সিলেটে অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে সুলতানি আমলের কীর্তি

উজ্জ্বল ধর, ওসমানীনগর


ডিসেম্বর ১৯, ২০২১
০৫:৫৯ পূর্বাহ্ন


আপডেট : ডিসেম্বর ১৯, ২০২১
০৫:৫৯ পূর্বাহ্ন



সিলেটে অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে সুলতানি আমলের কীর্তি

ওসমানীনগরের বুরুঙ্গা ইউনিয়নের পশ্চিম তিলাপাড়া গ্রামে প্রায় ৬০০ বছরের পুরোনো শিলালিপি, পুরাকীর্তি, শাহী ঈদগাহ, শাহী মসজিদ ও পাঁচটি দিঘি সুলতানি আমলের স্মৃতি আজও বহন করছে। কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে ইলিয়াস শাহী বংশের অপূর্ব নিদর্শনগুলো।

জানা যায়, পশ্চিম তিলাপাড়া গ্রামের সর্বত্র আছে সুলতানি আমলের কীর্তি। গ্রামের উত্তরাংশে শাহ্ আদম কাখী মোক্তার (র.) নামে এক দরবেশের মাজার (যার নামে মোক্তারপুর পরগনা)। মাজারের পূর্ব পাশে তার মা লাড়িবিবি’র মাজার ও ওইস্থানে কনু শাহ্ নামীয় আরও একজন দরবেশের মাজার রয়েছে। বর্তমানে মাজারগুলো নিশ্চিহ্ন হওয়ার উপক্রম। এর দক্ষিণে বিশাল অংশ জুড়ে সুলতানি আমলের চিহ্ন রয়েছে।

আরও জানা যায়, একাধিক স্থানে মাটির নিচে সারি সারি ইটের দেওয়াল। প্রতিটি ইট দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে সাড়ে ৮ইঞ্চি। শাহ্ আদম কাখী মোক্তার (র.) মাজারের উত্তরে রয়েছে শাহী ঈদগাহ। ওই মাজারের দক্ষিণে রয়েছে শাহী জামে মসজিদ ও উড়িশাহ্ (র.) এর মাজার।

গ্রামের এক প্রবীণ জানান, এলাকার লোকজন জঙ্গলবেষ্টিত উঁচু জায়গা খুঁড়ে ইট নিয়ে যাওয়ার ফলে উক্ত জায়গা বর্তমানে সমতল ভ‚মিতে পরিণত হয়েছে।

শাহ আদম কাখী মোক্তার (র.)-এঁর মাজারের পার্শ্ববর্তী তিলাপাড়া শাহী ঈদগাহ কবে নির্মিত হয়েছে তা কেউ বলতে পারেন না। ১৯৫৪ সালে মাজারের দক্ষিণ দিক থেকে উত্তরে এ ঈদগাহ স্থানান্তর করা হয়। পুরো গ্রাম জুড়ে থাকা সুলতানি আমলে নির্মিত ৫টি দিঘির সবগুলোর একই দশা।

শিলালিপির ব্যাপারে এলাকাবাসী জানান, এ অঞ্চলের লোকজন পশ্চিম তিলাপাড়ার বিশাল অংশ জুড়ে থাকা উঁচু জঙ্গলে একটি আয়তাকার পাথরের কাছে দুধ-কলা মানত করতো। উক্ত মানত ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কুসংস্কার বিধায় ১৯৩৪ সালের দিকে বিশিষ্ট আলেম হযরত মাওলানা আব্দুল হক চৌধুরী মোক্তারপুরী এলাকার গণ্যমান্য ব্যাক্তিবর্গ নিয়ে সে পাথরটি সরাতে যান। ১৪ ইঞ্চি প্রস্থ, ৩২ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য, ৭ ইঞ্চি পুরুত্বের উক্ত পাথরটি উল্টিয়ে সেখানে ফার্সি ভাষায় ক্যালিওগ্রাফি দেখতে পেয়ে পাথরটি জঙ্গল থেকে উঠিয়ে আনেন। সে সময় কেউই পাথরের গায়ে লেখার মর্ম উদ্ধার করতে না পারায় এর ছাপ কাগজে তুলে প্রসিদ্ধ ইসলামী বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দে (বর্তমান ভারতে) পাঠানো হয়। দারুল উলুম কর্তৃপক্ষ উক্ত ছাপ মিশরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান। সেখান থেকে আরবীতে অনুবাদ হয়ে আসে। দারুল উলুম কর্তৃপক্ষ তা বাংলায় অনুবাদ করেন।

