সিলেটে সীমিত আয়ের মানুষদের বড় চাপ

নিজস্ব প্রতিবেদক


অক্টোবর ২৯, ২০২১
০৪:৩৩ পূর্বাহ্ন


আপডেট : অক্টোবর ২৯, ২০২১
০৪:৩৬ পূর্বাহ্ন



সিলেটে সীমিত আয়ের মানুষদের বড় চাপ

‘কিছুদিন আগেও ৩৫ টাকায় সবজি দিয়ে এক প্লেট ভাত পেট পুরে খেতে পারতাম। কিন্তু এখন সেই এক প্লেট ভাত খেতে দিতে হয় ৪৫ টাকা। কোথাও কোথাও ৫০ টাকা। এখন তো দেখি সবজি দিয়েই ভাত খাওয়াই কঠিন হয়ে পড়েছে।’ 

মঙ্গলবার বিকেলে সিলেট নগরের চৌহাট্টা এলাকায় দাড়িয়ে কথাগুলো বলছিলেন এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী মো. হিমেল। নগরের নয়াসড়ক এলাকায় একটি মেসে থাকেন তিনি। খাওয়া-দাওয়া সারতে হয় পাড়ার ভাতের হোটেলগুলোতে। দু-বেলা ভাত খেতে এখন বাড়তি টাকার চাপে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে।

হিমেল সিলেট মিররকে বলেন, ‘দিনে দুইবার আমাকে ভাতের হোটেলে খাওয়া-দাওয়া করতে হয়। নগরের বিভিন্ন হোটেল ঘুরে আমি খাওয়া-দাওয়া করি। গত সপ্তাহখানেক ধরে প্রতি বেলায় আমার ২০ থেকে ৩০ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে। না খেয়ে তো বাঁচতে পারব না। অথচ আমার বেতন নির্ধারিত। যেভাবে খাবারের দাম বাড়ছে তাতে খুব বেশি ভোগান্তিতে পড়েছি।’ 

বিভাগীয় শহর হওয়ার কারণে সিলেট নগরের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের বসবাস। এর মধ্যে বড় অংশই নিম্ন ও মধ্যবিত্ত। তারা অনেকেই নগরের বিভিন্ন মেসে থাকেন। তাদের খাওয়া-দাওয়ার অন্যতম স্থান হল নগরের পাড়া-মহল্লার সল্পমূল্যের ভাতের হোটেলগুলো। 

গত কয়েকদিন নগরের বিভিন্ন ভাতের হোটেলগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সব হোটেলেই দাম বেড়েছে খাবারের। এ সব হোটেলে রিকশা চালক, শ্রমিক, বিভিন্ন দোকানের কর্মচারি, স্বল্প আয়ের মানুষের আনাগোনাই বেশি। হোটেলে সাধারণরত ভর্তা, সবজি, ডিম, মুরগি দিয়ে ভাত খান তারা। কিছুদিন আগে হোটেলগুলো ভর্তা-সবজি দিয়ে ভাত বিক্রি করত ৩৫ টাকায়। এখন তা ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। ডিম দিয়ে ভাত খেলে আগে ৪০ টাকা খরচ হত। কিন্তু এখন দিতে হচ্ছে ৫০ টাকা। মুরগি দিয়ে কেউ খেতে চাইলে তাকে গুণতে হচ্ছে ৮০ টাকা। কিন্তু সপ্তাহ খানেক আগে এর দাম ছিল ৬০ টাকা। 

নগরের খেটে খাওয়া মানুষেরা বলছেন, মাছ-মাংস যে দাম তাতে বেশিরভাগ সময় সবজি, ডিম ও ভর্তা-ভাত খেয়েই তাদের দিনাতিপাত করতে হয়। কিন্তু এখন আলুসব সবধরনের জিনিষের দাম বাড়ায় সবজি-ভর্তা-ভাতের খরচ জোগাড়ও কষ্টকর হচ্ছে তাদের জন্য। 

সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘প্রতিদিন দুপুরে ৫০ টাকা দিয়ে ভাত খাই। কিন্তু গত ৪-৫ দিন ধরে এই ভাতের দাম হয়েছে ৮০ টাকা। ৮০ টাকা দিয়ে আমার মতো শ্রমিকের ভাত খাওয়ার ক্ষমতা নেই। তাই দুপুরের ভাত খাওয়া বাদ দিয়েছি। রাতে বাসায় গিয়ে একেবারে খাই।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘করোনাকালেও আমরা এত কষ্টে ছিলাম না। দুই বেলা ভাত খেতে পেরেছি। কিন্তু এখন বাজারের যে অবস্থা তাতে জীবন চালাতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।’ 

হোটেল ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে চাল, আলু, পেঁয়াজ, তেলসহ সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় তারাও খাবারের দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন। 

