাসিয়াদের বুঝিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য প্রশাসনের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন।

মামলার এজাহার, পুঞ্জির বাসিন্দা ও চা-বাগান কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউনিয়নের ছোটলেখা চা-বাগান কর্তৃপক্ষ চা চাষের জন্য ১ হাজার ৯৬৪ দশমিক ৫০ একর টিলাভূমি সরকারের কাছ থেকে ইজারা নেয়। পরে তারা ২৭২ একর জমি খাসিয়াদের কাছে উপ-ইজারা দেয়। ২০০৭ সালে খাসিয়ারা ওই জমিতে বনাখলাপুঞ্জি নামে বসতি স্থাপন করেন। এরপর সেখানে পান চাষ শুরু করেনন তারা। পুঞ্জিতে বর্তমানে প্রায় ৩৬টি খাসিয়া পরিবারের দেড় শতাধিক সদস্য থাকেন। প্রতিটি পরিবারের আলাদা পানের জুম আছে। গত ২৮ মে বোবারথল এলাকার আব্দুল বাছিত, পিচ্চি আমির, লেছই মিয়ার নেতৃত্বে ৪০-৫০ জনের একদল লোক দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পুঞ্জিতে ঢুকে তিনটি পানের জুম দখল করে নেন। এ সময় তারা সেখানে একটি অস্থায়ী ঘরও নির্মাণ করে। তখন জুমে থাকা খাসিয়াদের তারা তাড়িয়ে দিয়ে বলেন এক সপ্তাহের মধ্যে তাদেরকে ১০ লাখ চাঁদা না দিলে খাসিয়ারা জুমে প্রবেশ করতে পারবেন না। এ ঘটনায় গত ৩০ মে পুঞ্জির নারী মান্ত্রী (পুঞ্জি প্রধান) নরা ধার ও ছোটলেখা বাগানের প্রধান টিলা করণিক মো. দেওয়ান মাসুদ থানায় পৃথকভাবে দু'টি মামলা করেন।

অন্যদিকে বনাখলাপুঞ্জি ছাড়া দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউনিয়নের ছোটলেখা বাগানের আওতাধীন আগারপুঞ্জি নামের আরেকটি পুঞ্জির খাসিয়াদের সহস্রাধিক পানগাছ কেটে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। ধারণা করা হচ্ছে, গত শনিবার (২৯ মে) দিবাগত রাতের কোনো একসময় এ ঘটনাটি ঘটেছে। এ ঘটনায় গত সোমবার (৩১ মে) দুপুরে পুঞ্জির মান্ত্রী (পুঞ্জিপ্রধান) সুখমন আমসে বাদী হয়ে বড়লেখা থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন।

গত মঙ্গলবার (১ জুন) বিকেলে পুঞ্জির ৩৬টি খাসিয়া পরিবারের লোকজন জড়ো হন ছোটলেখা চা-বাগান ব্যবস্থাপকের বাংলোর সামনে। সেখানে তাদের সঙ্গে কথা বলেন মৌলভীবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (কুলাউড়া সার্কেল) সাদেক কাউসার দস্তগীর। তিনি দ্রুত তাদের জুম উদ্ধার ও দোষীদের আইনের আওতায় আনার আশ্বাস দেন। এ সময় বড়লেখার সহকারী কমিশনার (ভূমি) নূসরাত লায়লা নীরা, বড়লেখা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহাঙ্গীর হোসেন সরদার, পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) রতন দেবনাথ, দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সাহাব উদ্দিন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

বনাখলাপুঞ্জির নারী মান্ত্রী (পুঞ্জি প্রধান) নরা ধার বৃহস্পতিবার সকালে বলেন, আমরা নিরীহ মানুষ। পান চাষই আমাদের একমাত্র পেশা। পান চাষ করে আমরা সংসার চালাই। কিন্তু স্থানীয় সন্ত্রাসী আব্দুল বাছিত, পিচ্চি আমির, লেছই মিয়াসহ কয়েকজন আমাদের পানজুম দখল করে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছে। তারা আমাদের হুমকি-ধমকি দিয়ে বলেছে টাকা না দিলে আমাদের জুমে প্রবেশ করতে দেবে না। আমরা ভয়ে আছি। এ কারণে জুমে যেতে পারছি না। শুনেছি তারা আমাদের জুম থেকে পান তুলে নিচ্ছে। জুম উদ্ধার না হলে আমরা খাব কী? 

