জগন্নাথপুরে ভোটের মাঠে ‘পাউন্ড-ডলারের’ ছড়াছড়ি

আলী আহমদ, জগন্নাথপুর


ডিসেম্বর ২৬, ২০২১
০৬:২১ পূর্বাহ্ন


আপডেট : ডিসেম্বর ২৬, ২০২১
০৬:২১ পূর্বাহ্ন



জগন্নাথপুরে ভোটের মাঠে ‘পাউন্ড-ডলারের’ ছড়াছড়ি

আসন্ন ইউপি নির্বাচনে প্রবাসী অধ্যুষিত জগন্নাথপুরে ভোটের মাঠে টাকা বিতরণের প্রতিযোগিতা শুরু  হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে এ অভিযোগ এই উপজেলায় অনেক পুরোনো। এখানে নির্বাচন মানেই টাকা। কেউ টাকা বিতরণ করছেন বেশি, আবার কেউ কম। এখানে টাকা ছাড়া নির্বাচন যেন ভাবাই যায় না। ভোটের দিন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে টাকার খেলায় আরও বেশি মেতে উঠছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। এখানকার লোকজন ভোটের আগের রাতকে ‘ভাগ্য নির্ধারণী রাত’ বলে থাকেন। আবার এই রাতকে ‘কালরাত’ও বলেন অনেকে। 

এবারের নির্বাচনে জগন্নাথপুরের সাতটি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে ৩৭ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দিতা করছেন। এর মধ্যে ২১ জন প্রবাসী প্রার্থী রয়েছেন। অন্যসব প্রার্থীও প্রবাসী পরিবারের। তাই এখানে নির্বাচনে ‘পাউন্ড-ডলারের’ ছড়াছড়ি থাকে।

আগামীকাল রবিবার জগন্নাথপুর উপজেলার সাতটি ইউনিয়ন পরিষদে ভোটগ্রহণ হবে। ইউনিয়গুলো হচ্ছে কলকলিয়া, পাটলী, চিলাউড়া-হলদিপুর, রানীগঞ্জ, সৈয়দপুর-শাহারপাড়া, আশারকান্দি ও পাইলগাঁও। এসব ইউনিয়নে ৩৭ জন প্রার্থী প্রতিদ্ব›িদ্বতা করছেন। এছাড়া সাত ইউনিয়নে সংরক্ষিত পদে নারী প্রার্থী ৮৯ জন এবং সাধারণ সদস্য পদে ২৩৪ জন।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, মনোনয়ন দাখিলের দিন থেকেই টাকাওয়ালা অধিকাংশ প্রার্থী টাকা বিতরণ শুরু করেছেন। মনোনয়ন দাখিলের এ দিন নির্বাচনী শোডাউনের পাশাপাশি প্রার্থীদের সঙ্গে মনোনয়ন দাখিলে আসা কর্মী সমর্থকদের বিরিয়ানি খাওয়ানোর ধুম পড়েছিল। রেস্তোরাঁগুলোতে উপচেপড়া ভিড় ছিল। 

প্রতীক বরাদ্দের পরপরই ভোট কেনার প্রতিযোগিতা চলছে। টাকা বিতরণ নির্বাচনের দিন ভোট প্রয়োগের আগ পর্যন্ত চলবে এমন ধারণা স্থানীয়দের। লোকজনের মুখে শোনা যাচ্ছে একেকটি ভোটের জন্য এক হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে। টাকা ছড়াছড়ির অভিযোগ প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থী একে অপরের বিরুদ্ধে করছেন।

জগন্নাথপুর উপজেলা নাগরিক ফোরাম নেতা রুমানুল হক রুমেন বলেন, ‘জগন্নাথপুরের প্রতিটি নির্বাচনেই টাকার প্রধান্য থাকে। একজন প্রবাসী প্রার্থী কোটি টাকা নির্বাচনে ব্যয় করেন। আসন্ন নির্বাচনেও টাকা ছড়াছড়ির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এতে করে নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘিত হলেও সঠিক প্রমাণের অভাবে সংশ্লিষ্টরা কোনো পদক্ষেপে নিতে পারছেন না।’

