বিদ্যালয় খুললেও ফিরছে না ওরা

সৈয়দ হাবিবুর রহমান ডিউক, শায়েস্তাগঞ্জ


সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২১
০৭:৩০ অপরাহ্ন


আপডেট : সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২১
০৭:৩০ অপরাহ্ন



বিদ্যালয় খুললেও ফিরছে না ওরা

মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও হাজারও মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ হাতে নিয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় দেড় বছরেরও বেশি সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছিল। করোনায় যাতে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা সংক্রমিত না হয়। সেজন্যই বন্ধ ছিল স্কুল-কলেজ। এমন বাস্তবতায় খানিকটা পাল্টেছে সময়। করোনায় মৃত্যুর হার কমেছে, সংক্রমণের হারও নিয়ন্ত্রণে এসেছে। সারা দেশে যখন সংক্রমণের হার ১০ শতাংশের নিচে ছিল, তখনই স্কুল-কলেজ খোলার চূড়ান্ত ঘোষণা দেওয়া হয়। ঘোষণা অনুযায়ী গত ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ফের শুরু হয়েছে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান। তবে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শায়েস্তাগঞ্জের অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। অনেক ছাত্র শিশুশ্রমে জড়িয়ে পড়েছে। অনেক ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে। তারা আর স্কুলে বা কলেজে যাচ্ছে না।

করোনার প্রভাবে পারিবারিক সমস্যা আর অভাব খুদে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ। টানা বন্ধে অভাবের সংসারের ঘানি টানায় সামিল হতে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ চায়ের দোকানে কাজ নিয়েছে। কেউ কেউ হাট-বাজারে ধান-চালের বস্তা ওঠা-নামার কাজ করছে। আবার কেউ কেউ মুদির দোকানে স্বল্প মজুরিতে কাজ করছে।

একদিকে দীর্ঘদিন স্কুলে না যাওয়ায় খামখেয়ালিপনা আর লেখাপড়ার কোনো চাপ না থাকায় শিশুরা পড়াশোনা থেকে দূরে সরে পড়েছে, অন্যদিকে একান্নবর্তী পরিবারের অসচেতন অভিভাবকরা তাদের শিশুকে শ্রমের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। এতে করে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ হয়ে পড়েছে অনিশ্চিত। 

শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার নুরপুর ইউনিয়নের সোহাগ মিয়া শাহজীবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিল। তারা তিন ভাই ও এক বোন। সোহাগের বাবা উজ্জ্বল মিয়া ঝালমুড়ি বিক্রি করে সংসার চালান। করোনার সংক্রমণ শুরুর পর সোহাগের স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। এখন সে একটি চায়ের দোকানে দৈনিক ৫০-৬০ টাকা মজুরিতে কাজ করছে।

একইভাবে আব্দুল গফুরের ছেলে মোজাহিদ মিয়া ৫ম শ্রেণিতে অধ্যয়ন করছিল। কিন্তু করোনা কেড়ে নিয়েছে তার ছাত্রজীবন। সে এখন তার বাবার মতোই প্রতি হাটবারে ধান-চালের বস্তা ওঠা-নামাতে সাহায্য করে। এতে যে টাকা পায়, তা তার মায়ের কাছে দেয়। এভাবেই চলছে তার জীবন।

নাঈম মিয়াও ৫ম শ্রেণির ছাত্র ছিল। তার বাবা একজন টমটম চালক আর মা একটি কোম্পানিতে শ্রমিকের চাকরি করেন। তবু সংসারের আয়ে শরিক হওয়ার জন্য ছোট ছেলে নাঈমকে একটি দোকানে কাজ করার জন্য পাঠিয়েছেন তারা। নাঈম বলে, আমি আবার স্কুলে যেতে চাই। কিন্তু পড়ায় আগের মতো মন বসে না।

করোনার প্রভাবে এভাবে অনেক নাঈম, সোহাগ, মোজাহিদের স্কুলে যাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে এখনই তারা জীবনযুদ্ধে শামিল হয়ে নিজেদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতকে ঠেলে দিয়েছে অন্ধকারের দিকে। জীবনে কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে ওরা হয়তো আর কখনোই স্কুলে ফিরবে না।

এক সচেতন অভিভাবক রুমি জালাল জানান, ঝরে পড়া শিশুদেরকে স্কুলে ফেরাতে শিক্ষকদের উচিত বাড়ি বাড়ি গিয়ে দাওয়াত দিয়ে অভিভাবক সমাবেশ করা। এতে করে অভিভাবকরা সচেতন হবেন এবং তাদের ছেলে-মেয়েরা স্কুলমুখী হবে। যেসব অভিভাবক অর্থকষ্টের কারণে তাদের ছেলে-মেয়েদের উপার্জনের কাজে লাগিয়েছেন, তাদের প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত।

এ বিষয়ে শায়েস্তাগঞ্জ ইসলামি একাডেমির সহকারী শিক্ষক মো. আব্দুর রকিব বলেন, আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে সরকারি নির্দেশনামতে ক্লাস নিচ্ছি। আমাদের স্কুলের অভিভাবকরা বেশ সচেতন। সেজন্য উপস্থিতির হার বেশ সন্তোষজনক। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঝরে পড়া শিক্ষার্থী থাকতে পারে।

এ ব্যাপারে কথা বলতে শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলীকে একাধিকবার মোবাইলে কল দিলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।

শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মুজিবুর রহমান বলেন, স্কুল খোলার পর থেকে নতুন নিয়মে ক্লাস হচ্ছে। প্রথম অবস্থায় ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত একটি করে ক্লাস হতো। এখন আবার সপ্তাহে দুইদিন ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। সরকার যখন প্রতিদিন ক্লাসের সুযোগ করে দেবে, তখন আসলে বোঝা যাবে কতজন শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। দীর্ঘদিনের বন্ধ শেষে স্কুল খোলার পর শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ক্রমেই বাড়ছে।

এ বিষয়ে শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিনহাজুল ইসলাম বলেন, গ্রামাঞ্চলে আসলেই শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে কম। আমি নিজেও বেশ কয়েকটি স্কুল পরিদর্শন করেছি। বিশেষ করে মেয়েদের উপস্থিতি বেশ কম। ঠিক কী কারণে শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসছে না, এরা ঝরে পড়েছে কি না- এ ব্যাপারে শিক্ষকদের খোঁজ নিতে বলেছি। বিষয়টি খুঁজে বের করার পর আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।


এসডি/আরআর-০২