জকিগঞ্জ প্রতিনিধি
নভেম্বর ২২, ২০২১
০৪:৫০ পূর্বাহ্ন
আপডেট : নভেম্বর ২২, ২০২১
০৪:৫০ পূর্বাহ্ন
স্বাধীন বাংলাদেশের সর্ব উত্তরপূর্বের উপজেলা সিলেটের জকিগঞ্জ। সারাদেশের আগে ২১ নভেম্বর এ উপজেলা সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে হানাদার মুক্ত করে লাল সবুজের পতাকা উড়িয়ে প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু স্বাধীনতার কয়েক যুগ পেরিয়ে গেলেও প্রথম মুক্তাঞ্চলের স্বীকৃতি মেলেনি। প্রথম মুক্তাঞ্চল হিসেবে জকিগঞ্জকে স্বীকৃতি না দেওয়ায় মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস আড়াল করা হচ্ছে বলে দাবি করেছেন এখানকার মুক্তিযোদ্ধারা। এ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভ রয়েছে।
আজ রবিবার (২১ নভেম্বর) ছিল জকিগঞ্জ উপজেলা পাক হানাদার মুক্ত দিবস। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ছাড়াই দিনটি নানা কর্মসূচিতে পালন করেছে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।
এ দিন সকাল সোয়া ১১টায় মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে মুক্তিযোদ্ধারা ও প্রশাসনের পদস্থ কর্মকর্তাগণ জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে ও কেন্দ্রেীয় শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পন করেন। এর আগে সকাল সাড়ে ১১টায় প্রথম মুক্তাঞ্চলের স্বীকৃতির দাবিতে শহরে মুক্তিযোদ্ধারা র্যালি করেন। দুপুর ২টায় একাত্তরের সেইসব দিনের স্মৃতিচারণ করে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর বেলা আড়াইটার সময় তারা মুক্তিযোদ্ধা চত্বরে শান্তি ও সম্প্রীতির মানববন্ধন করেন। তাছাড়াও প্রথম মুক্তাঞ্চলের দাবি আদায়ের লক্ষে ও জনসচেনতা সৃষ্টির জন্য রবিবার থেকে বিজয় দিবস (১৬ ডিসেম্বর) পর্যন্ত পথসভা চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
পৃথক এসব কর্মসূচিতে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও পৌরসভার সাবেক মেয়র খলিল উদ্দিনের সভাপতিত্বে ও মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের.... শফিউল আলম মুন্নার পরিচালনায় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ও বক্তব্য দেন উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভ‚মি) পল্লব হোম দাস, সিলেট জেলা মুক্তিযোদ্ধা ডেপুটি কমান্ডার বীরমুক্তিযোদ্ধা আকরাম আলী, উপজেলা আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক বীরমুক্তিযোদ্ধা মোস্তাকিম হায়দর, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এমএজি বাবর, ওসি তদন্ত সুমন চন্দ্র, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার আব্দুল মোতাল্লিব, সাংগঠনিক কমান্ডার বীরমুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান, বীরমুক্তিযোদ্ধা সোনা মিয়া, উপজেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুস সালাম, পৌরসভা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আব্দুল গনি, প্রবাসী ফজলুর রহমান, উপজেলা কৃষকলীগের সভাপতি আব্দুল আহাদ, উপজেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি বাবর হোসাইন চৌধুরী, পৌরসভা ছাত্রলীগ সভাপতি নুরুল আমিনসহ রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
এ সময় বক্তারা বলেন, নতুন প্রজন্মকে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানাতে হবে। দেশের প্রথম হানাদার মুক্ত এলাকা জকিগঞ্জের গৌরবউজ্জল অধ্যায় ইতিহাসের পাতায় তুলে ধরে মহান মুক্তিযোদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস লালন করতে হবে। জকিগঞ্জকে প্রথম মুক্তাঞ্চলের স্বীকৃতি না দিলে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস লালন করা সম্ভব হবে না। ২১ নভেম্বর জকিগঞ্জ প্রথম শত্রæমুক্ত এলাকা হিসেবে অনেক প্রমাণ রয়েছে। তবুও জকিগঞ্জকে দেশের প্রথম মুক্তাঞ্চলের স্বীকৃতি না দেওয়া দুঃখজনক। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে জকিগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে জকিগঞ্জকে সারাদেশের আগে শত্রæমুক্ত করেছেন। জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনা যাচাই-বাছাই করে জকিগঞ্জকে প্রথম মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করতে মুক্তিযোদ্ধারা দাবি জানান। তারা বলেন, এ দাবি জকিগঞ্জের লাখো মানুষের। নতুন প্রজন্ম মুক্তিযোদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস লালন করতে চায়। তাদেরকে সঠিক ইতিহাস লালনের সুযোগ করে দিতে বক্তারা বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার প্রতি আহবান জানান।
