আফগানিস্তানে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি নারীরা

সিলেট মিরর ডেস্ক


সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২১
০৯:৩৮ অপরাহ্ন


আপডেট : সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২১
০৯:৩৮ অপরাহ্ন



আফগানিস্তানে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি নারীরা

তালেবানরা ক্ষমতা দখলের পর আফগানিস্তানের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে দেশটির নারীরা ভয়াবহ সব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছেন নারীরা।

দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় নানগারহার প্রদেশের একটি ছোট হাসপাতালে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে তেমনই ভয়াবহ যন্ত্রণার মুখোমুখি হয়ওয়ার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন এক নারী।

বিবিসির কাছে ওই নারী তার এই তৃতীয় সন্তান জন্মদানের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘এই সন্তানটিকে জন্ম দিতে গিয়ে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়, তা আগের দুই সন্তান জন্মদানের চেয়ে পুরোপুরি ভিন্ন ছিল। এবারের সন্তান জন্মদানের অভিজ্ঞতা ছিল ভয়াবহ।’

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, তালেবান-শাসিত আফগানিস্তানের নানগারহারের যে হাসপাতালে রাবেয়া (ছদ্ম নাম) তাঁর তৃতীয় সন্তানের জন্ম দেন, তার অবস্থা ছিল খুবই ভয়াবহ। সন্তান জন্মদানের সময় তাঁকে ব্যথা উপশমের কোনো ওষুধ দেওয়া হয়নি, অন্য কোনো ওষুধ বা খাবার দেওয়া হয়নি।

হাসপাতালটিতে কোনো বিদ্যুৎ ছিল না। জেনারেটর চালু করার জন্য ছিল না কোনো জ্বালানি। এ কারণে হাসপাতালের ভেতরে তাপমাত্রা বেড়ে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল।

আবেদা (ছদ্মনাম) নামের এক ধাত্রী অন্ধকারের মধ্যে মুঠোফোনের আলো দিয়ে রাবেয়ার সন্তান প্রসবে সহায়তা করেন। তিনি বলেন, ‘গরমে আমরা গোসল করার মতো ঘেমেছিলাম’।

আবেদা বলেন, ‘আমার চাকরিজীবনের সবচেয়ে খারাপ অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্যে একটি ছিল এই ঘটনা। যা খুবই বেদনাদায়ক একটি মুহূর্ত ছিল। কিন্তু এই এলাকা তালেবানের দখলে যাওয়ার পর থেকে এখানকার হাসপাতালে দিনরাতের গল্পগুলো এমনই’।

বিরূপ পরিবেশে সন্তান প্রসব করা সত্ত্বেও রাবেয়া বেঁচে আছেন। সে জন্য তিনি নিজেকে ভাগ্যবান আফগান নারীদের একজন ভাবতেই পারেন। কারণ, বিশ্বে মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি, তার একটি আফগানিস্তান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্যমতে, আফগানিস্তানে প্রতি ১ লাখ শিশু জন্ম দিতে গিয়ে ৬৩৮ জন নারী মারা যান।

দেশটির মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর পরিস্থিতি ২০ বছর আগে আরও খারাপ ছিল। বিশেষ করে ২০০১ সালের পর থেকে পরিস্থিতির অগ্রগতি হয়। কিন্তু গত ১৫ আগস্ট কাবুল পতনের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানের ক্ষমতা তালেবানের হাতে যাওয়ার পর দেশটির মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতি ফের মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। রাবেয়ার সন্তান জন্মদানের ঘটনাটি তার একটা উদাহরণ মাত্র।

জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) এর হিসাবমতে, আফগান নারী ও মেয়েদের জন্য তাৎক্ষণিক স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সহায়তার ব্যবস্থা করা না হলে দেশটিতে অতিরিক্ত ৫১ হাজার মাতৃমৃত্যুর ঘটনা ঘটতে পারে। প্রায় ৫০ লাখ অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণের ঘটনা ঘটতে পারে। বিপুলসংখ্যক মানুষ পরিবার পরিকল্পনাসেবা থেকে বঞ্চিত হতে পারে।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আফগান নারীদের প্রজননস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় জীবন রক্ষাকারী সামগ্রী ও ওষুধের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। তার সঙ্গে রয়েছে করোনাভাইরাসের বিস্তার। করোনার সংক্রমণের সম্ভাব্য চতুর্থ ঢেউয়ের ব্যাপারে আফগানিস্তানের কোনো প্রস্তুতিই নেই।

ইউএনএফপিএ জানায়, পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য তারা চেষ্টা করছে। তারা অর্থ সংকটে আছে। এমনকি তালেবানের ক্ষমতা দখলের আগেও দেশটিতে প্রতি দুই ঘণ্টায় একজন আফগান নারী সন্তান প্রসবের সময় মারা যাচ্ছিলেন।

ইউএনএফপিএ উদ্বিগ্ন যে বাল্যবিবাহের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি মৃত্যুর হারকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। বাড়ছে দারিদ্র্য, মেয়েদের স্কুলে যেতে না পারা নিয়ে উদ্বেগ, এবং তালেবান যোদ্ধাদের সঙ্গে মেয়েদের অথবা তরুণ কিশোরী নারীদের মধ্যে জোরপূর্বক বিবাহের আশঙ্কা বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলছে।

