সজীব দেবরায়, কমলগঞ্জ
জুন ১৪, ২০২১
১০:১৩ অপরাহ্ন
আপডেট : জুন ১৪, ২০২১
১০:৪২ অপরাহ্ন
আজ ১৪ জুন। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জবাসীর ভয়াল স্মৃতির দিন মাগুরছড়া ট্রাজেডির ২৪তম বার্ষিকী। ১৪ জুন এলেই মৌলভীবাজার জেলাবাসীর মনে পড়ে যায় সেই ভয়াল স্মৃতির কথা। সেদিন মানুষের মনে ভীষণ ভয় ছিল- কখন এসে আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করে ফেলবে তাদের!
১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মধ্যরাত ১টা ৪৫ মিনিটে মাগুরছড়া গ্যাস কূপে বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠেছিল গোটা কমলগঞ্জ। আগুনের লেলিহান শিখায় লাল হয়ে উঠেছিল মৌলভীবাজার জেলার সুনীল আকাশ। ভীত-সন্ত্রস্ত লোকজন ঘরের মালামাল রেখে প্রাণের ভয়ে ছুটেছিলেন দিগ্বিদিক। প্রায় ৫০০ ফুট উচ্চতায় লাফিয়ে ওঠা আগুনের লেলিহান শিখা লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল বিস্তীর্ণ এলাকা। আগুনের শিখায় গ্যাস ফিল্ড সংলগ্ন লাউয়াছড়া রিজার্ভ ফরেস্ট, মাগুরছড়া খাসিয়াপুঞ্জি, জীববৈচিত্র্য, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন, ফুলবাড়ী চা-বাগান, সিলেট-ঢাকা ও সিলেট- চট্টগ্রাম রেলপথ এবং কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল সড়কে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। ২৪ বছরেও জনসম্মুখে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা প্রকাশ হয়নি, আদায় হয়নি ক্ষতিপূরণ।
পরিবেশ সংরক্ষণবাদীদের তথ্যমতে, ওই বিস্ফোরণে ৬৩ প্রজাতির পশু-পাখির বিনাশ সাধন হয়। সিলেটের সঙ্গে সারাদেশের রেল যোগাযোগ ১৬৩ দিন বন্ধ থাকে। মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছিল ১৫ হাজার কোটি টাকা। মার্কিন কোম্পানি অক্সিডেন্টাল ক্ষয়ক্ষতির আংশিক পরিশোধ করলেও বন বিভাগ কোনো ক্ষতিপুরণ পায়নি। এখনও ফিরে আসেনি প্রাকৃতিক বনের স্বাভাবিক পরিবেশ। পূর্ণ ক্ষতিপূরণ না দিয়েই ইউনিকলের কাছে হস্তান্তরের পর সর্বশেষ শেভরনের কাছে বিক্রি করা হয়েছে ওই গ্যাসক্ষেত্র। শেভরন ২০০৮ সালে লাউয়াছড়ায় ত্রি-মাত্রিক ভূতাত্ত্বিক জরিপের কাজ সম্পন্ন করে। এতেও স্থানীয়ভাবে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
২০১২ সালে শেভরন মৌলভীবাজারের ১৪ নম্বর ব্লকের অধীনে নূরজাহান, ফুলবাড়ি এবং জাগছড়া চা-বাগানের সবুজ বেষ্টনি কেটে কূপ খননের পর এসব কূপ থেকে চা-বাগানের ভেতর দিয়ে খাল খনন করে পাইপ লাইনের মাধ্যমে উত্তোলিত গ্যাস কালাছড়ার মাধ্যমে রশীদপুর গ্রিডে স্থানান্তর চলছে। বিভিন্ন সংগঠন মাগুরছড়া দুর্ঘটনার যথাযথ ক্ষতিপূরণ আদায়ের দাবিতে আন্দোলন পরিচালনা করে এলেও দীর্ঘ ২৪ বছরেও ক্ষতিগ্রস্তদের দাবিকৃত ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিষয়টি অমীমাংসিত রয়ে গেছে। গ্যাস কূপ বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধানের জন্য গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আজ পর্যন্ত জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি। তৎকালীন সরকার ক্ষতিপূরণ আদায়ে জোরালো ভূমিকা পালন করেনি। ফলে মাগুরছড়া দুর্ঘটনার ২৪তম বার্ষিকী পূর্ণ হলেও ক্ষতিপূরণ আদায় নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার কারণে আজও ক্ষতিপূরণ না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা নীরবে চোখের জল ফেলছেন। এ নিয়ে মৌলভীবাজার তথা বৃহত্তর সিলেটের জনমনে ক্ষোভের আগুন জ্বলছে। গ্যাস কূপ বিস্ফোরণের পর পরিত্যক্ত এলাকার উত্তর টিলায় সবুজায়ন করা হয়েছে। মূল কূপটি এখনও পুকুরের মতো আকার ধারণ করে টিকে আছে। এর চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা হয়েছে। টিলার উপর সবুজ বনায়নের উদ্যোগ নিলেও আগুনে পোড়া ডালপালাবিহীন কালো রঙের গাছগুলো অগ্নিকাণ্ডের সাক্ষী হয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে।
