কুমিল্লা সিন্ডিকেটের জালিয়াতিতে বঞ্চিত হচ্ছেন সিলেটিরা

নিজস্ব প্রতিবেদক


জানুয়ারি ১১, ২০২২
০৫:৪৭ পূর্বাহ্ন


আপডেট : জানুয়ারি ১১, ২০২২
০৫:৪৭ পূর্বাহ্ন



কুমিল্লা সিন্ডিকেটের জালিয়াতিতে বঞ্চিত হচ্ছেন সিলেটিরা

দীর্ঘদিন ধরে কারাগার ঘিরে সক্রিয় ‘কুমিল্লা সিন্ডিকেট’। এরা জালিয়াতির মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছে কারারক্ষীর চাকরি। এতে বঞ্চিত হচ্ছেন সিলেটিরা। 

ভিন্ন ভিন্ন সময়ে কারারক্ষী পদে চাকরির জন্য পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন তিন সিলেটি। কিন্তু তারা কেউই নিয়োগপত্র পাননি। নিয়োগপত্র চলে যায় ‘কুমিল্লা সিন্ডিকেটের’ হাতে। দীর্ঘদিন তারা তিন সিলেটির স্থলে চাকরিও করেন। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে এই জালিয়াতি ধরাও পড়ে যায়। এসব ঘটনায় আলাদা আলাদাভাবে তদন্ত চলছে। 

মাধবপুরের মঈন উদ্দিন খানের চাকরিতে কুমিল্লার মঈন উদ্দিন খান : মাধবপুর উপজেলার শাহজাহানপুর গ্রামের মঈন উদ্দিন খানের চাকরি হয় সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে কারারক্ষী পদে। কিন্তু তার নিয়োগপত্র ‘জালিয়াতির’ পাশাপাশি নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে গত ২০ বছর ধরে চাকরি করছেন কুমিল্লার মঈন উদ্দিন খান। গত নভেম্বরে বিষয়টি ধরা পড়ায় তদন্ত শুরু করেছে সিলেট কারা কর্তৃপক্ষ। তদন্ত কর্মকর্তা উভয় মঈন উদ্দিন খানকে কাগজপত্র নিয়ে সিলেট কারাগারে সশরীরে হাজির হওয়া নির্দেশ দিলে মাধবপুরের মঈন উদ্দিন খান হাজির হয়ে নিজের বক্তব্য জানিয়েছেন। তবে, হাজির হননি কুমিল্লার মঈন উদ্দিন খান। সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার জয়নাল আবেদীন ভুঁইয়া এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। 

স্থানীয় ও কারাসূত্রে জানা গেছে, হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার শাহজাহানপুর ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা নুর উদ্দিন খান মাস্টারের ছেলে মঈন উদ্দিন খান ২০০১ সালে কারারক্ষী পদে চাকরির আবেদন করেন। এরপর যথারীতি কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেন। পরীক্ষা শেষে তার বাড়িতে একাধিক বার প্রয়োজনীয় তদন্ত হলেও তিনি নিয়োগপত্র পাননি। হতাশ হয়ে শেষপর্যন্ত মাধবপুরের মনতলা বাজারে ফার্মেসি খুলে ওষুধের ব্যবসা শুরু করেন। 

মাধবপুরের মঈন উদ্দিন খান বলেন, ‘চলতি বছরের ১২ আগস্ট কারারক্ষী পদে আমি চাকরি করছি মর্মে শাহজাহানপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাবুল হোসেন খানের কাছে সিলেটের কারা উপ-মহাপরিদর্শকের কার্যালয় থেকে একটি চিঠি আসে। বিষয়টি জানার পর গত ১৬ সেপ্টেম্বর মাধবপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছি। এতে বলি, সিলেট কারাগারে কারারক্ষী পদে চাকরি করিন। আমার নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে কে বা কারা চাকরি করছেন আমি জানি না।’

