জকিগঞ্জে কোটি টাকার ভোট বাণিজ্যের অভিযোগ

জকিগঞ্জ প্রতিনিধি


জানুয়ারি ১০, ২০২২
০৯:৪০ অপরাহ্ন


আপডেট : জানুয়ারি ১০, ২০২২
০৯:৪০ অপরাহ্ন



জকিগঞ্জে কোটি টাকার ভোট বাণিজ্যের অভিযোগ
৯টি ইউপি নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ

সিলেটের জকিগঞ্জের ৯টি ইউপি নির্বাচনের ফলাফল ভোটারদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। অনেক চেয়ারম্যান ও সদস্য প্রার্থীরা বিতর্কিত নির্বাচনের ফলাফলকে প্রত্যাখান করেছেন। অভিযোগ উঠেছে রিটার্নিং কর্মকর্তা সাদমান সাকিব ও রিটার্নিং কর্মকর্তা আরিফুল হক পুরো উপজেলায় প্রায় কোটি টাকার ব্যালট বাণিজ্য করে সিল মারা, সিল ছাড়া ব্যালট পেপার বিক্রি করেছেন।

ভোট গ্রহণের দুই-তিন আগ থেকে চেয়ারম্যান ও মেম্বার প্রার্থীদের ডেকে ডেকে তাদের অফিসে নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা গোপন বৈঠক করে বিজয়ী করিয়ে দেওয়ার চুক্তি করে বড় অঙ্কের লেনদেন করেন। কেউ তাদের প্রস্তাব গ্রহণ করে আবার কেউ নাকচ করে সুষ্ঠু নির্বাচন চেয়েছিলেন। সেই লেনদেন অনুযায়ী ভোটের দিন সকাল থেকে বিভিন্ন ইউনিয়নের ভোট কেন্দ্রে প্রথমে ব্যালট পেপার কম দেন তারা। পরে ভোট কেন্দ্রে ব্যালট পেপার পৌঁছে দেবার কথা বলে কেন্দ্রে গিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা সাদমান সাকিব ও রিটার্নিং কর্মকর্তা আরিফুল হক সিল মারা ব্যালট পেপার বাক্সে ঢুকিয়ে দেন। ভোট গ্রহণের আগের মধ্যে রাতে প্রত্যাহার করা হয় ভোট কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে।

এমনটা জানিয়েছেন, কাজলসার ইউপির লুৎফুর রহমান স্কুলের ভোট কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মো. মাসুম মিয়া। মাসুম মিয়া উপজেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, ভোটের আগের রাতে তাঁকে কাজলসার ইউপির লুৎফুর রহমান স্কুলের ভোট কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তার দায়িত্ব থেকে অনিবার্য কারণে প্রত্যাহার করা হয়। পরে তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবগত করে রাত ৪টায় ভোট কেন্দ্র থেকে ফিরে আসেন। ভোর বেলা উপজেলার কন্ট্রোল রুমে ব্যালট পেপার বন্টনের সময় তিনি শুনেছেন ব্যালট পেপার কম দেওয়া নিয়ে প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঝগড়া হচ্ছে।

জানাগেছে, নির্বাচনে কিছু কিছু প্রার্থীদের সাথে চুক্তি ছিলো সিল ছাড়া ব্যালট দেবেন। নিজ দায়িত্বে একই সাথে তিনটি প্রতীকের ব্যালট পেপার বাক্সে ঢুকাতে হবে। আবার কারো সাথে চুক্তি ছিলো সিল মেরে বাক্সে ঢুকিয়ে দেবেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা। কাজলসার ইউপিতে নৌকার প্রার্থীর সাথে ১৪ লাখ টাকা চুক্তি হয় বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। সেই চুক্তি অনুযায়ী সিল ছাড়া ব্যালট পেপারও দিয়েছেন কাউকে, আবার কাউকে সিল দিয়ে বাক্সে ব্যালট ঢুকিয়ে দিয়েছেন বলে ব্যাপক অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। ভোট গ্রহণ শেষে একাধিক ভোট কেন্দ্রে নকল সিলযুক্ত ব্যালট পেপার দেখা গেছে বলে একাধিক প্রার্থীর এজেন্ট নিশ্চিত করেছেন।

