উৎস সন্ধানে মগ্নচৈতন্য নাগরীলিপিবিদ মোস্তফা সেলিমের জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

সারা ফেরদৌস


জুন ০৮, ২০২৫
০২:১৩ পূর্বাহ্ন


আপডেট : জুন ০৮, ২০২৫
০২:১৪ পূর্বাহ্ন



উৎস সন্ধানে মগ্নচৈতন্য নাগরীলিপিবিদ মোস্তফা সেলিমের জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য


আজ ৮ জুন, বাংলা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে দিনটি একটি নিরলস, নিবেদিতপ্রাণ চৈতন্যের জন্মদিন। মোস্তফা সেলিম—নাগরীলিপির পুনরুজ্জীবনের কর্মী, মুক্তিযুদ্ধের অনুলিপিকার, লোকজ সংস্কৃতির নীরব গবেষক এই দিনটিকে করে তুলেছেন গভীরভাবে তাৎপর্যময়। বাংলা ভাষার ইতিহাসে তাঁর অবদান যেন ছায়ায় ঢাকা থাকা কোনো দীর্ঘ নদীর মতো—নীরব, গভীর, নিরবচ্ছিন্ন।

১৯৭০ সালের এই দিনেই মৌলভীবাজারের বড়লেখায় জন্মগ্রহণ করেন মোস্তফা সেলিম। পাহাড়, নদী, হাওর আর চা-বাগানের দেশ—এই প্রকৃতি ও লোকজ জীবনের নিবিড় ঘনিষ্ঠতা তাঁর চিন্তাজগতকে রূপ দিয়েছে শিশুকাল থেকেই। তিনি বেড়ে ওঠেছেন মাটির গন্ধে, হারিয়ে যাওয়া গানে, আর লোককথার ছায়ায়। এই পরিবেশই তাঁকে তৈরি করে এক অনুসন্ধানী মানসে, যিনি বিস্মৃত ইতিহাসের স্তূপ থেকে খুঁজে আনেন হারিয়ে যাওয়া স্বর।

নাগরীলিপি তাঁর জীবনের কেন্দ্রস্থলে এসে দাঁড়ায় যেন একটি নীরব বিপ্লবের আহ্বান হয়ে। এই লিপি, যেটি একসময় সিলেট অঞ্চলের মানুষের দৈনন্দিন জীবন, সাহিত্য ও চিঠিপত্রের বাহন ছিল, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শিক্ষানীতির চাপ ও দখলদারি আধুনিকতার কারণে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে বসেছিল। কিন্তু মোস্তফা সেলিম দেখেছেন নাগরীকে শুধুই লিপি নয়, বরং একটি সংস্কৃতির, একটি জনজীবনের জীবন্ত স্মৃতি হিসেবে।

তিনি বছরের পর বছর ঘুরেছেন গ্রামের পর গ্রাম, কুড়িয়ে এনেছেন ধুলোঢাকা পাণ্ডুলিপি, পড়েছেন কষ্টসাধ্য হস্তলিপি, পুনরায় মুদ্রণে এনেছেন পুঁথি। তাঁর গবেষণা ও সম্পাদনায় নাগরী সাহিত্য পেয়েছে এক নতুন আলোকবর্তিকা। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ—'গোলাম হুসনের গান’, ‘সিলেটি নাগরীলিপি সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’, ‘সিলেটি নাগরীলিপির সহজপাঠ’, কিংবা ২৫টি বইয়ের সংগ্রহ ‘নাগরীগ্রন্থসম্ভার’—প্রতিটিই নাগরী ভাষার মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার এক একটি মাইলফলক।              আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর রচিত ‘সিলেটি নাগরীলিপি শিক্ষা’। মোস্তফা সেলিম নাগরীলিপি বিষয়ে নতুন ন্যারেটিভ উপস্থাপন করেছেন। এর মাধ্যমে নাগরীলিপির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট উদ্ভাসিত হয়েছে নতুন মুদ্রায়। নাগরীলিপি প্রচলন ও তার ব্যাপ্তির পেছনের গল্পকে তিনি নতুন সংজ্ঞায় বেধেছেন। নাগরীলিপির আদলে কীভাবে বাংলালিপিকে সংষ্কার করা যায় সেপথও তিনি বাতলে দিয়েছেন তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধে। হাল আমলে সিলেটি নাগরীলিপির যে রেনেসাঁস হয়েছে, তার পথিকৃৎ হচ্ছেন  সাধক-গবেষক মোস্তফা সেলিম।


