কমলগঞ্জ প্রতিনিধি
নভেম্বর ২১, ২০২১
০৯:২১ পূর্বাহ্ন
আপডেট : নভেম্বর ২২, ২০২১
১০:২০ পূর্বাহ্ন
আগামী মঙ্গলবার (২৩ নভেম্বর) আদিবাসী খাসিয়া সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী বর্ষ বিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার সদর ইউনিয়নের মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জিতে খাসিয়া সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে।
খাসিয়া আদিবাসী ভাষায় এ অনুষ্ঠানটি হচ্ছে ‘খাসি সেং কুটস্নেম’ ।
চায়ের রাজধানী খ্যাত পর্যটন নগরী মৌলভীবাজারে বসবাস করেন নানা ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষ। এ জনপদে রয়েছে বহুভাষা ও বৈচিত্র্যমন্ডিত সাংস্কৃতিক আবহ। তবে, মৌলভীবাজার জেলায় যে কয়টি সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করেন তার মধ্যে খাসিয়া সম্প্রদায় একটি।
মৌলভীবাজারের খাসিয়া সম্প্রদায়ের রয়েছে বৈচিত্র্যময় জীবনগাঁথা। মৌলভীবাজারের খাসিয়ারা মূলত সিনতেং গোত্রভুক্ত জাতি। তাদের জীবিকার প্রধান উৎস পান চাষ। ভাত ও মাছ তাদের প্রধান খাদ্য। তারা মাতৃপ্রধান পরিবারে বসবাস করে। তাদের মধ্যে কাচা সুপারি ও পান খাওয়ার প্রচলন খুব বেশি।
খাসিয়াদের উৎপাদিত পান(খাসিয়া পান নামে পরিচিত) বাংলাদেশে খুব জনপ্রিয়। এ অঞ্চলের অন্যান্য আদিবাসীর মতো একটি প্রাচীন সম্প্রদায় হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে সম্প্রীতি বজায় রেখে বসবাস করে আসছে। পাহাড়ের পাদদেশে বিভিন্ন টিলা এলাকায় তাদের বসবাস।
দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করলেও তারা অত্যন্ত নিরীহ প্রকৃতির। খাসিয়ারা এক সময় প্রকৃতির পূজারী হলেও বর্তমানে খ্রিস্টান ধর্মালম্বী অনুসরণ করছেন, তবে সিলেটের জৈন্তা এলাকায় কিছু খাসিয়ারা এখনো প্রকৃতির পূজা করে থাকেন। খাসিয়াদের মাতৃভাষা খাসি, বর্তমানে এদের কোন লিখিত কোনো ভাষা নেই। তবে ধারণা করা হচ্ছে এক সময় তাদের লিখিত ভাষা ছিল কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে।
খাসিয়াদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। ধারণা করা হয় খাসিয়া সম্প্রদায় আজ থেকে প্রায় ৫ থেকে ৬ শত বছর পূর্বে ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্য থেকে বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেটের হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট সদর ও সুনামগঞ্জের সুউঁচু টিলার অরণ্যের মধ্যে বসবাস করে আসছেন।
জানা যায়, সেং কুটস্নেম বা বর্ষ বিদায় খাসিয়াদের একটি সার্বজনীন উৎসব। প্রাচীন খাসিয়া সমাজে দেবতার প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশের মধ্য দিয়েই এ উৎসব পালিত হত। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মাগুরছড়া পুঞ্জির খেলার মাঠে নানা সমাহারে এ উৎসব উদযাপিত হবে।
খাসিয়াদের বর্ষ বিদায় ও বর্ষ বরণ উৎসব সেং কুটস্নেম উপলক্ষে খাসি জনগোষ্ঠীর লোকজনের মধ্যে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। খাসি সেং কুটস্নেম অর্থাৎ বর্ষবরণ ও বিদায় অনুষ্ঠানে খাসিয়ারা তাদের প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যবাহী পোশাক পড়ে আদি পাহাড়ি নৃত্য ও গান করে থাকেন, পাশাপাশি তাদের জীবিকার প্রধান উৎসব জুম চাষের এবং জীবন-জীবিকার বিভিন্ন পদ্ধতি নৃত্যের মাধ্যমে তুলে ধরেন।
উৎসব উপলক্ষে খাসি সোশ্যাল কাউন্সিল বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সেং কুটস্নেম উৎসবের দিনব্যাপী সবাই মিলে মাছ শিকার, ঐতিহ্যগত খেলাধুলা, ঐতিহ্যগত পোশাক পরিধান, সাংস্কৃতিক পরিবেশনাসহ ঐতিহ্যবাহী খাবার খেয়ে তারা আনন্দ ফুর্তি করে নিজেদের সামাজিক সম্পর্কে সুদৃঢ় করতে অঙ্গীকারবদ্ধ হন। সেং কুটস্নেম উপলক্ষে ২৩ নভেম্বর মাগুরছড়া পুঞ্জির মাঠে বসবে ঐতিহ্যগত মেলা।
সেই মেলায় খাসি জনগোষ্ঠীর লোকেরা বসবেন বাহারী পণ্যের পসরা নিয়ে। বিভিন্ন স্টলে খাসিয়াদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক,পান, তীর, ধনুক সহ বাঁশ বেতের জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখা হয়। খাসিয়া তরুণ প্রজন্মের পাশাপাশি, বাংলাদেশে খাসিয়াদের প্রাচীন ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তুলে ধরা ও পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য বর্ষ বরণ ও বিদায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
সিলেটে প্রায় ৮০ টির মতো খাসিয়া পুঞ্জি রয়েছে। প্রায় প্রত্যেকটি খাসিয়া পুঞ্জির খাসিয়ারা কমলগঞ্জ উপজেলার মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জির খাসি সেং কুটস্নেম অর্থাৎ বর্ষবরণ ও বিদায় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।
খাসিয়া সম্প্রদায়ের পাশাপাশি এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বাঙালি ও বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষসহ দেশী-বিদেশী পর্যটকরা অংশগ্রহণ করে থাকেন। তবে মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রাদুভার্বের কারণে ২০২০ সালে খাসিয়া সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী বর্ষ বিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান খাসি সেং কুটস্নেম উদযাপিত হয় নি।
মাগুরছড়া পুঞ্জির মন্ত্রী ও খাসি সোশ্যাল কাউন্সিল এর সভাপতি জিডিশন প্রধান সুছিয়াং বলেন, খাসি সেং কুটস্নেম উপলক্ষে খাসিয়া পুঞ্জিগুলোতে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে। অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যেসব অতিথিরা আসবেন তাঁদের সংবর্ধনা ও কথা বলার সুযোগ দেয়া হয়। উৎসবে বিশেষ কাউকে আনুষ্ঠানিভাবে অতিথি করা হয় না। যারা উৎসবে যোগ দেন তাদের সবাইকে খাসি সেং কুটস্নেম উৎসবের অতিথি হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে।
খাসি সোশ্যাল কাউন্সিলের তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সাজু মারছিয়াং বলেন, খাসি সেং কুটস্নেম সফল করতে তাদের সব ধরণের প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবারের উৎসব উদযাপন করা হবে।
এস ডি/বি এন-০৯