সিলেট মিরর ডেস্ক
ডিসেম্বর ০৪, ২০২১
১০:৩১ অপরাহ্ন
আপডেট : ডিসেম্বর ০৪, ২০২১
১০:৩২ অপরাহ্ন
নতুন ফর্মুলায় নিয়োগ পরীক্ষায় দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে রাষ্ট্রায়ত্ত জীবন বীমা করপোরেশনে। পরীক্ষার প্রশ্নপত্রেই নির্দিষ্ট প্রার্থীদের জন্য উত্তরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অভিনব এই প্রক্রিয়ায় কর্মচারী পর্যায়ের তিনটি পদের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করা হয়। এর মাধ্যমে ৪০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সিন্ডিকেট। অভিযোগ উঠেছে, জীবন বীমার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জহুরুল হক এ ঘটনার আসল কারিগর। অভিযোগটির প্রাথমিক অনুসন্ধান করে সত্যতা পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
জানা গেছে, করপোরেশনে উচ্চমান সহকারী, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক ও অফিস সহায়ক পদে নিয়োগ দিতে গত ৩-৪ সেপ্টেম্বর এমসিকিউ পরীক্ষা নেওয়া হয়। এরই মধ্যে দুদক ওই সব পদে নিয়োগ পরীক্ষা-সংক্রান্ত নথিপত্র সংগ্রহ করেছে। নথি পর্যালোচনায় দুর্নীতির প্রমাণও মিলেছে। ফলে নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত রাখা হয়েছে।
তবে প্রতিষ্ঠানটির এমডি জহুরুল হক নিয়োগে জালিয়াতির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, সম্প্রতি পাঁচটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে বেসরকারি আহ্ছানউল্লা ইউনিভার্সিটির একটি সিন্ডিকেট জালিয়াতির ঘটনা ঘটিয়েছে। সেটি তারা জীবন বীমায়ও করতে চেয়েছিল। তিনি সেটিকে শক্ত হাতে দমন করেছেন। ওই সিন্ডিকেটই তার বিরুদ্ধে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি ও অর্থ লেনদেনের অভিযোগ করেছে। নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রার্থীর জন্য প্রশ্নপত্রেই অভিনব কায়দায় উত্তরের ব্যবস্থা করার অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, এ বিষয়ে তার জানা নেই।
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, তিনটি পদে এমসিকিউ পরীক্ষায় অত্যন্ত সুকৌশলে প্রশ্নপত্রেই উত্তরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই প্রমাণ এখন দুদকের হাতে। পরীক্ষায় পাস করিয়ে চাকরি দেওয়ার বিনিময়ে যাদের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন হয়েছে, সেসব প্রার্থীর জন্য এই ব্যবস্থা করেছে জীবন বীমা থেকে। জালিয়াতির মাধ্যমে দুর্নীতির এটি একটি নতুন পদ্ধতি। এ ধরনের জালিয়াতির খবর আগে জানা যায়নি। তিনি আরও বলেন, কৌশলে প্রশ্ন ফাঁসের তথ্য অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। দুদকের অনুসন্ধানে এরই মধ্যে জালিয়াতি ও দুর্নীতির সব তথ্য-প্রমাণ বেরিয়ে এসেছে।
জানা গেছে, জীবন বীমায় নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে অর্থ লেনদেনের অভিযোগে দুদকের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ নেয়ামুল আহসান গাজীর নেতৃত্বে গত ১৩ সেপ্টেম্বর অভিযান চালানো হয়। ওই দিন নিয়োগ-সংক্রান্ত যাবতীয় নথি জব্দ করা হয়। নথিপত্র পর্যালোচনা করে কমিশনে একটি অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন এই কর্মকর্তা। কমিশন প্রতিবেদন পরীক্ষা করে অভিযোগটি প্রকাশ্যে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দুদকের উপসহকারী পরিচালক মোহাম্মদ নূর আলম সিদ্দিকী অভিযোগটি অনুসন্ধান করছেন।
দুদকের অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে, ওই নিয়োগ পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে এমডি জহুরুল হকের বিরুদ্ধে তিনটি অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে এমসিকিউ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রের আলাদা সেটকোড রাখা হয়নি এবং প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় পরীক্ষা বন্ধের জন্য দুদকের নির্দেশনা থাকার পরও পরীক্ষা নেওয়া হয়।
