শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় পরিস্থিতির দায় কার?

আহমেদ নূর


জানুয়ারি ১৮, ২০২২
০৫:০০ পূর্বাহ্ন


আপডেট : জানুয়ারি ১৮, ২০২২
০৭:৩১ অপরাহ্ন



শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় পরিস্থিতির দায় কার?

অতীতে এমন সময় গেছেপ্রায়ই সংবাদপত্রের শিরোনাম হতো শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পাস শান্ত। হঠাৎ করেই চার দিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক হলের ছাত্রীরা আন্দোলন শুরু করেন। হল প্রভোস্টের বিরুদ্ধে অশোভন আচরণের অভিযোগে তাঁরা প্রভোস্ট বডির পরিবর্তন চান। আপাতত নিরীহ একটি দাবি। ২৪ ঘণ্টা পর তাঁদের দাবির সমর্থনে আন্দোলনে নামেন তাঁরা। কিন্তু ঘটনার তৃতীয় দিনেও কোনো সুরাহা না হওয়ায় ছাত্রীরা অবরুদ্ধ করেন উপাচার্যকে। আর তাতেই বাঁধে বিপত্তি। উপাচার্যকে মুক্ত করতে ক্যাম্পাসে ডেকে আনা হয় বিপুল সংখ্যক পুলিশ। একপর্যায়ে শটগানের গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে ছাত্রীদের ছত্রভঙ্গ করে উদ্ধার করা হয় উপাচার্যকে। শিক্ষকসহ অনেক শিক্ষার্থী আহত হন। তখনই পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নেয়। একটি মাত্র হলের ছাত্রীদের দাবি-দাওয়ার আন্দোলন হয়ে ওঠে সব শিক্ষার্থীর আন্দোলন। এখন উপাচার্যকেই ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত করে তাঁর অপসারণ চাইছেন শিক্ষার্থীরা।

ঘটনার শুরু গত বৃহস্পতিবার রাতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রভোস্ট বডির পদত্যাগ দাবি করেন হলের ছাত্রীরা। মূল অভিযোগ প্রভোস্টের বিরুদ্ধে। রাত ১০টা থেকে পৌনে তিনটা পর্যন্ত উপাচার্য বাসভবনের সামনে জড়ো হয়ে তাঁদের দাবি উপাচার্যকে জানান। দাবি মাত্র তিনটি। সেগুলো হচ্ছে, প্রভোস্ট কমিটির পদত্যাগ, অবিলম্বে হলের যাবতীয় অব্যবস্থাপনা নির্মূল করা এবং হলে স্বাভাবিক সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিতসহ ছাত্রীবান্ধব প্রভোস্ট কমিটি নিয়োগ দেওয়া। ছাত্রীদের এসব দাবি কর্তৃপক্ষ খুব একটা গুরুত্ব দেননি বলেই মনে হয়। যে কারণে শুক্রবার আবারও আন্দোলনে নামে ছাত্রীরা। ওইদিন সন্ধ্যার দিকে কয়েকজন প্রভোস্টের রুমে ছাত্রীরা তালা দিয়ে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন। রাতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ওই হলে একজনকে ভারপ্রাপ্ত প্রভোস্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়। কিন্তু একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে বলা হয় বর্তমান প্রভোস্টকে প্রত্যাহার করা হয়নি বরং তিনি অসুস্থ এবং ছুটিতে থাকায় ভারপ্রাপ্ত প্রভোস্ট নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এতেই আগুনে ঘি ঢালার মতো পরিস্থিতি হয়। ছাত্রীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। এক পর্যায়ে তাদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনাও ঘটে। যদিও ছাত্রলীগ তা অস্বীকার করেছে।

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অতীতে অনেক বড় বড় আন্দোলন হয়েছে। রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের ব্যানারে হয়েছে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে হয়েছে। রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর মধ্যেও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা তাঁদের দাবি নিয়ে এমন আন্দোলনে খুব একটা নেমেছেনতেমনটি মনে পড়ছে না। কিন্তু হঠাৎ করেই ছাত্রীদের আন্দোলন এতটা গুরুতর পরিস্থিতির সৃষ্টি করল কেন সেটা একটা বিরাট প্রশ্ন।

ছাত্রীরা যে তিনটি দাবি প্রশাসনের কাছে জানিয়ে ছিলেন তা সহজেই সমাধান করা যেত। কিন্তু প্রশাসন সে পথে হাঁটেনি। কিংবা প্রশাসন বিষয়টি পাত্তা না দিয়ে দমন করার চেষ্টা করেছে। আর এটাই হয়েছে সবচেয়ে বড় ভুল। প্রশাসনের ব্যর্থতার কারণেই ছোট বিষয় গুরুতর হয়েছে। এখানেও প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, গ্রুপিং রাজনীতি এবং উপাচার্যের অদূরদর্শিতা দায়ী বলে মনে হচ্ছে।

