শুয়াইব হাসান
ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০২২
০৫:১৭ পূর্বাহ্ন
আপডেট : ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০২২
০৫:১৭ পূর্বাহ্ন
সিলেট বিভাগে প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য অধিদপ্তরে ৮৫৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী পদের বিপরীতে প্রায় পাঁচশ পদ শূণ্য রয়েছে। জনবল সংকটসহ নানা কারণে প্রতিষ্ঠান দুটির কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
ব্যক্তি উদ্যোগে সিলেটে বেশকিছু খামার গড়ে তোলায় এ অঞ্চলে মৎস ও পশুসম্পদের চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে। তবে, সরকারি দপ্তরে সময়মতো কর্মকর্তাদের না পেয়ে প্রত্যাশিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
হাওর-জলাশয় ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরা সিলেটে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উৎপাদনের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও পর্যাপ্ত জনবল না থাকা, যথাযথ পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনা ও দিকনির্দেশনার অভাবে তা কাজে লাগানো যাচ্ছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, সিলেট সূত্রে জানা গেছে, সিলেট বিভাগে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ৫২২টি পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র ২২৭ জন। খালি রয়েছে ২৯৫টি পদ। মোট জনবলের প্রায় ৫৬ ভাগই শূন্য। একইভাবে, মৎস্য অধিদপ্তরে ৩৩৩টি পদের বিপরীতে ১৮৯টি শূন্য রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চার জেলার চিত্র একই। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের বিভিন্ন উপজেলায় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা, ভেটেরেনারি সার্জন, ভেটেরেনারি ফিল্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট, ভেটেরেনারি ফিল্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট (প্রজনন) এর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে জনবল নেই। বিভাগের ৪০টি উপজেলার মধ্যে ১৩টি উপজেলায় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার পদ খালি রয়েছে।
এর মধ্যে, সুনামগঞ্জ জেলার ৭টি উপজেলায় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার পদ শূন্য। সিলেটে ৪টি উপজেলায়, হবিগঞ্জ এবং মৌলভীবাজারের ১টি করে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার পদ শূন্য রয়েছে।
উপজেলা ভেটেরেনারি সার্জনের ৪০টি পদের মধ্যে ১৬টি পদ শূন্য। এরমধ্যে, সিলেট জেলার ৭টি উপজেলা, সুনামগঞ্জের ৪টি, হবিগঞ্জের ২টি এবং মৌলভীবাজারের ৩টি উপজেলা রয়েছে।
ভেটেরিনারি ফিল্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট (ভিএফএ) ১১০টি পদের মধ্যে ৪৯টি এবং ভেটেরিনারি ফিল্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট (কৃত্রিম প্রজনন) ৪৩টি পদের বিপরীতে ১৭টি শূন্য রয়েছে।
এদিকে, লোকবল সংকট, অবকাঠামো সমস্যাসহ নানা করণে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কাজ বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই দপ্তরে মানুষের একমাত্র ভরসা উপজেলা অফিস। সীমিত জনবল দিয়ে পুরো উপজেলায় তাদের সেবা দিতে হয়। এর মধ্যে সৃষ্ট পদের বিপরীতে পর্যাপ্ত লোকবল না থাকায় ব্যহত হয় কার্যক্রম। জানা গেছে, জনবলের অভাবে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাকে কখনও ভেটেরিনারি সার্জনের দায়িত্ব পালন করতে হয়। কখনও ভেটেরিনারি সার্জনকে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করতে হয়। চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি তাদেরকে জেলা ও উপজেলায় বিভিন্ন সভায় বা প্রশিক্ষণে উপস্থিত থাকতে হয়। ভ্যাকসিনেশনসহ বিভিন্ন কাজে ফিল্ডে যেতে হয়। এ সময় উপজেলা অফিস খালি পড়ে থাকে।
সিলেট বিভাগে প্রায় দুই হাজারের বেশি ব্যক্তি মালিকানাধীন পশুর খামার রয়েছে। এর সিংহভাগই সিলেট জেলায়। পাশাপাশি সুনামগঞ্জে গবাদি পশুর খামার, হাস-মুরগির খামার বাড়ছে। বাণিজ্যিকভাবে অনেকে এগিয়ে এলেও সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে পর্যাপ্ত সেবা না পেয়ে হতাশ হচ্ছেন উদ্যোক্তারা।
সিলেট সদর উপজেলায় প্রায় চারশ খামার রয়েছে। সীমিত জনবল দিয়ে এই উপজেলার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। সদর উপজেলা ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাকিল জামান বলেন, ‘সিলেটে কৃত্রিম প্রজনন সংকট প্রকট। একইসঙ্গে, খামারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। উপজেলা পর্যায়ে এক বা দুজন কর্মকর্তা দিয়ে ভালো সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব না। মাঠ পর্যায়ে কর্মী দরকার। দায়িত্বপ্রাপ্তরা সেবা দেওয়ার ব্যাপারে আন্তরিক হলেও মানুষের প্রত্যাশা অনেক।’