তিন নম্বর অভিযোগে প্রশ্নপত্রের মধ্যে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর জানিয়ে দেওয়ার ফর্মুলা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এতে বলা হয়, এমসিকিউ পরীক্ষার যেসব প্রশ্নের ক্রমিক নম্বরের শেষ সংখ্যা ২, ৭ বা ০ (শূন্য), তার উত্তর হচ্ছে 'ক'। যেসব প্রশ্নের ক্রমিক নম্বরের শেষ সংখ্যা ১ অথবা ৫, তার উত্তর 'খ'। যেসব প্রশ্নের ক্রমিক নম্বরের শেষ সংখ্যা ৪, ৮ বা ৯, তার উত্তর 'গ'। যেসব প্রশ্নের ক্রমিক নম্বরের শেষ সংখ্যা ৩ অথবা ৬, তার উত্তর 'ঘ'।
দুদক নিয়োগ পরীক্ষা-সংক্রান্ত জব্দ করা নথি পর্যালোচনা করে জেনেছে, জীবন বীমা করপোরেশনের উচ্চমান সহকারী ১৭৬টি শূন্য পদের বিপরীতে এক লাখ ৬৩ হাজার ২৯২টি আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে পরীক্ষায় অংশ নেন ৬৭ হাজার ৫৮০ জন। মোট ৮০ নম্বরের মধ্যে সর্বনিম্ন ৬৯ নম্বর পেয়ে এক হাজার ১৬০ প্রার্থী উত্তীর্ণ হন।
সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক ১৫৬টি শূন্য পদের বিপরীতে ৭০ হাজার ২৬৮ জনের আবেদন জমা পড়ে। পরীক্ষায় অংশ নেন ২১ হাজার ২২৬ জন। মোট ৮০ নম্বরের মধ্যে সর্বনিম্ন ৬২ নম্বর পেয়ে মোট এক হাজার ৩১৩ জন উত্তীর্ণ হন। অফিস সহায়কের ১৩২টি শূন্য পদের বিপরীতে আবেদন জমা পড়ে ৫৩ হাজার ৭১২ জনের। পরীক্ষায় অংশ নেন ১৫ হাজার ৭৬৫ জন। মোট ৪০ নম্বরের মধ্যে সর্বনিম্ন ৩৪ নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হন ৮৭৫ জন।
পরে উত্তীর্ণ তিন পদের প্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয় গত ১৮ সেপ্টেম্বর। এ পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছিল দুদকের অভিযানের আগে। এই পর্যায়ের পরীক্ষায় কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে কিনা, তা জানা যায়নি। দুদকের প্রকাশ্য অনুসন্ধানে লিখিত পরীক্ষার নথিপত্র সংগ্রহ করে খতিয়ে দেখা হবে বলে সূত্র জানিয়েছে।
সূত্র জানায়, তিনটি পদের জন্য সুরমা, রূপসা ও গোমতী নামে তিন সেট প্রশ্নপত্র তৈরি করা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে আলাদা কোনো সেটকোড ছিল না। গত ১৩ সেপ্টেম্বর দুদকের অভিযান চলাকালে জীবন বীমার এমডি দাবি করেন, সরকারের নিয়ম অনুযায়ী তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। তাদের প্রতিষ্ঠানের আলাদা সেটকোড করে পরীক্ষা নেওয়ার সক্ষমতা না থাকায় প্রতিটি পদে একটি সেটে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে।
দুদক এমসিকিউ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ও উত্তর পর্যালোচনা করে জেনেছে, প্রশ্নপত্রের ক্রমিক নম্বরের শেষ ডিজিট ব্যবহার করে পরীক্ষার আগেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হওয়া প্রার্থীদের জন্য উত্তরের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
নিয়োগ পরীক্ষা বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্বে থাকা এমডি জহুরুল দুদককে জানান, তিনটি পদের লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় করা হয়েছে। গোপনীয়তার স্বার্থে শুধু প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্যরা প্রশ্নপত্র তৈরি করেছেন। ওই কমিটিতে কম্পিউটারে দক্ষ কোনো ব্যক্তি না থাকায় প্রশ্নপত্র তৈরি করার সময় একাধিকবার কপি-পেস্ট করা হয়েছে। এতে কিছুটা বিভ্রাট ঘটতে পারে।
দুদকের অনুসন্ধান টিম সূত্র জানায়, অভিযানকালে সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের বক্তব্য ও জব্দ করা রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তিনটি পদের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের উত্তরের ধরন প্রায় অভিন্ন। দুদক সূত্র বলছে, এই অভিনব উপায়ে প্রশ্ন ফাঁস করে নিয়োগ প্রার্থীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে এই টাকার পরিমাণ ৪০ কোটি হতে পারে।
বি এন-১০