এদিকে, বিষয়টি তদন্ত করে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিতে হবিগঞ্জ কারাগারের সুপারকে নির্দেশ দেন সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের উপ-মহাপরিদর্শক কামাল হোসেন। ওই নির্দেশ অনুসারে হবিগঞ্জের জেল সুপারের পক্ষে জেলার জয়নাল আবেদীন ভুঁইয়া গত ১৬ নভেম্বর উভয় মঈন উদ্দিন খানকে চিঠি দেন। চিঠিতে উভয় মঈন উদ্দিন খানকেই কাগজপত্র নিয়ে সশরীরে ২০ নভেম্বর তদন্ত অনুষ্ঠানে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন। নির্দেশ পেয়ে শাহজাহানপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান পারভেজ হোসেন চৌধুরীসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে কারাগারে হাজির হন মাধবপুরের মঈন উদ্দিন খান। তবে, কুমিল্লার মঈন উদ্দিন খান হাজির হননি। 

কারা সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ সেপ্টেম্বর মঈন উদ্দিন খান ৫ দিনের ছুটিতে যাওয়ার পর ছুটি শেষে আর কর্মস্থলে যোগ দেননি । এরপর গত ২২ সেপ্টেম্বর কাজে যোগ দেওয়ার জন্য মঈন উদ্দিন খানকে চিঠি দেন সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার মুহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন।

এই প্রসঙ্গে মাধবপুরের মঈন উদ্দিন খান বলেন, ‘জালিয়াতির বিষয়টি ফাঁস হয়ে যাওয়ায় আমার ঠিকানা ব্যবহার করে যে মঈন উদ্দিন খান চাকরি করছেন, তিনি স¤প্রতি আমার ফার্মেসিতে এসেছেন। আমাকে দুই লাখ টাকা দিয়ে জালিয়াতির বিষয়টির সমাধান করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি রাজি হইনি। তবে কিভাবে জালিয়াতি করা হয়েছিল, এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কুমিল্লার মঈন উদ্দিন খান আমাকে জানিয়েছেন, নিয়োগপত্র ও যোগদানপত্রে আমার পরিবর্তে তার ছবিসহ জাল কাগজ ব্যবহার করা হয়েছে। ওই ভুয়া কাগজপত্র ও ছবি ব্যবহার করেই তিনি চাকরিতে যোগ দিয়েছেন।’

দোয়ারাবাজারের মুজিবুর রহমানের স্থলে কুমিল্লার মুজিবুর রহমান : ১৯৯৮ সালে কারারক্ষী পদের জন্য নিয়োগ পরীক্ষা দেন সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার হাজিরগাঁওয়ের মুজিবুর রহমান। তিনি উত্তীর্ণও হন। তাকে বলা হয়েছিল ডাকযোগে নিয়োগপত্র পাঠানো হবে। কিন্তু তিনি নিয়োগপত্র পাননি। ২০২০ সালের নভেম্বরে জানা যায়, দোয়ারাবাজারের মুজিবুর রহমানের স্থলে চাকরি করছেন কুমিল্লার মুজিবুর রহমান। তিনি বর্তমানে ফেনী কারাগারে চাকরি করছেন। আর চাকরির জন্য আইনি লড়াই করতে করতে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেছেন আসল মুজিবুর রহমান। এ ঘটনাও তদন্ত হচ্ছে।

মৌলভীবাজারের জহিরুল ইসলামের বদলে কুমিল্লার জহিরুল ইসলাম : মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার জয়পাশা গ্রামের বাসিন্দা জহিরুল ইসলামের বদলে কারারক্ষী পদে চাকরি করছেন কুমিল্লার জহিরুল ইসলাম। সম্প্রতি সিলেটের কারা উপমহাপরিদর্শক কার্যালয় থেকে আসা একটি চিঠির মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পারেন কুলাউড়ার জহিরুল।

জানা গেছে, জহিরুল ইসলামের বয়স এখন ৩৮। সবার কাছে ‘এশু’ নামেই তিনি পরিচিত। জহিরুল ইসলাম এশু কুলাউড়া পৌর শহরের জয়পাশা এলাকার নুরুল ইসলামের ছেলে। বর্তমানে তিনি জয়চন্ডী ইউনিয়নের কামারকান্দি এলাকায় বসবাস করছেন। মাত্র ২০ বছর (২০০৩ সালের প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তি) বয়সে কারারক্ষী পদে নিয়োগ পেতে পরীক্ষা দেন জহিরুল। সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে শারীরিক ফিটনেস এবং লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হন। পরে নিয়োগের বিষয়ে কুলাউড়া থানা থেকে অধিকতর তদন্ত করা হয়। এ পর্যন্ত গল্প শেষ। ওই চাকরির যোগদানপত্র আর পৌঁছায়নি জহিরুলের কাছে।