ছোটলেখা চা-বাগানের ব্যবস্থাপক শাকিল আহমদ মুঠোফোনে বলেন, খাসিয়ারা আমাদের কাছ থেকে টিলাভূমি উপ-ইজারা নিয়ে পান চাষ করছে। তাদের পানজুম দখল ও পানগাছ কাটার ঘটনায় আমরা থানায় মামলা করেছি। আমরা খাসিয়াদের পাশে রয়েছি।

এদিকে পানজুম দখল ও পুঞ্জির সহস্রারাধিক পানগাছ কেটে ফেলার ঘটনায় বুধবার (২ জুন) বিকেলে মৌলভীবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট ডাডলী ডেরিক প্রেন্টিস, বৃহত্তর সিলেট আদিবাসী ফোরামের মহাসচিব ফিলা পতমী, বাসদ মৌলভীবাজার জেলা শাখার সদস্য অ্যাডভোকেট মো. আবুল হাসান বনাখলাপুঞ্জি ও আগারপুঞ্জি পরিদর্শন করেছেন। তারা পুঞ্জি দু'টিতে ঘুরে মান্ত্রী (পুঞ্জিপ্রধান) ও খাসিয়া সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন।

মৌলভীবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট ডাডলী ডেরিক প্রেন্টিস বলেন, খাসিয়াদের পানজুম দখল ও পানগাছ কাটার ঘটনাগুলো ন্যাক্কারজনক ও দুঃখজনক। এ ঘটনার আমরা তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাই। একই সঙ্গে আমরা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার যেন আশু একটা সমাধান হয়। খাসিয়া সম্প্রদায় যেন নিরাপদে, নির্বিঘ্নে পান চাষ করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে পারে।

তিনি আরও বলেন, আদিবাসী খাসিয়ারা শুধু পান চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে না। তারা পরিবেশ রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একেকটা গাছ তারা সন্তানের মতো বড় করে। এরপর তারা সেই গাছে পান চাষ করে গাছ রক্ষায়, পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখে।

বৃহত্তর সিলেট আদিবাসী ফোরামের মহাসচিব ফিলা পতমী বলেন, গত তিন-চার মাস ধরে খাসিয়া জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সিরিজ সব ঘটনা ঘটছে। প্রশাসনের কাছে আমার একটা প্রশ্ন- শুধু আমরাই কেন টার্গেট হচ্ছি? কুলাউড়ায় অনেক ধরনের হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় সুষ্ঠু বিচার না হওয়ায় সিরিজ ঘটনা ঘটছে। আমি প্রশাসনকে বলতে চাই, এই ঘটনাগুলোর যদি সুষ্ঠু বিচার না হয় আমরা সকল সংগঠন এক সঙ্গে আন্দোলনে যাব।

বড়লেখা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহাঙ্গীর হোসেন সরদার বৃহস্পতিবার মুঠোফোনে বলেন, দখলদারদের অন্যত্র সরিয়ে নিতে স্থানীয় চেয়ারম্যান ২৪ ঘণ্টা সময় নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তাদের সরাতে পারেননি। এখন আমরা আইনি প্রক্রিয়ায় তাদের (পানজুম দখলকারীদের) উচ্ছেদ করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এ ঘটনায় দখলকারীদের মধ্যে দুইজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। খাসিয়াদের সর্বত্মক আইনি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

আগারপুঞ্জির পানগাছ কাটার ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। জড়িতদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খন্দকার মুদাচ্ছির বিন আলী বৃহস্পতিবার মুঠোফোনে বলেন, বনাখলাপুঞ্জি পানজুম গত কয়েকদিন ধরে দখল করে রেখেছে স্থানীয় কয়েকজন লোক। বিষয়টি জানার পর সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (কুলাউড়া সার্কেল) এবং বড়লেখা থানার ওসিসহ সেখানে গিয়ে খাসিয়াদের সঙ্গে কথা বলেছি। পাশাপাশি গত মঙ্গলবার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দখলদারদের সরে যেতে আল্টিমেটাম দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা (দখলদাররা) সরেনি। বিষয়টি জেলা প্রশাসক স্যার ও এসপি মহোদয়কে অবগত করা হয়েছে। পানজুম দখলমুক্ত করতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।


এজে/আরআর-০৪