কমলগঞ্জ উপজেলার সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতরে লাউয়াছড়া ফরেস্ট বিটের অভ্যন্তরে মাগুরছড়া এলাকায় ১৯৮৪-৮৬ ও ১৯৯৪ সালে সাইসলিক সার্ভেতে গ্যাস মজুদের সন্ধান পাওয়া যায়। এর প্রেক্ষিতে উৎপাদন ভাগাভাগির চুক্তিতে ১৯৯৫ সালের ১১ জানুয়ারি মার্কিন বহুজাতিক তেল ও গ্যাস উত্তোলণকারী কোম্পানি অক্সিডেন্টালের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং গ্যাস উত্তোলনের জন্য ৬৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে অনুমতি প্রদান করা হয়। দায়িত্বগ্রহণের পর অক্সিডেন্টাল কোম্পানি মাগুরছড়ায় গ্যাস ফিল্ডের ড্রিলিং কাজের জন্য সাবলিজ প্রদান করেছিল ডিউটেক নামের জার্মান কোম্পানির কাছে। গ্যাস উত্তোলনে ১৪ নম্বর ব্লকের মাগুরছড়াস্থ মৌলভীবাজার-১ গ্যাস কূপ খননকালে ৮৫০ মিটার গভীরে যেতেই ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মধ্যরাতে ঘটে ভয়াবহ বিস্ফোরণ। এ সময় শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ ১৫ কিলোমিটার (৩৩ হাজার কেভি) উচ্চতার বৈদ্যুতিক লাইন পুড়ে নষ্ট হয়। কুলাউড়া, বড়লেখা ও কমলগঞ্জ উপজেলার ৫০টি চা-বাগানে দীর্ঘকালীন স্থায়ী বিদ্যুৎ সংকট দেখা দেয়। ৬৯৫ হেক্টর বনাঞ্চলের বৃক্ষ সম্পদ, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এছাড়া ২৪৫ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পুড়ে নষ্ট হয়, যার বাজার মূল্য দাঁড়ায় ৫০ কোটি ডলার। গ্যাস বিস্ফোরণের পর অক্সিডেন্টাল তাদের দেশীয় কোম্পানি ইউনিকলের কাছে দায়িত্ব দিয়ে এ দেশ ত্যাগ করলে দুই বছর পর ফুলবাড়ি চা-বাগান, পার্শ্ববর্তী মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জির বাড়ি-ঘর ও পান জুম এলাকার ক্ষতিপূরণ বাবদ আংশিক টাকা প্রদান করে ইউনিকল।
অন্যদিকে, দুর্ঘটনাস্থলের কাছাকাছি কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল সড়ক ধারে সামাজিক বনায়নের লক্ষ্যে রোপিত গাছের জন্য তিন ব্যক্তিকে ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয়। দীর্ঘ ৬ মাস কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকার কারণে ক্ষতিপূরণ বাবদ বাস মালিক সমিতিকে ২৫ লাখ টাকা প্রদান করা হয়। এছাড়া বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে কিছু ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পরিবেশ ও গ্যাস বাবদ কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি এবং কোনো সরকারই ক্ষতিপূরণ আদায়ে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় জনমনে সন্দেহ বিরাজ করছে। দুর্ঘটনার পর তৎকালীন সরকারের খনিজ ও জ্বালানী মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাহফুজুল ইসলামকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তদন্ত কমিটি ১৯৯৭ সালের ৩০ জুলাই মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পেশ করে। তাদের প্রতিবেদনে অক্সিডেন্টালের দায়িত্বহীনতাকেই দায়ী করা হয়।
২০০৩ সালের ১১ মে ইউনিকলের ওপর রুলনিশি জারি করে হাইকোর্ট। কেন সম্পূরক চুক্তি বাতিল করা হবে না এবং মাগুরছড়া গ্যাস ফিল্ডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষতিপূরণ প্রদানের আগে গ্যাস-তেল উত্তোলন বন্ধ রাখতে কেন ইউনিকলকে নির্দেশ দেওয়া হবে না- এ মর্মে দুই সপ্তাহের মধ্যে কারণ দর্শানোর জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। একই সঙ্গে সরকার ও পেট্রো বাংলাকেও কারণ দর্শাতে বলা হয়। বিচারপতি মো. আব্দুর রশীদ ও বিচারপতি সিদ্দিকুর রহমান মিয়ার সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন। চট্টগ্রামের বিআইটির ইলেক্ট্রিক্যাল ও ইলেক্ট্রনিক্স বিভাগের প্রধান প্রফেসর এম শামসুল আলমের রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ রুলনিশি জারি হয়। রিট আবেদনে বলা হয়, ১৯৯৫ সালের ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে মার্কিন তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি অক্সিডেন্টালের চুক্তি হয়। এরপর ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মাগুরছড়া গ্যাস ক্ষেত্রে অগ্নিকাণ্ডে বিপুল অংকের ক্ষতি হয়। এ ব্যাপারে সরকার তদন্ত কমিটি গঠন করে। রিপোর্টে বলা হয়, ওই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার জন্য কোম্পানি দায়ী।