তালেবান ক্ষমতায় এসে দেশটির নারীদের ওপর নতুন করে নানান বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। ফলে প্রসূতি নারীদের জন্য হাসপাতাল-ক্লিনিকে গিয়ে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়াটা এখন আরও জটিল এবং কঠিন হয়ে উঠেছে।

কিন্তু আরও উদ্বেগের বিষয় হল যে, হাসপাতাল এবং ক্লিনিকগুলোতে শুধুমাত্র নারী কর্মীদেরই নারী রোগীদের চিকিৎসা করার অনুমতি দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ধাত্রী বিবিসিকে বলেছেন, একজন পুরুষ ডাক্তারকে তালেবানরা মারধর করেছে, কারণ তিনি একা একজন নারী রোগীর কাছে গিয়েছিলেন।

তিনি বলেন, দেশের পূর্বাঞ্চলে তাদের চিকিৎসা কেন্দ্রে, ‘যদি কোনো নারী রোগীকে দেখার জন্য নারী ডাক্তার না থাকে, তাহলে একজন পুরুষ ডাক্তার কেবল সেই নারী রোগীকে দেখতে পারেন যদি সেখানে দুই বা ততোধিক লোকের উপস্থিতি থাকে’।

তা ছাড়া তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর আফগানিস্তানের অনেক চিকিৎসক পদত্যাগ করেছেন। অনেকে দেশে ছেড়ে পালিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরাও আছে।

কাবুলের পতনের পর চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন নারী প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ নবিজাদা। তিনি বলেন, রাতারাতি সবকিছু বদলে গেছে। ফলে সন্তানসম্ভবা আফগান নারীরা বিপদে পড়েছেন।

ডব্লিউএইচও-র হিসাব মতে, প্রতি ১০,০০০ আফগান নাগরিকের জন্য ৪.৬ জন ডাক্তার, নার্স এবং মিডওয়াইফ রয়েছে  যা সর্বনিম্ন সীমার চেয়েও প্রায় পাঁচগুণ কম।

জনস্বাস্থ্য কর্মীরা কমপক্ষে তিন মাস ধরে বেতন পাননি। আবিদা তাদের একজন। তবুও বেতন ছাড়াই, তিনি আরও দুই মাস কাজ চালিয়ে যাওয়ার আশা করেন।

‘আমি এটা আমাদের রোগীদের জন্য এবং আমাদের মানুষের জন্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি ... কিন্তু অর্থ ছাড়া, এটা শুধু আমাদের জন্যই নয়, আমাদের রোগীদের জন্যও উদ্বেগজনক। তারা খুবই দরিদ্র’।

বিশ্বব্যাংকের মতে আফগানিস্তানের প্রায় ৫৪.৫% মানুষ জাতীয় দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। অধিকাংশই প্রত্যন্ত অঞ্চলে।

পশ্চিম হেরাত প্রদেশের দরিদ্র ও বিচ্ছিন্ন গ্রামে রোগীদের চিকিৎসা করা ডা. লোদী বলেন, ‘আমরা চরম চাহিদা এবং খুব অপ্রতুল সম্পদসম্পন্ন জঙ্গোষ্ঠীর সঙ্গে কাজ করছি। তালেবানরা ক্ষমতা দখল করার পর থেকে অপুষ্টি, রক্তশূন্যতা, মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাধি এবং সন্তান প্রসবের জটিলতা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে’।

হেরাত প্রদেশের একটি ছোট গ্রামে বসবাসকারী ২৪ বছর বয়সী লিনা বলেন, ‘তালেবান ক্ষমতায় আসার আগে, একটি স্বাস্থ্য ক্লিনিক গর্ভবতী অবস্থায় আমার দেহে অপুষ্টি ও রক্তশূন্যতা সনাক্ত করে’। তালেবানরা এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেযওয়ার পর তার স্বামী চাকরি হারায়, যিনি একজন রাখাল।

সামান্য অর্থ এবং তালেবানদের ভয়ে, লিনা ক্লিনিকে যাননি যতক্ষণ না তার গর্ভের পানি ভেঙে যায়।

তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী আমাকে গাধার ওপর চড়িয়ে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন। একজন ধাত্রী আমার জটিলতা সামাল দিয়েছিলেন এবং আমার বাচ্চা প্রসব করাতে পেরেছিলেন, যার ওজন অনেক কম ছিল’। লিনা ‘খুব খারাপ অবস্থায়’ বাড়িতে থাকে এবং কোনো আয় নেই, তার সন্তানের জন্য কীভাবে খাবারের জোগান দেবেন তা জানেন না।

অনেক আফগান আশঙ্কা করছেন যে দেশের স্বাস্থ্যসেবার এতোটাই গভীরে চলে যাচ্ছে যেখান থেকে আর ফিরে আসা সম্ভব হবে না এবং দুর্বল মানুষরা- গর্ভবতী নারী, নতুন মা এবং ছোট বাচ্চারা- এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

আবিদা বলেন, ‘পরিস্থিতি প্রতি দিনই আরও খারাপ হচ্ছে হচ্ছে। কেউ জানে না আমাদের কি হবে’।

বি এন-০৮