রবিবার দুপুরে মাত্র তিন ঘণ্টা অবরুদ্ধ ছিলেন উপাচার্য। তাও ছাত্রীরাই তাঁকে অবরুদ্ধ করেছিল। কিন্তু তিনি বা তাঁর প্রশাসন বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে সমঝোতার চেষ্টা না করে সহিংস পথ বেছে নিয়েছিলেন। ক্যাম্পাসে পুলিশ ডেকে এনে ছাত্রীদের ওপর হামলা চালিয়ে উপাচার্যের বেরিয়ে যাওয়ার পথ পরিষ্কার করেছেন। ভাবা যায়, ছাত্রীদের হটাতে লাঠি পেটার পাশাপাশি পুলিশ ৩১ রাউন্ড শর্টগানের গুলি ছুড়েছে! সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়া হয়েছে ২১টি। সাউন্ড গ্রেনেডের বুক কাঁপানো শব্দে পুরো ক্যাম্পাসে এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সিলেটের রাজপথে সশস্ত্র রাজনৈতিক সংঘাতের সময়ও এতগুলো সাউন্ড গ্রেনেড কোনো সময় ছোঁড়া হয়েছে বলে মনে পড়ে না। অথচ এরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এমন আচরণ করতে পারল! শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এর আগে এমনটি ঘটেনি।

এই বিশ্ববিদ্যালয়েই উপাচার্য তখন অধ্যাপক হাবিবুর রহমান। সম্ভবত ১৯৯৯ সাল। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন দাবিতে উপাচার্যসহ শিক্ষকদের প্রশাসনিক ভবনে তালা দিয়ে রেখেছিল। অবরুদ্ধ ছিলেন ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, অধ্যাপক জয়নাল আবেদিন, ড. গৌরাঙ্গ দেবরায়, রেজা ই করিম খন্দকারসহ বিভিন্ন বিভাগের ডিন ও প্রধান। ছাত্ররা গেটে তালা দিয়ে বাইরে আর শিক্ষকরা ভেতরে অবস্থান করছেন। বেলা দুইটার দিকে শিক্ষার্থীরা অবরুদ্ধ করেন তাঁদের। আমি তখন প্রথম আলো-তে কর্মরত। রাত ১০টার দিকে ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখতে পাই শিক্ষকরা অবরুদ্ধ। ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলে উপাচার্যের দপ্তরে গিয়ে দেখতে পাই শিক্ষকরা ক্লান্ত-শ্রান্ত। কিন্তু উপাচার্যের অসীম মনোবল। তিনি কোনো অ্যাকশনে যেতে চান না। শিক্ষকরাও তা-ই। সারাদিন কেউ কিছু খাননি। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সেদিন তাঁদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে পেরেছিলাম। রাত বাড়ে। আন্দোলনকারীরা কেউ কেউ ফিরে যায়। অন্যরা ঘুমে আচ্ছন্ন। ভোর রাতে একদল পুলিশ গিয়ে নির্বিঘ্নে উপাচার্যসহ শিক্ষকদের উদ্ধার করে নিয়ে আসে। গুলি বা গ্রেনেড কেন একটি লাঠিচার্জও করতে হয়নি। ১৯ ঘণ্টা অবরুদ্ধ ছিলেন উপাচার্যসহ শিক্ষকরা। আর ছাত্রীদের আন্দোলনে মাত্র তিন ঘণ্টায় অধৈর্য হয়ে গেল বর্তমান প্রশাসন? এমন ন্যাক্কারজনক পদক্ষেপ নেওয়ার আগে একবারও কি তাদের মনে আসেনিএরা আমাদের ছাত্র, এরা আমাদেরই সন্তান। সন্তান ভুল করতেই পারে, তাই বলে অভিভাবক?

ছাত্রীদের ওপর নির্মম, নৃশংস ও সহিংস যে আচরণ রবিবার ক্যাম্পাসে প্রশাসন দেখিয়েছে তার জবাবও দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। যে পুলিশ দিয়ে শিক্ষার্থীদের পেটানো হয়েছিল সেই পুলিশকে তারা গতকাল ফুল দিয়েছেন। রক্তাক্ত শরীর নিয়ে ফুল হাতে পুলিশকে ক্যাম্পাস ছাড়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। অন্যদিকে হল না ছাড়ার ঘোষণা, ক্যাম্পাসে উপাচার্যকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা দিয়ে প্রশাসনের অবহলো ও দৃষ্টতার জবাবই দিয়েছেন তাঁরা। তবে এটা জবাব নাকি চপেটাঘাত, সেটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যত দ্রুত বুঝতে পারবে ততই মঙ্গল।