অন্যদিকে ১৯৯৮ সালের ২৫ নভেম্বর ক্ষতিপূরণের কোনো শর্ত না রেখেই ২য় দফায় সম্পূরক চুক্তি হয়। এ কারণে ওই চুক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন দাখিল করা হয়। শুনানিতে আইনজীবীরা বলেন, অক্সিডেন্টাল দেশের প্রচলিত পেট্রোলিয়াম ও পরিবেশ আইন না মেনে কাজ শুরু করে। এছাড়া তারা কোম্পানির সকল দায়-দায়িত্ব ইউনিকলকে বুঝিয়ে দিয়েছে। তাই ক্ষতিপূরণ আদায়ের লক্ষ্যে ইউনিকলের প্রতি রুলনিশি জারির আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু হাইকোর্টের রুলনিশির কোনো সন্তোষজনক জবাব ইউনিকল দেয়নি। সরকার কর্তৃক আইসিসি কোর্টে মামলা করার পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছিল।
এছাড়া ২০০৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে গোলাম হাবিবের এক প্রশ্নের জবাবে তৎকালীন জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেন মাগুরছড়া গ্যাসফিল্ডে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিপূরণের জন্য বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করবে বলে জানান।
পাহাড় রক্ষা ও উন্নয়ন সোসাইটি সিলেট বিভাগীয় কমিটির সভাপতি মো. সালাউদ্দিন জানান, মাগুরছড়া গ্যাস কূপ আগুনে পুড়ে ছাই হওয়ার ২৪ বছর অতিক্রম হলে এখন পর্যন্ত ক্ষতপূরণ আদায় করা হয়নি। আজ সোমবার ১৪ জুন দুপুরে বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা কমিটির উদ্যোগে মাগুরছড়ায় মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হবে। ক্ষতিপূরণ আদায়, কমলগঞ্জ উপজেলাবাসীর ঘরে ঘরে গ্যাস লাইন সরবরাহসহ বিভিন্ন দাবি নিয়ে এ মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হবে।
মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জির মন্ত্রী জিডিসন প্রধান সুচিয়াংয়ের মতে, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিক বনের যে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা কেউ বুঝতে পারবে না। আমরা যারা এই বনে বসবাস করছি তারা বুঝতে পারছি।
না ম প্রকাশে অনিচ্ছুক বন বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, বনের ১৭৭ কোটি টাকার ক্ষতি নিরূপণ করে দেওয়া হলে এ পর্যন্ত কিছুই পাওয়া যায়নি। প্রাকৃতিক বনের ক্ষতি কখনওই পুষিয়ে ওঠার নয়।
মাগুরছড়ার গ্যাস সম্পদ ও পরিবেশ ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ আদায় জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক কলামিস্ট সৈয়দ আমিরুজ্জামান বলেন, মাগুরছড়া বিস্ফোরণের ২৪ বছর পূর্ণ হয়েছে। অক্সিডেন্টালের পর মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন বাংলাদেশ থেকে চলে গেলে ক্ষতিপূরণের কী হবে? তাই সরকারকেই এ ব্যাপারে তড়িৎ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মাগুরছড়া বিস্ফোরণে গ্যাস সম্পদ ও পরিবেশ ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য আমরা ১০ দফা দাবিতে দীর্ঘদিন যাবত আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছি।
এ বিষয়ে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন সংরক্ষক রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, আজ পর্যন্ত একটি টাকাও ক্ষতিপূরণ আদায় করা যায়নি।
ক্ষতিপূরণ আদায়ের কোনো প্রক্রিয়া আছে কি না জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আমার কাছে এ বিষয়ে সর্বশেষ কোনো তথ্য নেই। এটি অধিদপ্তরের বিষয়।
লেখক ও গবেষক আহমদ সিরাজ বলেন, বনের ক্ষতি নিরূপণ করে দেওয়া হলেও এ পর্যন্ত কিছুই পাওয়া যায়নি। প্রাকৃতিক বনের ক্ষতি কোনো সময়েই পুষিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। মাগুরছড়া গ্যাস কূপ বিস্ফোরণে ক্ষতিপূরণ প্রদানে কোনো অগ্রগতি নেই। পূর্বে যে অবস্থা ছিল, এখনও সেই একই অবস্থা।
এসডি/আরআর-০২