শিলালিপিতে উল্লেখ রয়েছে ‘খোদা পাক বলিতেছেন, মসজিদসমূহ আল্লাহর ঘর। হযরত মোহাম্মদ (দঃ) বলিয়াছেন-যে ব্যক্তি খোদাপাকের জন্য একটি মসজিদ নিমার্ণ করিবে আল্লাহ তায়ালা তাহার জন্য বেহেশতের ভিতর একখানা ঘর তৈয়ার করিয়া রাখিবেন। সুবিচারক বাদশাহর মন্ত্রী মালিক সিকন্দর এই মসজিদ নির্মাণ করিয়াছেন খিজিরপুর হইতে। মুরখান বাদশাহের পুত্র মাহমুদ শাহ্ তাহার পুত্র বরবক শাহ, তাহারপুর ইউসুফ শাহের রাজত্বকালে তাহার মন্ত্রী মালিক সিকন্দর এই মসজিদ নিমার্ণ করিয়াছেন ৮৮৪ হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসের ১০ তারিখ। এই মসজিদ মালিক সিকন্দর নির্মাণ করিয়াছেন, যে ব্যক্তি এই ওয়াকফ নষ্ট বা স্থানান্তরিত করিবে খোদার নিকট সে মরদুদ বা গাধার বাচ্চা হইয়া যাইবে।’

বাংলা অনুবাদ হয়ে আসার পর দীর্ঘদিন উক্ত শিলালিপি পশ্চিম তিলাপাড়া নিবাসী মোবারক আলী (কালাই মিয়া)র তত্বাবধানে ছিল। ১৯৩৬ সালে পাথর পাওয়ার স্থানে মুলি বাঁশ ও টিন দিয়ে একটি মসজিদ নির্মাণ করে এলাকাবাসী তাতে নিয়মিত নামাজ আদায় করেন।

১৯৫৯ সালে এলাকাবাসী মসজিদটি পাকাকরণ করেন। পশ্চিম তিলাপাড়া মসজিদটি শিলালিপির উপর ভিত্তি করে নির্মিত এবং শিলালিপিতে সুলতানি আমলের কথা উল্লেখ থাকায় এ মসজিদের নাম হয় ‘পশ্চিম তিলাপাড়া শাহী মসজিদ’ (যা বর্তমানে বিদ্যমান)। ২০০১ সালে লোকজনের দেখা স্বার্থে উক্ত শিলালিপিটি শাহী মসজিদের প্রবেশ মুখে রাখা হয়।

ঐতিহাসিক তথ্যাবলী হতে জানা যায়, ১৪৭৯ খ্রীষ্টাব্দে আবু মোজাফ্ফর ইউসুফ শাহের শাসনামলে তিলাপাড়ায় উক্ত মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। বিগত ১৮৬৯ খ্রীষ্টাব্দে সিলেটে উচ্চমাত্রার ভ‚মিকম্প অনুভ‚ত হয়। এ ভ‚মিকম্পে সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন দালান-কোঠা ভেঙে পড়ে। এ ভ‚মিকম্পে পশ্চিম তিলাপাড়ার উক্তকীর্তি সমূহ বিলিন হয়ে যেতে পারে বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা। 

তারপর দীর্ঘদিন অবহেলায় থাকা এ অংশটা জঙ্গলে পরিণত হয়। ১৯০০ সাল থেকে এলাকাবাসী বিস্তীর্ণ এ জঙ্গলকে কবরস্থান হিসেবে ব্যবহার করে আসলে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে এলাকার কিছু ব্যক্তির বাধার কারণে ইদানিং এখানে কবর খনন বন্ধ রয়েছে। উল্লেখ্য, ১৯৭০ সালে এখানে আট হাত লম্বা একটি কবরের সন্ধান পাওয়া যায়। ইটের গাথুনীতে তৈরি উক্ত কবরও সুলতানি আমলের চিহ্ন বহন করে। সে বছর মসজিদের সামনের দিঘির খনন করার সময় মাটির প্রায় ৪ হাত নিচে একটি ঘাট পাওয়া যায়। ১৯৯৫ সালে উক্ত স্থান খুড়ে ইট সংগ্রহ করার সময় একজন দীর্ঘাঙ্গী মানুষের কঙ্কাল পাওয়া যায়। লোকভয়ে সেটি মাটিচাপা দেওয়া হয়। এছাড়াও কয়েক বছর আগেও মসজিদের পার্শ্ববর্তী স্থানে খননের সময় মাটির নিচে ৩৪ ইঞ্চি প্রস্থ একটি চুনসুরকির দেওয়াল পাওয়া গেছে। 

এ ব্যাপারে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের উদ্যোগী হওয়া উচিত বলে মনে করেন ‘বালাগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ বইয়ের লেখক প্রবাসী সাংবাদিক গিয়াস উদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, তিলাপাড়ার পুরো এলাকাজুড়ে সুলতানি আমলের স্মৃতি বিরাজমান। সে বিষয়ে বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন।’

আরসি-০২