দুপুর ২টায় একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনের স্মৃতিচারণ করে মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, দেশব্যাপী যুদ্ধ শুরুর আগে সিলেটের সীমান্ত উপজেলা জকিগঞ্জকে শত্রæ মুক্ত করার শপথ নেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। প্রয়াত সংসদ সদস্য দেওয়ান ফরিদ গাজী, এমএলএ মরহুম আবদুল লতিফ, এমএলএ আব্দুর রহিম, সেক্টর কমান্ডার চিত্ত রঞ্জন দত্ত, মিত্র বাহিনীর দায়িত্ব প্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার ওয়াটকে, কর্নেল বাগচিসহ মাছিমপুর ক্যান্টলম্যান্টে জকিগঞ্জকে স্বাধীন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ওই পরিকল্পনা ছিল কিভাবে কুশিয়ারা নদীর ওপারে ভারতের করিমগঞ্জের মানুষকে ক্ষতিগ্রস্থ না করে জকিগঞ্জ পাক হানাদার মুক্ত করা যায়। সে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০ নভেম্বর রাতে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী ৩টি দলে বিভক্ত হয়ে প্রথম দল লোহারমহলের দিকে ও দ্বিতীয় দল আমলশীদের দিকে অগ্রসর হয়ে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে। মূল দল জকিগঞ্জের কাস্টমঘাট বরাবর করিমগঞ্জ কাস্টম ঘাটে অবস্থান নেয়। প্রথম ও দ্বিতীয় দল নিজ নিজ অবস্থান থেকে কুশিয়ারা নদী অতিক্রম করে জকিগঞ্জের দিকে অগ্রসর হয়। পাক বাহিনী খবর পেয়ে দিকবিদিক ছুটোছুটি শুরু করে। মুক্তিবাহিনী তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে ভেবে তারা আটগ্রাম-জকিগঞ্জ সড়ক দিয়ে পালাতে থাকে। ইতিমধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় দল জকিগঞ্জ পৌঁছে যায়। মূল দল কুশিয়ারা নদীতে রাবারের বালিশ দিয়ে সেতু তৈরি করে জকিগঞ্জ শহরে প্রবেশ করে। তখন পাক সেনাদের বুলেটে শহীদ হন ভারতীয় বাহিনীর মেজর চমন লাল ও তার দুই সহযোগী। ২১ নভেম্বর ভোরে জকিগঞ্জকে হানাদার মুক্ত করে স্বাধীন বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা ওড়িয়ে দেন মুক্তিযোদ্ধারা। এরপর পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক আটককৃত মুক্তিযোদ্ধাদের জকিগঞ্জ থানা থেকে মুক্ত করা হয়। এ সময় কয়েকজন পাক সেনাকে আটক করা হয়।
তাঁরা বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে জকিগঞ্জ ছিল ৪ নম্বর সেক্টরের অন্তভর্‚ক্ত। অধিনায়ক ছিলেন মেজর চিত্ত রঞ্জন দত্ত। প্রয়াত সাবেক মন্ত্রী এমপি দেওয়ান ফরিদ গাজী ছিলেন এই সেক্টরের বেসামরিক উপদেষ্টা। ৬টি সাব সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন মাহবুব রব সাদী, লে. জহির উদ্দিন ও ক্যাপ্টেন এম.এ.রব।
জকিগঞ্জে প্রথম মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হওয়ার স্মৃতিচারণ করে মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, ২৫ মার্চ অন্ধকার রাতে পাকবাহিনী ঘুমন্ত মানুষের উপর ঝাপিয়ে পড়ার পর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা হয়। পাকিস্থানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর পর ২৭ মার্চ জকিগঞ্জ ডাক বাংলোয় এক গোপন বৈঠকে থানার সকল ইপিআর ক্যাম্পের পাক সেনাদের খতমের সিদ্ধান্ত নেন স্থানীয় মুক্তিকামী নেতৃবৃন্দ। ২৮ মার্চ বীর মুক্তিযোদ্ধা মেকাই মিয়া, চুনু মিয়া, আসাইদ আলী, ওয়াতির মিয়া, তজমিল আলী, মশুর আলী, হাবিলদার খুরশিদ, করনিক আবদুল ওয়াহাব, সিগনালম্যান আবদুল মোতালেব প্রমুখ প্রথমে জকিগঞ্জ ও মানিকপুর ইপিআর ক্যাম্পে অপারেশন চালিয়ে পাক সেনাদের খতম করে জকিগঞ্জে প্রথম মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেন।
ওএফ/আরসি-২২