চেয়ারম্যান ও মেম্বার প্রার্থীরা জানান, দুই রিটার্নিং কর্মকর্তা ছাড়াও তাদের মনোনীত লোকরা জোর করে সিল মারা ব্যালট পেপার ব্যালট বাক্সে ঢুকিয়েছেন। রিটার্নিং কর্মকর্তারা ও তাদের বিশ্বস্থ লোকজন প্রিসাইডিং কর্মকর্তার অফিসে দরজা বন্ধ করে বৈঠকও করেন। এ নিয়ে প্রার্থী ও সমর্থকরা প্রতিবাদ করলে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের তোপের মুখে পড়েন বলে জানিয়েছেন একাধিকজন। সুলতানপুর ইউপির গণিপুর ভোট কেন্দ্রে ব্যালট বাক্সে সিল মারা ব্যালট ঢুকানোর কারণে ভোটাররা উত্তেজিত হয়ে ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নিয়ে পুকুরে নিক্ষেপ করেন। এ কারণে ঐ ভোটকেন্দ্রের ফলাফল স্থগিত করা হয়েছে।

পঞ্চম ধাপের জকিগঞ্জের ৯টি ইউপিতে নানা অনিয়মের অভিযোগে ভোটের দিন ছিলো উত্তপ্ত। অনেক ওয়ার্ডে রহস্যজনক ভোট কাস্টিং নিয়েও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন প্রার্থী ও ভোটাররা। ভোটের আগের দিন থেকে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের ভোট বাণিজ্যের কথা চারিদেকে ছড়িয়ে পড়লে তা নিয়েও চরম ক্ষোভ বিরাজ করছিলো প্রার্থী ও ভোটারদের মাঝে। কিন্তু সেই আশঙ্কার কথা উড়িয়ে দিয়েছিলেন নির্বাচন কর্মকর্তা সাদমান সাকিব ও রিটার্নিং কর্মকর্তা আরিফুল হক। ভোটের দিন সকাল থেকে চুক্তি করা প্রার্থীদের বিজয়ী করার মিশন বাস্তবায়নে মাঠে নামেন রিটার্নিং কর্মকর্তা সাদমান সাকিব ও রিটার্নিং কর্মকর্তা আরিফুল হক।

সব ইউপিতে মিশন বাস্তবায়ন শেষে ৩টা ৪০ মিনিটের সময় কাজলসার ইউপি ২২ নম্বর ভোটকেন্দ্রে কালো রঙের ঢাকা মেট্রো-ঠ ১৩-৭০২৮ গাড়ী নিয়ে পৌঁছান। তখন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তাদেরকে আটক করেন জেলা ম্যজিস্ট্রেট সিলেট, জেলা পুলিশ সুপার সিলেট ও সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা। তখন তাদের গাড়ী তল্লাসি করে চেয়ারম্যান নির্বাচনের ব্যালট পেপার সিলমার ৪০০ টি, সিল ছাড়া ৪০০টি, ইউপি সদস্য নির্বাচনের ব্যালট পেপার সিলমারা ৪০০টি এবং সিল ছাড়া ৪০০টি, মুড়ি বই মোট ৮টি, ব্যালট বাক্সের সিলগালা লক ৮ টি, ফেন্সিডিলের খালি বোতল একটি, নগদ ১লাখ ২১ হাজার ৫শত টাকা, ৪টি মোবাইল সেট পাওয়া গেলে সাথে সাথে কাজলসার ইউপি নির্বাচন স্থগিত করেন জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. শুক্কুর মাহমুদ।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জকিগঞ্জ থানার ওসি তদন্ত সুমন চন্দ্র সরকার কোটি টাকার লেনদেন প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, পুলিশ এখনো তদন্ত করছে। দুই রিটার্নিং কর্মকর্তাকে রিমান্ডে এনে সকল ব্যাপারেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

তবে সাদমান সাকিবকে কারাগারে প্রেরণের আগে থানা হাজত থেকে স্থানীয় এক সংবাদকর্মীকে তিনি জানিয়েছেন, ভোট জালিয়াতির সকল কিছু ফাঁস করতে চান। কারা তাকে দিয়ে জালিয়াতি করিয়েছেন তাদের সবার নাম তিনি প্রকাশ করবেন। একটু সময়ের প্রয়োজন।

এদিকে পঞ্চম ধাপের জকিগঞ্জ উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের পাতানো ভোট গ্রহণের ফলাফল বাতিল করে সুষ্ঠুভাবে পুনঃনির্বাচন করতে শনিবার রাতে সিলেট জেলা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছেন জকিগঞ্জের বেশ কয়েকজন চেয়ারম্যান প্রার্থী। সংবাদ সম্মেলনে প্রার্থীদের পক্ষে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের  চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী ও বর্তমান চেয়ারম্যান মো. মাহতাব হোসেন চৌধুরী।

