কমলগঞ্জ প্রতিনিধি
নভেম্বর ১৬, ২০২১
০৫:০৬ পূর্বাহ্ন
আপডেট : নভেম্বর ১৬, ২০২১
০৫:০৬ পূর্বাহ্ন
আগমী শুক্রবার অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে মণিপুরি স¤প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শ্রীশ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলা উৎসব। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ও আদমপুর এলাকার মণিপুরি সমপ্রদায়ের লোকজনের মাঝে বিরাজ করছে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা।
উৎসবের স্থায়িত্বকাল একটি রজনী। একটি রজনীকে কেন্দ্র করে মণিপুরি সংস্কৃতির এক বিশাল মিলন মেলায় পরিণত হয়। রাস উৎসবকে কেন্দ্র করে কয়েকদিন ধরে কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ও আদমপুরের মণিপুরিপাড়াগুলোতে চলছে প্রস্তুতি ও উৎসবের আমেজ। রং ছড়িয়ে মণ্ডপগুলোকে সাজানো হচ্ছে নতুন সাজে। রাসের দিন দুপুরে উৎসবস্থল মাধবপুরের শিববাজার উন্মুক্ত মঞ্চ প্রাঙ্গণে হবে গোষ্ঠলীলা বা রাখাল নৃত্য। রাতে জোড় মণ্ডপে রাসের মূল প্রাণ মহারাসলীলা।
রাস উৎসবে মণিপুরি সম্প্রদায়ের লোকজনের পাশাপাশি অন্যান্য জাতি, ধর্মের হাজার হাজার লোক মেতে উঠবেন আনন্দ-উৎসবে। উৎসব উপভোগ করতে দেশের বিভিন্ন স্থানসহ ভারত থেকেও মণিপুরি সম্প্রদায়ের লোকজন ছুটে আসেন। কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর জোড়ামণ্ডপ প্রাঙ্গনে মণিপুরি মহারাসলীলা সেবা সংঘের আয়োজনে ১৭৯তম এবং আদমপুর মণিপুরি মৈতৈ সম্প্রদায়ের মহারাসলীলা উদযাপন কমিটির আয়োজনে ৩৬তম রাসোৎসব পালিত হবে।
অপরদিকে উৎসবস্থল আদমপুরেও থাকবে যথারীতি রাখাল নৃত্য ও রাসলীলা। তবে মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়া ও মণিপুরি মৈতৈ এরা আলাদা স্থানে আয়োজন করলেও উৎসবের অন্তঃস্রোত, রসের কথা, আনন্দ-প্রার্থনা সব একই। উৎসবের ভেতরের কথা হচ্ছে বিশ্বশান্তি, সম্প্রীতি ও সত্যসুন্দর মানবপ্রেম। এমনটাই জানালেন আয়োজকরা।
জানা যায়, রাস উপলক্ষ্যে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে। কমলগঞ্জে প্রায় এক মাস ধরে চলছে রাসোৎসবের প্রস্তুতি। উৎসব সফল করতে কয়েকটি বাড়িতে রাসনৃত্য এবং রাখালনৃত্যের প্রশিক্ষণ ও মহড়া চলছে। মাধবপুরে তিনটি জোড় মন্ডপের আওতায় এই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
রাসলীলা দুই ভাগে বিভক্ত : গোষ্ঠলীলা ও রাসলীলা। গোষ্ঠলীলায় কৃষ্ণের বাল্যকালে মাঠে মাঠে বাঁশি বাজিয়ে ধেনু চরাবার মুহূর্তগুলো অনুকরণ করা হয়। গোষ্ঠলীলাকে ‘রাখালনৃত্য’ বা ‘রাখোয়াল’ বলা হয়ে থাকে। রাসলীলায় অভিনীত হয় ‘গোপীনৃত্য’। গোপীদের নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের লীলাখেলাকেই এই পর্বে অভিনয় করে দেখানো হয়। রাসলীলাকে ‘পূর্ণিমারাস’ও বলা হয়ে থাকে। মণিপুরি সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে অন্যান্য স¤প্রদায়ের লোকেরাও মেতে উঠেন একদিনের এই আনন্দে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রাসোৎসবকে ঘিরে মাধবপুর ও আদমপুরের মণ্ডপগুলো সাজানো হয়েছে সাদা কাগজের নকশার নিপুণ কারুকাজে। করা হয়েছে আলোকসজ্জাও। মণিপুরি শিশু নৃত্যশিল্পীদের সুনিপুণ নৃত্যাভিনয় রাতভর মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখবে ভক্ত ও দর্শনার্থীদের। রাত ভর চাঁদের আলোয় মায়াবী জোৎসনায় নূপুরের সিঞ্চনে মুদ্রা তুলবে সুবর্ণ কঙ্কন পরিহীতা রাধা ও গোপিনী রূপের মণিপুরি তরুনীরা। সুরের আবেশে মাতাল হয়ে উঠবে কমলগঞ্জের প্রকৃতি ও জনমানুষ।
আয়োজকরা জানিয়েছেন, রাস উৎসবকে সফল করতে প্রায় মাস খানেক ধরে ছয়টি বাড়িতে রাসনৃত্য এবং রাখালনৃত্যের প্রশিক্ষণ ও মহড়া চলছে। তিনটিতে রাসনৃত্য ও তিনটিতে রাখাল নৃত্য। মাধবপুরে তিনটি জোড়া মন্ডপের আওতায় এই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। একেকটি মন্ডপে আছেন একজন পুরোহিত। সেই পুরোহিতের পরামর্শে একজন প্রশিক্ষক ধর্মীয় বিধিবিধান মতো গোপী বা শিল্পীদের প্রশিক্ষণ দেন। প্রশিক্ষককে সহযোগিতা করতে একজন সহকারী প্রশিক্ষক আছেন। প্রশিক্ষক শিল্পীদের ঠিক করেন। এরপর সামাজিক বিধান মতো শিল্পীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমন্ত্রণের বাইরেও কেউ চাইলে রাসনৃত্যে অংশ নিতে পারেন। গোপীবেশী এই শিল্পীদের বয়স ১৬ থেকে ২২ বছর। শুধুমাত্র রাধার বয়স পাঁচ থেকে ছয় বছর। নৃত্যের প্রতিটি দলে নুনতম ১২ জন অংশ নিয়ে থাকে। একইভাবে রাখাল নৃত্যেরও প্রতিটি দলে ২০ থেকে ২২ জন ১৪ থেকে ১৫ বছর বয়সী বালক অংশ নিয়ে থাকে।
মাধবপুর ও আদমপুরে রাসলীলার আয়োজকরা জানিয়েছেন, মহারাসলীলাল মূল উপস্থাপনা শুরু হবে সকাল ১১টা থেকে ‘গোষ্ঠলীলা বা রাখালনৃত্য’ দিয়ে। গোষ্ঠলীলায় রাখাল সাজে কৃষ্ণের বালক বেলাকে উপস্থাপন করা হবে। এতে থাকবে কৃষ্ণের সখ্য ও বাৎসল্য রসের বিবরণ। গোধূলি পর্যন্ত চলবে রাখালনৃত্য। রাত ১১টা থেকে পরিবেশিত হবে মধুর রসের নৃত্য বা শ্রীশ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলানুসরণ। এই রাসনৃত্য ভোর (ব্রাহ্ম মুহূর্ত) পর্যন্ত চলবে। এই রাসনৃত্যে গোপিনীদের সঙ্গে কৃষ্ণের মধুরলীলাই কথা, গানে ও সুরে ফুটিয়ে তুলবেন শিল্পীরা। রাস অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ ভাবে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী পালিত হয়।
মণিপুরি মহারাসলীলা সেবা সংঘের সাধারণ সম্পাদক শ্যাম সিংহ জানান, রাস উৎসব আনন্দময় করতে সব ধরনের প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে। সরকার নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবারের রাস উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। আমাদের কাছে হেমন্তকাল মানেই রাস-পূর্ণিমা, রাস উৎসব। তিনি আরও বলেন, এবারের রাস উৎসবের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি থাকবেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।
আদমপুর মহারাসলীলা উদযাপন কমিটির অন্যতম নেতা ইবুংহাল সিংহ শ্যামল বলেন, ‘আমাদের সকল আয়োজন এখন শেষপর্যায়ে। উৎসব সুন্দরভাবেই সম্পন্ন হবে।’
রাসলীলায় মণিপুরি নৃত্য শুধু কমলগঞ্জেই নয়, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের তথা সমগ্র বিশ্বের নৃত্য কলার মধ্যে একটি বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে। ১৯২৬ সালের সিলেটের মাছিমপুরে মণিপুরি মেয়েদের পরিবেষ্টিত রাস নৃত্য উপভোগ করে মুগ্ধ হয়েছিলেন বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরে কবিগুরু কমলগঞ্জের নৃত্য শিক্ষক নীলেশ্বর মুখার্জীকে শান্তি নিকেতনে নিয়ে প্রবর্তন করেছিলেন মণিপুরি নৃত্য শিক্ষা। কমলগঞ্জে প্রায় এক মাস আগ থেকেই চলছে রাসোৎসবের প্রস্তুতি। মণিপুরি সম্প্রদায়ের বাড়ি বাড়ি কুমারী কিশোরীদের রাস লীলায় অংশগ্রহণ করার জন্যে নৃত্য ও সংগীতের তালিম নেওয়ার ধুম পড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে তাবৎ বাড়িতে রাসধারী ও রাসলীলার উস্তাদ এনে শিক্ষা দেওয়ার রেওয়াজ প্রচলিত। আনুমানিক ৪০/৫০ জন কিংবা ততোধিক সংখ্যার কিশোরী এ রাসলীলায় অংশগ্রহণ করে থাকে।
এসডি/আরসি-০৬