উজ্জ্বল ধর, ওসমানীনগর
নভেম্বর ০১, ২০২১
০১:২৮ পূর্বাহ্ন
আপডেট : নভেম্বর ০১, ২০২১
০১:৩০ পূর্বাহ্ন
ওসমানীনগরের ইব্রাহীম আলী। পেশায় রাজমিস্ত্রি। পেশার পাশাপাশি অন্যরকম একটি নেশা আছে তাঁর। কারো মৃত্যু সংবাদ কানে আসামাত্রই খুন্তি, কোদাল, শাবল, হাতে তার দল নিয়ে ছুটে যান কবর খুঁড়তে। পরম যত্ম আর অপার ভালবাসা দিয়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের শেষ ঠিকানা ‘কবর’ খুঁড়েন তিনি।
উপজেলার উছমানপুর ইউনিয়নের গহরপুর গ্রামের মৃত ইছরাক উল্লাহ’র ছেলে ইব্রাহীম আলীর বাবাও জীবদ্দশায় এলাকায় অনেক কবর খুঁড়েছেন। বাবার তালিমে ইব্রাহীম আলীও হয়ে উঠেন দক্ষ ‘গোর খোদক’।
মানুষের অন্তিম যাত্রায় একান্ত সহযাত্রীর মতো ইব্রাহীম আলী বাড়িয়ে দেন তার আন্তরিকতার হাত। শীত, গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষা এভাবেই শতাধিক কবর খুঁড়ে পার করে দিয়েছেন জীবনের পঞ্চাশটি বছর। গত ত্রিশ বছর ধরে শতাধিক কবর খনন করেছেন তিনি। ব্যতিক্রমী পন্থায় মানুষের প্রতি নিঃস্বার্থ সেবাপরায়ণতার এক অনন্য প্রতীক হয়ে ওঠেছেন ইব্রাহীম আলী।
ইট-সিমেন্টের শক্ত ঘর নির্মাণ করা তার পেশা হলেও মানুষের শেষ ঠিকানা ‘কবর’ তিনি খুঁড়ে চলেছেন বিনে পয়সায়। কারো কাছ থেকে কোনো আর্থিক সহায়তা না নিয়ে ইব্রাহীম আলীর সঙ্গে এই কবর খননের নেশায় যুক্ত রয়েছেন আরও চারজন। রাঙ্গাপুরের মর্তুজা মিয়া, গহরপুরের অপু মিয়া, আল-আমীন, তারেক মিয়াও ইব্রাহীম আলীর এ কাজের অন্যতম সহযোগী।
ইব্রাহীম আলী নিপুণ হাতে মানুষের এপার-ওপারের ঘর তৈরি করে দিলেও তার নিজের ঘরটি জরাজীর্ণ। যৌথ পরিবারে ১১ সদস্য নিয়ে অভাবের সংসার ইব্রাহীম আলীর। বসত ঘরের চালার ফুটো দিয়ে আকাশ দেখার পাশাপাশি সামান্য বৃষ্টিতেই ভিজে যায় ঘরের আসবাব। কিন্তু তারপরও মনের এক গহীন সংকল্পে কারও মৃত্যু খবর পেলে সবকাজ রেখে ছুটে চলেন কবর খুঁড়তে। নিজের পারিবারিক অভাবের কথা ভুলে যান খানিক সময়ের জন্য। ২০১৭ সালের একটি কবর খুঁড়তে গিয়ে সহযোগী একজনের কোদালের কোপ ইব্রাহীম আলীর মাথায় লাগে। এতে মারাত্মক আহত হন ইব্রাহীম আলী। হাসপাতাল থেকে মাথায় সাতটি সেলাই নিয়ে বাড়ি ফিরেন। তারপর বেশ ক’দিন বিছানায় পড়ে থেকে সামান্য সুস্থ হয়েই ফিরে যান সেই পুরোনো নেশায়।
সেদিন উছমানপুরের ময়নাবাজারে কথা হয় সহজ-সরল জীবনযাপনে অভ্যস্থ ইব্রাহীম আলীর সঙ্গে। তিনি জানান, তার বাবার কাছ থেকেই কবর খোঁড়ার নেশা মাথায় চেপেছে। প্রথমে আত্মীয়-স্বজনের কবর খননের কাজে হাতেখড়ি। বাবার মৃত্যুর পর এ কাজটিকেই তিনি জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন। এরপর থেকে টানা ৩০ বছর ধরে অকৃত্রিম আবেগে তিনি নিজেকে নিবেদিত রেখেছেন কবর খননের কাজে। এলাকার কবুলপুর, গহরপুর, রাঙ্গাপুর, ভেড়াখাল, সিকন্দরপুরসহ এলাকার ১০-১৫টি গ্রামের লোকজনের কাছে ‘গোর খোদক’ হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত।
তিনি বলেন, ‘নিজ গ্রাম বা দূরবর্তী গ্রাম, যেখান থেকে যখনই কারো মৃত্যু সংবাদ পাই, ঘরে থাকতে পারি না। এক অদৃশ্য টানে টিম নিয়ে ছুটে যাই। কবর খুঁড়তে হাত লাগাই। বিনিময়ে কারো কাছ থেকে কোনো আর্থিক সহায়তা গ্রহণ করি না। এমনকি যাতায়াত খরচটুকুও না। এই কাজটিতো আমার পেশা না, নেশা। তাই কোনো প্রকার আর্থিক সহায়তা নেওয়ার প্রশ্নই উঠে না।’
ইব্রাহীম আলী আক্ষেপ করে বলেন, ‘জীবনটাতো একটা স্বপ্নমাত্র। নিজেদের স্বপ্ন সাজাতে মানুষের চাহিদার শেষ নেই। কিন্তু মৃত্যুর পর ধনী, গরিব, ক্ষমতাবান সবার নিথর দেহটা একই রকম। শূন্যহাতেই শুয়ে থাকতে হয় কবরে। তারপরও মানুষের পরিতাপের শেষ নেই। কোথাও নেই মানবতা বা খোদাভীতি!
ইব্রাহীম আলী প্রসঙ্গে স্থানীয় যুবক রায়হান আহমদ বলেন, ‘আমাদের ইব্রাহীম চাচা এমনই। তিনি কোথাও বেড়াতে গিয়ে যদি কারো মৃত্যু সংবাদ পান সেখানে ছুটে গিয়ে কবর খননে শামিল হন। এমনও হয়েছে, ভীষণ অসুস্থ অবস্থায় তিনি বিছানা ছেড়ে ওঠতে পারছেন না। কিন্তু কারো মৃত্যু সংবাদ তার কানে এসেছে, সে অবস্থায় তিনি কবরস্থানে ছুটে গিয়ে তার কবর খনন করেছেন।’
সমাজকর্মী নাজমুল হক বলেন, ‘ইব্রাহীম চাচা সম্পূর্ণ বিনা পয়সায় একের পর এক কবর খনন করে এলাকার মানুষের পরম ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। নিজে আর্থিক নানা টানাপোড়নের মধ্যে থেকেও নিঃস্বার্থভাবে একের পর এক কবর খুঁড়ে সবার কাছের মানবিক মানুষে পরিণত হয়েছেন। আল্লাহ অবশ্যই তার ভালো করবেন।
আরসি-০৮