চা উৎপাদনে এ বছর রেকর্ড ভাঙার প্রত্যাশা

নিজস্ব প্রতিবেদক


নভেম্বর ২২, ২০২১
০৪:০৫ পূর্বাহ্ন


আপডেট : নভেম্বর ২২, ২০২১
০৪:৩৫ পূর্বাহ্ন



চা উৎপাদনে এ বছর রেকর্ড ভাঙার প্রত্যাশা

প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাত এবং আবহাওয়ার অনুক‚ল পরিবেশের কারণে এবার আশাতীত চা উৎপাদন হয়েছে। চলমান উৎপাদনের এই ধারা অব্যাহত থাকলে এবারও লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে রেকর্ড পরিমাণ চা উৎপাদন হবে বলে আশা করছেন চা উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে ৭ কোটি ৭৮ লাখ কেজি। জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে উৎপাদন হয়েছে ৬ কোটি ৪৮ লাখ কেজি। ৯ মাসে ৮৪ ভাগ চা উৎপাদন হয়েছে। বছর শেষে গত বছরের চেয়ে চা উৎপাদন এক কোটি কেজি বেশি হবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে ১৪০ মিলিয়ন মেট্রিকটন চা উৎপাদনের পরিকল্পনা করেছে সরকার। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানির জন্যও নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

চা বোর্ড সূত্র জানায়, অনুকূল আবহাওয়া ছাড়াও বাধ্যতামূলক চা আবাদযোগ্য জমির আড়াই পার্সেন্ট হারে প্রায় প্রতিটি বাগানে চা সম্প্রসারণ, চা জমির সম্প্রসারণে বাগানগুলোতে ব্যাপক মনিটরিং, আনুষঙ্গিক সরঞ্জামের পর্যাপ্ততা, সময়মতো সার ও কীটনাশক প্রাপ্তি, ক্লোন চা গাছের ব্যবহার বৃদ্ধি, রপ্তানি হওয়া এবং সর্বোপরি চা বোর্ডের নজরদারির কারণে এবার দেশে চা উৎপাদন বেড়েছে।

২০১৯ সালে ৯ কোটি কেজি চা উৎপাদনের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়। তবে এবার সেই রেকর্ড ভেঙে দেশে ১০ কোটি কেজি চা উৎপাদন হয়ে ডিসেম্বর নাগাদ আরেক রেকর্ড সৃষ্টি হওয়ার আশা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ চা বোর্ড সূত্র জানায়, বর্তমানে নিবন্ধিত ১৬৪টি চা বাগানের মধ্যে বৃহত্তর সিলেটেই রয়েছে ১৩৫টি। এবার মৌসুমের শেষ দিকেও সিলেটের বাগানগুলোতে চলছে চা-চয়নের ধুম। শ্রমিকরা ‘পাতি’ তুলছেন মহাখুশিতে। এবার অক্টোবর পর্যন্ত বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় এখনও চা গাছে কুঁড়ি গজাচ্ছে। তাই বাগান সংশ্লিষ্টরা এবার বড় অর্জনের স্বপ্নে বিভোর। চায়ের উৎপাদন ভালো হলেও বাজারমূল্য প্রতি কেজি মাত্র ১৯০-১৮৬ টাকা। ফলে উৎপাদন ভালো হলেও বিক্রয়মূল্য বেশি না পাওয়ায় কিছুটা হতাশ চা বাগান সংশ্লিষ্টরা।

হবিগঞ্জের আমতলী চা বাগানের ব্যবস্থাপক সোহেল রানা পাঠান সিলেট মিররকে বলেন, ‘চা একটি সংবেদনশীল কৃষি পণ্য। সুষম আবহাওয়া, সঠিক পরিচর্যার উপর এই কৃষি পণ্যটি বেঁচে আছে। বছরের প্রথম দিকে বৃষ্টি-খরার কারণে শঙ্কা তৈরি হলেও পরে আবহাওয়া বেশ ফেভার করেছে। ফলে উৎপাদন ভালো হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘আমতলী বাগানে এবার চা-উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৪ লাখ কেজি। ইতোমধ্যে ১২ লাখ কেজির বেশি চা উৎপাদন হয়েছে। বছরের বাকি সময়ের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ হবে। আগের বছর বাগানে সাড়ে ১৩ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়।’