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক হাবিবুর রহমান একবার বলেছিলেন, ‘উপাচার্য হতে হলে গন্ডারের চামড়া লাগে।’ এটা একটা কথার কথা। তবে অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনেক। উপাচার্যের অনেক কিছু সহ্য করতে হয়। অনেক কিছু সামলাতে হয়। নানামুখী চাপে অবিচল থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারার সক্ষমতা ও দৃঢ়তা দেখাতে হয়। কিন্তু রবিবার ক্যাম্পাসে যা ঘটে গেল তা সম্পূর্ণ বিপরীত।

কথায় আছে ‘সেই তো নথ খসালি, তবে কেনো লোক হাসালি।’ ছাত্রীদের দাবি অনুযায়ী নতুন প্রভোস্ট নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের পুলিশ দিয়ে না পিটিয়ে প্রথম দিনেই সিদ্ধান্তটি নিলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। তাও দ্বিতীয় দিন যখন ভারপ্রাপ্ত প্রভোস্ট নিয়োগ দেওয়া হয় তখন ‘প্রভোস্টকে প্রত্যাহার করা হয়নি’ বাক্যটিও না বললে চলত। এই অতিকথন ও অতি বাড়াবাড়ির কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম এখন অনিশ্চিত। তুচ্ছ একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ^বিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়ার আগে কর্তৃপক্ষকে করোনাকালীন শিক্ষার ক্ষতি ও সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নেওয়া দরকার ছিল। সেটি করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

গত তিনদিনের ঘটনা খতিয়ে দেখতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আট সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি বিবৃতি দিয়ে এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে। আগের দিনের ঘটনাটিকে ন্যাক্কারজনক আখ্যায়িত করে শিক্ষক সমিতি বলেছে এ ঘটনায় তারা স্তম্ভিত, মর্মাহত ও লজ্জিত। বিবৃতিতে তাঁরা ঘটনাটিকে ‘নারকীয়’ উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।

এখন প্রশ্ন হলো কমিটির কার্যপরিধি নিয়ে। ‘ঘটনা খতিয়ে’ দেখার পরিসর অনেক বড়। আন্দোলনকারীদের নানা দায় থাকতেই পারে। কমিটির সেটা চিহ্নিত করা কঠিন কিছু নয়। কিন্তু সামগ্রিক ঘটনার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা, দায়হীনতা বা অবহেলাও থাকতে পারে। সে বিষয়গুলো কি কমিটি খতিয়ে দেখে দায়ীদের চিহ্নিত করতে পারবে? যদি পারে সেটা হবে অনুকরণীয়। কিন্তু অতীত আমাদের তেমন আশাবাদী করে না।

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অতীতে অনেক তদন্ত কমিটি হয়েছে। কিন্তু দু-একটি ছাড়া কোনোটির প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভবন দাউ দাউ করে জ্বলেছে, কোনো প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। অধ্যাপক হাবিবুর রহমান উপাচার্য থাকাকালে উপাচার্য ভবনে হামলার ঘটনা ঘটেছে। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি। একটি রিপোর্ট জমা হলেও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে কারা বাঁধার সৃষ্টি করেছিলেন ক্যাম্পাসে সবাই জানেন। ড. সালেহ উদ্দিন উপাচার্য থাকাকালে তাঁর বাসভবনে ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনার কোনো তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া গেছে? নগরের মদিনামার্কেট এলাকায় ছাত্রদের দু-গ্রুপের সংষর্ষ চলাকালে মাথা ফেটে রক্ত ঝরেছে তৎকালীন প্রক্টর গোলাম আলী হায়দারের। কোনো তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। এসবের পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। রয়েছে শিক্ষক ও ছাত্র রাজনীতি। সুতরাং তদন্ত কমিটি গঠনের অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়।

বর্তমান উপাচার্য প্রথম মেয়াদ শেষ করে দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালন করছেন। গত চার বছর তো এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। বিচক্ষণতার সঙ্গে সবকিছু সামলে নিয়েছেন। শিক্ষকদের সামলিয়েছেন। ছাত্রলীগকে সামলিয়েছেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সামলিয়েছেন। স্থানীয় রাজনীতিকদের কাউকে কাউকে খুশি করার চেষ্টাও করেছেন। কেন্দ্রীয়ভাবে শিক্ষক রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেওয়ার সুবাদে এখানে তিনি তাঁর নৈপুণ্য দেখিয়েছেন দক্ষতার সঙ্গেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পচা শামুকে তাঁর পা কাটার অবস্থা হলো কেন? হিসাবটা মেলানো খুব কঠিন নয়। তবে একবারে সহজও নয়।

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় অতীতে বহুবার বন্ধ হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ক্যাম্পাস ছেড়ে না যাওয়ার ঘটনা এই প্রথম ঘটল। বিষয়টি বহু ভাবনার জন্ম দেয়। কিন্তু আমরা চাই আজই ক্যাম্পাস স্বাভাবিক হোক। দায়ীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সরকার দ্রুত দ্রুত বিষয়টির সমাধান করবেন, এই প্রত্যাশা করি।

 

লেখক : সম্পাদক, সিলেট মিরর।