জগন্নাথপুরের সাত ইউনিয়নে এবার ৩৭ চেয়ারম্যান প্রার্থীর ২১ জনই প্রবাসী। এর মধ্যে ১৯ জন যুক্তরাজ্যপ্রবাসী, একজন ফ্রান্সপ্রবাসী এবং একজন ইতালিপ্রবাসী। প্রার্থীরা হলেন, কলকলিয়া ইউনিয়নে যুক্তরাজ্য প্রবাসী রফিক মিয়া, পাটলী ইউনিয়নে বর্তমান চেয়ারম্যান যুক্তরাজ্য প্রবাসী সিরাজুল হক, যুক্তরাজ্য প্রবাসী আব্দুল হাই, যুক্তরাজ্য প্রবাসী এনামুল ইসলাম, যুক্তরাজ্য প্রবাসী আতিকুর রহমান, চিলাউড়া হলদিপুর ইউনিয়নে বর্তমান চেয়ারম্যান যুক্তরাজ্য প্রবাসী আরশ মিয়া, যুক্তরাজ্য প্রবাসী আব্দুল মোমিন, যুক্তরাজ্য প্রবাসী ইলিয়াছ মিয়া, রানীগঞ্জ ইউনিয়নে যুক্তরাজ্যপ্রবাসী সাবেক চেয়ারম্যান মজলুল হক, যুক্তরাজ্য প্রবাসী ছালিক মিয়া ও ফ্রান্স প্রবাসী এম সিরাজুল ইসলাম আশিক, সৈয়দপুর শাহারপাড়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থী যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাবেক চেয়ারম্যান আবুল হাসান, যুক্তরাজ্য প্রবাসী মকসুদ কোরেশী, আজহারুল ইসলমা কামালী, মুকিতুর রহমান, ইতালি প্রবাসী আসাদ হোসেন চৌধুরী, আশারকান্দি ইউনিয়নে দলীয় প্রার্থী যুক্তরাজ্য প্রবাসী আব্দুস সাত্তার, যুক্তরাজ্য প্রবাসী জমিরুল হক, যুক্তরাজ্যপ্রবাসী মোহাম্মদ আলী খলকু, পাইলগাঁও ইউনিয়নে বর্তমান চেয়ারম্যান যুক্তরাজ্য প্রবাসী মখলুছ মিয়া ও যুক্তরাজ্য প্রবাসী ফারুক আহমদ। এছাড়াও অপর চেয়ারম্যান প্রার্থীরা প্রবাসী না হলেও তাদের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত প্রবাসীরা দেশে ফিরে প্রচারণা চালাচ্ছেন । 

নির্বাচনে অংশ নেওয়া এসব প্রার্থীদের বেশিরভাগই নির্বাচন মৌসুমে এসে প্রার্থী হন। ব্যতিক্রম ছাড়া বিজয়ী নির্বাচিত প্রতিনিধিরা কিছুদিন থেকেই ভারপ্রাপ্তদের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসে উড়াল দেন। পরাজিত হলে নির্বাচনের পরই পরই দেশ ছাড়েন। 

উপজেলার কলকলিয়া ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ দলীয় চেয়ারম্যান প্রার্থী আলাল হোসেন রানা বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের অনেক প্রবাসী ভোটার রয়েছেন, তারা আমার পক্ষে বা অন্য প্রার্থীরও প্রচারণায় এসে যোগদান করেন, সামাজিক নানা কাজেও তারা অংশ নেন। এজন্য প্রবাসী প্রার্থী নিয়ে বেশি কিছু বলাও যায় না, আবার সহ্যও করা যায় না, আচরণবিধি লঙ্ঘন করে ব্যয় করেন তারা। কিন্তু এই বিষয়ে প্রমাণ দেওয়া কঠিন হয়। আমরা যারা দেশে থেকে সমাজের কাজ করতে চাই, নির্বাচন আসলে তাদের চাপের মধ্যে ফেলে দেন প্রবাসী প্রার্থীরা।’

চিলাউড়া হলদিপুর ইউনিয়নের স্বতন্ত্র প্রার্থী শহিদুল ইসলাম বকুল বলেন, ‘প্রবাসীরা আমাদের আর্থ সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজের পাশাপাশি প্রাকৃতিক এবং কোনো কঠিন পরিস্থিতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখছেন। তবে নির্বাচনি মৌসুমে প্রবাসী প্রার্থীদের হিড়িক পড়ে। নির্বাচনে জয়ী হলে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করে কাউকে ভারপ্রাপ্তের দায়িত্ব তুলে দিয়ে পরিবার ও ব্যবসা দেখতে দেশ ছাড়েন তারা, আর জয়ী না হতে পারলে পরের দিন প্রবাসে চলে যান। নির্বাচনে তাারা অঢেল অর্থ ব্যয় করছেন। এক্ষেত্রে আমরা অসহায়।’

কলকলিয়া ইউনিয়নের স্বতন্ত্র প্রার্থী যুক্তরাজ্য প্রবাসী রফিক আহমদ বলেন, ‘সকল প্রবাসী প্রার্থী এক ধরণের নয়, আমি যদিও প্রবাসী, আমি নাড়ির টানে দেশের মানুষের সেবা করতে এসেছি, টাকা দেওয়ার জন্য বা নেওয়ার জন্য নয়, দেশে কোনো রোজগারের ধান্দাও আমার নেই। এ ইউনিয়নে আমার পিতাও চেয়ারম্যান হয়ে ইউনিয়নবাসীর সেবা করেছেন। আমি চাই মরহুম পিতার মতো মানুষের সেবা করতে।’

জগন্নাথপুর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও রিটার্নিং অফিসার মুজিবুর রহমান বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা কোনো অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

আরসি-০২