এদিকে, জহিরুল চাকরির আশা ছেড়ে দেন। সরকারি চাকরির বয়সও একসময় শেষ হয়ে যায়। এরপর স্থানীয় বাজারে কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেন তিনি। এখন তাই দিয়েই চলে সংসার। গত ৮ ডিসেম্বর কুলাউড়া পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জহিরুল ইসলাম খাঁন খছরুর কাছে একটি চিঠি আসে। সিলেটের কারা উপমহাপরিদর্শক কার্যালয় থেকে আসা ওই চিঠি থেকে যায়, জহিরুল ইসলাম এশু একজন সরকারি চাকরিজীবী। কারারক্ষী হিসেবে তার চাকরি হয়েছে ১৮ বছর আগে। তার ক্রমিক নম্বর ২২০১৪।

কুমিল্লার জহিরুল ইসলাম নামে একজন নামপরিচয় ব্যবহার করে কুলাউড়ার জহিরুল খাঁন এশু’র চাকরি করছেন বলে দাবি কুলাউড়ার জহিরুলের। তিনি এখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কারাগারে কর্মরত রয়েছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার মো. ইকবাল হোসেন গণমাধ্যমেক বলেন, ‘জহিরুল ইসলাম নামে একজন ব্যক্তি ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে কারারক্ষী হিসেবে কর্মরত আছেন। তবে প্রকৃত জহিরুল কে সেটি তদন্তের পর জানা যাবে।’

কাউন্সিলর খছরু চিঠিটি পেয়ে একটি প্রত্যয়নপত্রের মাধ্যমে জহিরুল ইসলাম এশুকে জানান। প্রত্যয়নপত্রটি পেয়ে এশু কারারক্ষী পদে চাকরি করেন না এবং তার নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে কে চাকরি করছেন এই বিষয়টি জানিয়ে গত ২৬ ডিসেম্বর কুলাউড়া থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। চাকরি ফিরে পাওয়ার জন্য ২২ ডিসেম্বর সিলেটের ডিআইজি’র সঙ্গে দেখা করে মৌখিক আবেদন এবং ৩ জানুয়ারি সিলেটের কারা উপমহাপরিদর্শক বরাবরে লিখিত আবেদন করেন জহিরুল।

বিষয়টি জানাজানি হলে তদন্ত করে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সিলেটের কারা উপমহাপরিদর্শক মো. কামাল হোসেনকে প্রধান করে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি করা হয়। কমিটির অন্য দুই সদস্যরা হলেন, খাগড়াছড়ি জেলা কারাগারের জেলার এজি মাহমুদ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেল সুপার মো. ইকবাল হোসেন।

জহিরুল ইসলাম পরিচয়ধারী বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কারাগারে কর্মরত রয়েছেন। তার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ি কুমিল্লায়।’ কিন্তু কুলাউড়ার ঠিকানা ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি সিলেট ডিআইজি প্রিজনকে আমার সকল কাগজাদি জমা দিয়েছি। বিষয়টি তারা খতিয়ে দেখবেন।’

ভুক্তভোগী জহিরুল ইসলাম খাঁন এশু বলেন, ‘রহস্যজনক কারণে আমার যোগদানপত্র না আসায় আমি চাকরিতে যোগদান করতে পারিনি। যখন আমার কাছে পৌরসভা থেকে চিঠি আসে তখন আমি এ বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পারি। এখন আমি আমার সেই চাকরি ফিরে পেতে চাই।’

তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব ও খাগড়াছড়ি জেলা কারাগারের জেলার এজি মাহমুদ বলেন, ‘বিষয়টি তদন্তাধীন আছে। জহিরুল ইসলাম নামে যে ব্যক্তি চাকরি করছেন তার প্রকৃত নাম ও ঠিকানা সম্পর্কে আমরা অবগত হয়েছি। যদি একই নামে দুজন হয় তাহলে তদন্ত করে প্রকৃত ব্যক্তি যাতে চাকরি পান আমরা সেটি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে তদন্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।’

এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটির প্রধান সিলেট কারা উপ-মহাপরিদর্শক (ভারপ্রাপ্ত) মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘বিষয়টি তদন্তনাধীন আছে। তদন্ত শেষে বিস্তারিত জানা যাবে।’ 

আরসি-০১