উৎপাদন বাড়লেও বিক্রয়মূল্য আশানুরুপ নয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রতি কেজি চা উৎপাদনে আমাদের প্রায় ১৮০ থেকে ১৯০ টাকা খরচ হয়। কিন্তু বিক্রি করতে হয় ১৯০ থেকে ২০০ টাকায়। ২০১৮ সালে ৩০০ টাকা করে কেজিতে চা বিক্রি করা হয়েছিল।’

সিলেটের জাফলং চা বাগানের ব্যবস্থাপক সানাউল হক বলেন, ‘গত বছর আমাদের বাগানে প্রায় এক লাখ কেজি বেশি চা উৎপাদন হয়েছে। বাগানের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলে উৎপাদন আরও বাড়ানো সম্ভব।’

জানা যায়, উৎপাদন বাড়লেও সিন্ডিকেটের কারণে নিলামবাজারে চায়ের দাম কমে যাচ্ছে। এতে মালিক পক্ষ বাগান চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চা বিশেষজ্ঞরা জানান, চা নিলাম কেন্দ্রে দেশের বড় ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে কম দামে চা ক্রয় করে খুচরা বাজারে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন। অন্যদিকে চোরাই পথে নিম্নমানের ভারতীয় চা-পাতা দেশীয় পাতার সঙ্গে মিশ্রণ করে বাজারজাত করায় দেশের চা শিল্পের ক্ষতি হচ্ছে। 

বাংলাদেশ টি এসোসিয়েশন সিলেট ব্রাঞ্চের চেয়ারম্যান জিএম শিবলী সিলেট মিররকে বলেন, ‘এবার সিলেটে চায়ের উৎপাদন আগের বছরের চেয়ে বেশি হয়েছে। অনুকূল আবহাওয়া ও সঠিক তদারকির কারণে উৎপাদন বেড়েছে। যদিও বছরের প্রথম দিকে আবহাওয়া কিছুটা খারাপ ছিল।’

তিনি বলেন, ‘চা উৎপাদন বাড়লেও বিক্রি করতে হচ্ছে কম দামে। একটু খারাপ চা যেসব বাগানে উৎপাদন হয় সেগুলোকে উৎপাদন মূল্যের চেয়ে কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ ভারত থেকে নি¤œমানের চা দেশে ঢুকছে। এতে করে দেশি চায়ের দাম কমে যাচ্ছে।’

করোনা মহামারির প্রভাব পড়লেও এই সময়ে চা-বাগানগুলোতে শ্রমিকরা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করছেন। শ্রমিকরা বলছেন তাদের কষ্টের কারণেই এবার উৎপাদন বেড়েছে। বছর বছর উৎপাদন বাড়লেও শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন হচ্ছে না বলেও তারা জানান।

চা শ্রমিক ইউনিয়ন সিলেট ভ্যালির কার্যকরী পরিষদের সভাপতি রাজু গোয়ালা সিলেট মিররকে বলেন, ‘চা উৎপাদন বাড়ছে শ্রমিকদের কঠোর পরিশ্রমের কারণে। কিন্তু তাদের মজুরি ও সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি পাচ্ছে না। এই সময়ে ১২০ টাকা মজুরি দিয়ে কী একটি পরিবার চলতে পারে? শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারের আরও মনোযোগী হতে হবে।’

বাংলাদেশ চা বোর্ডের প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিটের (পিডিইউ) ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ড. এ কে এম রফিকুল হক বলেন, ‘এবার অতীতের চা উৎপাদনের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে বলে আমরা আশা করছি। চলতি বছর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭৪ দশমিক ১৪ মিলিয়ন কেজি। চায়ের জন্য অত্যন্ত সুন্দর প্রাকৃতিক অবস্থা বিরাজ করছে। অনুক‚ল আবহাওয়া ও পরিবেশ, প্রয়োজনীয় বৃষ্টির এই ধারাবাহিকতা চলমান থাকলে এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি চা উৎপন্ন হবে।’

সবকিছু ঠিকটাক থাকলে এবার চা উৎপাদন ৯০ মিলিয়ন কেজি অতিক্রম করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

এনএইচ/আরসি-২২