সিলেট বিভাগ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক সোহেল আহমদ বলেন, ‘প্রাণিসম্পদের জনবল সংকটের কারণে ভালো সেবা পাওয়া যায় না। জরুরি প্রয়োজনের সময় তাদের দেখা মিলে না। পুরো উপজেলার জন্য একজন সার্জন, কৃত্রিম প্রজনন কর্মকর্তা রয়েছেন। এর মধ্যে অনেক উপজেলায় পদ শূণ্য। এটা খুবই হতাশার বিষয়।’
তিনি বলেন, ‘প্রতি উপজেলায় একজন উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা এবং দুই জন ভেটেরিনারি সার্জনের পদ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। একইসেঙ্গ প্রতি ইউনিয়নে একজন করে কৃত্রিম প্রজনন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া দরকার। এতে খামারিরা উপকৃত হবেন এবং উৎপাদন বাড়বে।’
সিলেট জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. রুস্তম আলী বলেন, ‘জনবল সংকটের বিষয়টি কেন্দ্রে জানানো হয়েছে। আমরা সীমিত জনবল দিয়েও খামারিদের সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি। সমন্বিত উদ্যোগের ফলে সিলেটে কোরবানির সময়ে পশুর চাহিদা স্থানীয়ভাবে মেটানো সম্ভব হয়েছে। সিলেটে দুধের উৎপাদনও ভালো।’
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় পরিচালক ড. অমলেন্দু ঘোষ জানান, প্রাণিসম্পদের ক্ষেত্রে সিলেটের সম্ভাবনা বিপুল। প্রতিদিনই খামারি ও উদ্যোক্তাদের সংখ্যা বাড়ছে। সরকারও প্রণোদনা, সহজ শর্তে ঋণসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে। লোকবল সংকটের বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।
এদিকে, সিলেট মৎস অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বিভাগে ৩৩৩টি পদের বিপরীতে ১৮৯টি শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে সিলেট জেলায় শূন্য পদের সংখ্যা ৫৫, কর্মরত আছেন ৪২ জন। অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত থাকলেও অন্যত্র সংযুক্ত করে পাঠানো হয়েছে।
বিভাগে জেলা ও সিনিয়র মৎস কর্মকর্তার পদ সংখ্যা ৯টি। এর মধ্যে ৪টি পদ শূন্য রয়েছে। সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার ৩৩ পদের মধ্যে ১৮টি, উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার ৩১ পদের মধ্যে ১৩টি, হ্যাচারি অফিসার, মৎস্য প্রকৌশলী ও খামার ব্যবস্থাপকের ৭টির মধ্যে দুইটি শূন্য। সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা, মৎস্য জরিপ কর্মকর্তা ও উপসহকারী প্রকৌশলীর ৪৯ পদের বিপরীতে মাত্র ১৯ জন কর্মরত আছেন। বাকি পদগুলো শূন্য রয়েছে। এছাড়া তৃতীয় শ্রেণির ১৩১টি পদের বিপরীতে ৫৪ জন কর্মরত এবং ৭৭টি পদ শূন্য রয়েছে। চতুর্থ শ্রেণির ৭২ পদের মধ্যে কর্মরত ৪১ জন।
সিলেট জেলা কার্যালয়ে সিনিয়র সহকারী পরিচালক, উপসহকারী পরিচালক, প্রধান সহকারী, কম্পিউটার অপারেটর ও অফিস সহায়কের পদ বর্তমানে শূন্য রয়েছে। উপজেলা অফিসগুলোর মধ্যে বিশ্বনাথ, গোলাপগঞ্জ ও বালাগঞ্জে মৎস কর্মকর্তা নেই। সহকারী কর্মকর্তা নেই ৮ উপজেলায়। ১৩ উপজেলায় ৬৫ পদের মধ্যে ৩৫টিই শূণ্য। খাদিমনগর ও গোলাপগঞ্জে দুটি মৎসবীজ উৎপাদন খামার থাকলেও পর্যাপ্ত জনবল নেই। একজন খামার ব্যবস্থাপককে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে দুটি খামারের কার্যক্রম চলছিল। সম্প্রতি খাদিমনগরে নতুন আরেকজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জের কয়েকটি উপজেলায় মৎস্য কর্মকর্তা ছাড়া আর কোনো লোকবল না থাকায় কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
এ অবস্থার উত্তরণে মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন অধিদপ্তরের সিলেট আঞ্চলিক উপপরিচালক ড. মো. মোতালেব হোসেন। তিনি বলেন, ‘সিলেট অঞ্চলে মাছ উৎপাদনের বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও তা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। জনবল সংকটের কারণে কাজে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। আমরা মন্ত্রণালয়কে বিয়ষটি অবগত করেছি।’
সিলেট অঞ্চলে মাছের উৎপাদন বাড়াতে নানা উদ্যোগ থাকলেও মৎস্য গবেষণা ও উন্নয়নে কোনো প্রতিষ্ঠান না থাকায় অগ্রগতি আশানুরূপ উপায়ে হচ্ছে না বলে মনে করেন তিনি। মৎস কর্মকর্তারা বলছেন, সিলেটে মাছের উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করছেন তারা। তবে, এ জন্য একটি মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট জরুরি। ইউনিয়ন পর্যায়েও লোকবল দরকার। হাওরবেষ্টিত সিলেট অঞ্চলে প্রাকৃতিক মাছ উৎপাদনের বিপুল সম্ভাবনা কাজে লাগাতে জনবল সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা জরুরি বলে মনে করছেন তারা।
আরসি-০১