সকল প্রার্থীদের পক্ষে লিখিত বক্তব্যে বলেন, ৯টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অফিসার ছিলেন সাদমান সাকিব। একই সাথে তিনি জকিগঞ্জ সদর, সুলতানপুর ও বারঠাকুরী ইউনিয়নের রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্বেও ছিলেন। জকিগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসার মো. আরিফুল হক বারহাল ও কাজলসার ইউনিয়নের রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন। সাদমান সাকিব ও আরিফুল হকের অধীনে এসব ইউপির নির্বাচনে প্রকাশ্যে জালিয়াতি হয়েছে। সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে সাদমান সাকিব ও আরিফুল হক মানুষের রায় নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছেন। তারা মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে নিজেদের নির্ধারিত প্রার্থীদের বিজয়ী করতে কাজ করেছেন। তারা খাবারের প্যাকেটের নামকরে ভোট কেন্দ্রে চুক্তিকৃত প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত করতে সিলমারা ব্যালট সরবরাহ করেছেন। তাদের এই অনৈতিক কাজে সহযোগীতা করেছেন প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসারগণ। সরকারী বিভিন্ন দফতরের দায়িত্বশীলরা। এর মাধ্যমে জনরায়কে গলাটিপে হত্যা করা হয়েছে। জালিয়াতি করে জনগণের মনোনীত প্রার্থীকে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই অবিলম্বে জকিগঞ্জ উপজেলার ৯টি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান ও মেম্বারপদে পুনরায় নির্বাচন দাবি করেন। 

অন্যদিকে, রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বেশ কয়েকজন চেয়ারম্যান প্রার্থী ও মেম্বার প্রার্থীরা জেলা সিনিয়র নির্বাচন কর্মকর্তা এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনের কাছে পুনঃনির্বাচন চেয়ে আবেদন দাখিল করেছেন। কোন কোন চেয়ারম্যান ও মেম্বার প্রার্থী পুনঃনির্বাচনের দাবিতে উচ্চ আদালতে রীট মামলা দায়েরের প্রস্তুতিও নিচ্ছেন। প্রার্থীদের দাবি, নির্বাচন কর্মকর্তার অফিসের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করলে গভীর রাত পর্যন্ত কারা আসা যাওয়া করেছেন তাদের তথ্য পাওয়া যাবে। 

এদিকে বারহাল ইউপিতে গত শনিবার মানবন্ধন হয়েছে। মানববন্ধন থেকে বক্তারা প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের ফলাফল বাতিলের দাবি জানিয়েছেন।

সুলতানপুর ইউপির মেম্বার প্রার্থী আব্দুস সাত্তারের দাবি, তাঁর ব্রাহ্মণগ্রাম ভোট সেন্টারে ব্যালট পেপার সঙ্কট ছিলো। পরে সাড়ে ১০টার দিকে রির্টানিম,¦ন কর্মকর্তা শাদমান সাকিব ও আরিফুল হক ভোট কেন্দ্রে একটি ব্যাগ নিয়ে যান। প্রিসাইডিং কর্মকর্তার কক্ষে গোপন বৈঠক করেন। এরপর ভোটগ্রহণের গতি কমিয়ে দেয়া হয়। ভোটাররা লাইনে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে বিরক্ত হয়ে ভোট না দিয়ে ফিরে যান। এরপরও ১৬৬৪ ভোট কাস্টিং দেখানো হয়। রির্টানিম,¦ন কর্মকর্তারা হাতেনাতে ব্যালট ও সিলসহ গ্রেফতারের পরপরই তিনি তার ভোট কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করার দাবি জানান।

কিন্তু এরপরও ভোটগণণা করে পাতানো ফলাফল দেয়া হয়। তাঁর ব্রাহ্মণগ্রাম ভোটকেন্দ্রের ব্যালট পেপারে নকল সিলও দেখা গেছে। ভোটের পরদিন তিনি ভোট কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তার রুমের পেছনে দুটি ব্যালট পেপার কুঁড়িয়েও পেয়েছেন। ব্রাহ্মণগ্রাম ভোট কেন্দ্রে তাকে বিজয়ী করতে ৫ লাখ টাকা দাবি করেছিলেন রির্টানিম,¦ন কর্মকর্তা সাদমান সাকিব। সাত্তার সেই প্রস্তাব প্রত্যাখান করার কারণে অন্য প্রার্থীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাঁর ফলাফল ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। তাছাড়াও রির্টানিম,¦ন কর্মকর্তারা গ্রেপ্তারের পর পুরো উপজেলার বিভিন্ন স্থানে তাৎক্ষণিক ভোট গ্রহণ স্থগিতের দাবিতে বিক্ষোভ হয়েছে। সুলতানপুর ইউপির ভোটকেন্দ্রে ভোট গণণা শেষে কেন্দ্রে ফলাফল দেয়া হয়নি। গতকাল রবিবার পর্যন্ত কোন মেম্বার প্রার্থীই তাদের ফলাফল পাননি। 

এ বিষয়ে জকিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুমী আক্তারের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি একটি অনুষ্ঠানে আছেন বলে এ বিষয়ে কোনো কথা বলেননি।

আরসি-০৬