নগরের নয়াসড়ক এলাকার মাদানী রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার আলা উদ্দিন সিলেট মিররকে বলেন, ‘বাজারে সবকিছুর দাম বাড়ায় আমাদেরও খাবারের দাম বাড়াতে হয়েছে। দাম বাড়িয়েও ব্যবস্যা চালানো কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া প্রায়ই ক্রেতাদের সঙ্গে দাম নিয়ে তর্ক করতে হয়।’ 

শুধু নিম্নবিত্ত মানুষই নয় দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতির কারণে কষ্টে আছেন নগরের মধ্যবিত্ত মানুষরাও। ব্যাগ ভর্তি বাজার তো দূরের কথা এখন কোনোরকমে বেঁচে থাকতে তাদের কষ্ট করতে হচ্ছে। 

নগরের বেসরকারি একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষক এনাম আহমদ সিলেট মিররকে বলেন, ‘বাজারে এমন কোনো পণ্যের দাম নেই যে বাড়েনি। আমরা মধ্যবিত্ত মানুষ বাজারে গেলে দামের আগুনে হাত পুড়ে যায়। এ অবস্থায় কোনোভাবে যে খেয়ে পরে বাঁচব তার পথও দেখছি না। নিত্যপ্রয়োজনী জিনিসপত্র, পানির বিল, সিএনজি ভাড়া সব বাড়লেও আমাদের আয় তো আর বাড়েনি।’ 

তরুণ উদ্যোক্তা মতিউর রহমান সিলেট মিররকে বলেন, ‘সিলেটে প্রায় ৩৫ বছর ধরে বসবাস করছি। বাজার করি ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু বাজারের এই উর্ধ্বগতি আগে কখনো দেখিনি। এভাবে বাড়তে থাকলে এই শহরে থাকাই যাবে না।’

দেশে গত সেপ্টেম্বরে টানা তৃতীয় মাসের মতো মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। ফলে খাদ্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় উপকরণের দাম বাড়ছে এবং নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ৫ পয়েন্ট বেড়ে ৫ দশমিক ৫৯ হয়েছে, যেটি আগস্টে ৫ দশমিক ৫৪ ছিল। বেশিরভাগ পণ্যের দাম আকাশচুম্বী হয়েছে এবং মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে।

খাদ্য নয়, এমন পণ্যের মূল্যস্ফীতির হার সেপ্টেম্বরে ৬ পয়েন্ট বেড়ে ৬ দশমিক ১৯ হয়েছে। আগস্টে এটি ৬ দশমিক ১৩ ছিল। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৫ পয়েন্ট বেড়ে ৫ দশমিক ২১ হয়েছে, যেটি আগস্টে ৫ দশমিক ১৬ ছিলো।

বিবিএস একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, চাল, ডিম, গম, রসুন, পিঁয়াজ, আদা ও হলুদের দাম গত মাসে বেড়েছে।

খাদ্য মূল্যস্ফীতি আগস্টের ৪ দশমিক ২ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ হয়েছে। শহরাঞ্চলে খাদ্য নয়, এমন পণ্যের মূল্যস্ফীতির হার আগস্টের ৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ হয়েছে।

কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সিলেট-এর বিভাগীয় সভাপতি জামিল চৌধুরী সিলেট মিররকে বলেন, ‘আমাদের দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত। বাজারের এই অবস্থায় তাদের জীবন চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ সবকিছুর দাম বেড়েছে। বাজারের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে আমরা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে বার বার যোগযোগ করছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘গত ৩ বছরে দেশে যে চাল উৎপাদন হয়েছে গত এক হাজার বছরেও এমন উৎপাদন হয়েছে বলে আমার মনে হয়। তবুও চালের কেন সঙ্কট হয়, কেন আমদানি করার প্রয়োজন হয় আমি বুঝতে পারি না। আমার মনে হচ্ছে বাজার সিন্ডিকেটের কারণেই নিত্যাপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ছে।’

জামিল চৌধুরী বলেন, ‘শুধু সরকারকে দোষারুপ করলেই লাভ হবে না। আমরা বর্তমানে অনেক বেশি খাদ্য অপচয় করছি, যা কমাতে হবে। দেশ দিনে দিনে উৎপাদন নির্ভর না হয়ে আমদানি নির্ভর হয়ে যাচ্ছে। ফলে আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।’

দাম বৃদ্ধির বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সিলেট জেলার সহকারী পরিচালক আমিরুল ইসলাম মাসুদ সিলেট মিররকে বলেন, ‘কোনো খাবারের দোকান যদি মূল্য তালিকার চেয়ে বেশি দাম রাখে তাহলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। এছাড়া আমরা নিয়মিত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজার মনিটরিং করছি। কেন্দ্রীয়ভাবে নির্ধারিত দামের চেয়ে কেউ যাতে অতিরিক্ত আদায় করতে না পারে সেজন্য আমাদের অভিযান পরিচালিত হচ্ছে।’

এনএইচ/আরসি-০২