লেখকের পূর্বের প্রবন্ধ-

ত্রিশূলের শামিয়ানা : কবিতায় প্রতিবাদের অনল স্পর্শ


কিন্তু তাঁর সাধনা এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। তিনি ইতিহাসের আরও গভীরে গিয়ে তুলে ধরেছেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের প্রামাণ্য দলিল। তাঁর লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধে বড়লেখা’ কেবল স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি নয়, বরং একটি জনপদের সংগ্রামচিত্র। পাশাপাশি ‘সাপ্তাহিক জন্মভূমি’ ও ‘সাপ্তাহিক মুক্ত বাংলা’—এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ মুক্তিযুদ্ধকালীন সংবাদপত্রের সম্পাদিত সংকলন তৈরি করে তিনি ভবিষ্যতের জন্য নির্মাণ করেছেন পাঠযোগ্য ইতিহাস।

তাঁর ভ্রমণসাহিত্যও আলাদা গুরুত্বের দাবিদার। ‘বাংলাদেশ ভ্রমণসঙ্গী’ ও ‘ভারত-নেপাল-ভুটান ভ্রমণসঙ্গী’—এই বইগুলো ভ্রমণবৃত্তান্তের বাইরে গিয়ে সমাজ, মানুষ ও সংস্কৃতির এক আন্তরিক নথিপত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিটি গন্তব্যে তিনি খুঁজেছেন মানুষ, খুঁজেছেন হারিয়ে যাওয়া চিহ্ন।


মোস্তফা সেলিম বর্তমানে নাগরী জাদুঘর প্রতিষ্ঠার কাজে যুক্ত রয়েছেন—যেখানে নাগরীলিপিতে রচিত পাণ্ডুলিপি, হস্তলিখিত দলিল, ছবি ও অন্যান্য প্রামাণ্য উপাদান সংরক্ষিত থাকবে। এটি শুধু একটি জাদুঘর নয়, বরং ইতিহাস ও ভাষাচর্চার এক উন্মুক্ত পাঠশালা হবে ভবিষ্যতের জন্য। সহসা বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হবে ‘নাগরীলিপি অভিধান’। এই গ্রন্থের প্রণেতা তিনি। তাঁর সম্পাদনায় ‘এনসাইক্লোপিডিয়া অব সিলেটি নাগরীলিপি’ তৈরির কাজ চলছে।

সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো, তিনি প্রচারের আলোয় থাকেন না। সংবাদপত্র বা ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানো তাঁর অভ্যস্ততা নয়। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন—‘লোকজীবন থেকেই উঠে এসেছি। কাদা মাটি আমার শরীরের কোষে কোষে। এটা আমি ভুলি কী করে!’ এই আত্মোপলব্ধিই তাঁকে গড়ে তুলেছে এক নিঃশব্দ সাধকে, যাঁর কাছে প্রতিটি হারানো চিঠি, প্রতিটি মলিন পাণ্ডুলিপি একটি ভাষার আত্মার মতো।

৮ জুন তাই শুধু একটি জন্মদিন নয়—এটি এক অন্তঃপ্রাণ সাধনার উৎসব। মোস্তফা সেলিম আমাদের শেখান, কীভাবে একক নিষ্ঠায় একটি হারিয়ে যাওয়া ভাষালিপি ফিরে পেতে পারে তার পরিচয়, ইতিহাস ফিরে পেতে পারে তার কণ্ঠস্বর। তাঁর কাজ আমাদের মনে করিয়ে দেয়—যে সংস্কৃতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ও নিষ্ঠায় গড়ে ওঠে, সে-ই টিকে থাকে সময়ের প্রলয়ে।

'শুভ জন্মদিন, মোস্তফা সেলিম।' আপনার নীরব অথচ দীপ্তচেতা পথচলা হোক আমাদের চেতনায় দীপশিখা হয়ে।



………………………

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক