অফিস বন্ধ করে অভিযানে যান সিলেট ভোক্তা অধিদপ্তর কর্মকর্তারা

শুয়াইব হাসান


মার্চ ১৬, ২০২২
০৫:৩০ পূর্বাহ্ন


আপডেট : মার্চ ১৬, ২০২২
০৫:৩১ পূর্বাহ্ন



অফিস বন্ধ করে অভিযানে যান সিলেট ভোক্তা অধিদপ্তর কর্মকর্তারা
সিলেট ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে জনবল সংকট

ভেজাল পণ্যে বাজার সয়লাব। অসাধু ব্যবসায়ী আর সিন্ডিকেটের কবলে অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে নিত্যপণ্যের বাজার। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। এ অবস্থায় সিলেটের বাজার তদারকিতে যতটা জোর দেওয়া প্রয়োজন তা হচ্ছে না। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সিলেট তাদের সীমিত জনবল দিয়ে বাজার তদারকি জোরালো করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। 

জানা গেছে, অধিদপ্তরের বিভাগীয় অফিসে মাত্র তিনজন কর্মকর্তা থাকলেও নেই কোনো কর্মচারী। অফিসের যাবতীয় কাজ করেন নিজেরা। অফিস বন্ধ করে তাদেরকে অভিযানে যেতে হয়। জেলা পর্যায়ে একজন কর্মকর্তা ও একজন সহকারী দিয়ে কাজ চলছে। আর উপজেলায় কোনো অফিসই নেই। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সীমিত জনবল দিয়েও তারা ভোক্তাসাধারণকে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। নিয়মিত অভিযানের পাশাপশি ভোক্তাদের নানা অভিযোগ নিষ্পত্তি করছেন। জনবল বাড়লে সেবার পরিধি আরও বাড়বে বলে মনে করছেন তারা। 

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সিলেট কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বিভাগীয় অফিসে একজন উপপরিচালক, তিনজন সহকারী পরিচালকের পদ রয়েছে। দুইজন সহকারী পরিচালক দায়িত্ব পালন করলেও একটি পদ খালি রয়েছে। তবে, অফিসে তাদের সহযোগিতার জন্য কোনো সহকারী নেই। একজন গবেষণা সহকারী ও একজন অফিস সহকারীর পদ খালি রয়েছে। প্রতিটি জেলায় একজন করে সহকারী পরিচালক ও একজন করে অফিস সহকারী রয়েছেন। উপজেলা পর্যায়ে তাদের কোনো অফিস নেই। জেলা কর্মকর্তা উপজেলায় উপজেলায় অভিযানে যান। 

রমজান মাস সামনে রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সম্প্রতি একাধিক অভিযান পরিচালনা করেছে ভোক্তা অধিদপ্তর। অভিযানে নেমে ভোজ্যতেলের মূল্য টেম্পারিং, মজুত করে সংকট সৃষ্টি, ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রিসহ নানা অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। বড় অঙ্কের জরিমানাও আদায় হয়েছে। তবু থেমে নেই সিন্ডিকেট ও অসাধু মুনাফালোভীদের তৎপরতা। 

সিলেট ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক শ্যামল পুরকায়স্ত সিলেট মিররকে বলেন, ‘সীমিত জনবল দিয়ে বিশাল এলাকা পর্যবেক্ষণ কঠিন হলেও আমাদের কার্যক্রম আগের চেয়ে অনেক গতিশীল হয়েছে। সম্প্রতি সিলেট বিভাগে ভোজ্যতেলের বাজার তদারকিতে অভিযান পরিচালনা করে ৬৪ প্রতিষ্ঠানকে ৮ লাখ ৮৫ হাজার পাঁচশ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।’

নিয়মিত বাজার তদারকির পাশাপাশি ভোক্তাদের অভিযোগ নিষ্পত্তি করে অধিদপ্তর। প্রতি বছর কয়েকশ অভিযোগ পান তারা। একেক অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে একাধিকবারও বসতে হয়। প্রমাণ পেলে জরিমানা করা হয়। সত্যিকারের অভিযোগকারী নিয়ম অনুযায়ী, জরিমানার ২৫ শতাংশ টাকা পান। এ বছর এ ধরনের ২৮৬টি অভিযোগ এসেছে। তার মধ্যে ৭৬ শতাংশ অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন শ্যামল পুরকায়স্ত। 

এরকম একটি অভিযোগ করেন আতাউর রহমান নামের একজন ভোক্তা। ২০২১ সালে মেয়াদোত্তীর্ণ কেক বিক্রি করে তার ক্ষতি সাধনের অভিযোগ করেন তিনি। প্রমাণ পেয়ে সোবহানীঘাটের খাদ্যপ্রস্তুতকারী এক প্রতিষ্ঠানকে ৮ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। 

শ্যামল বলেন, ‘আমরা নিয়মিত অভিযানের পাশাপাশি অভিযোগ নিষ্পত্তি করি। কোনো কোনো অভিযোগ দ্রুত নিষ্পত্তি করা যায়, আবার কোনোটি সমাধানে সময় লাগে। সীমিত জনবল দিয়ে আমরা সবদিক দেখার চেষ্টা করি।’

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সিলেট জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী পরিচালক আমিরুল ইসলাম মাসুদ জানান, ‘ভোক্তাদের অভিযোগের শেষ নেই। ভোক্তাদের অভিযোগ পেলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করি। সম্প্রতি নগরে একটি কুরিয়ার সার্ভিসের খামখেয়ালিতে একজন সেবাগ্রহণকারী ক্ষতিগ্রস্থ হন। যথাসময়ে সেবা না দেওয়ার অভিযোগের প্রমাণ পেয়ে ওই প্রতিষ্ঠানকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। ২৫ শতাংশ অর্থাৎ ৫ হাজার টাকা ভোক্তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।’

এ ধরনের সেবা দেওয়ার পাশাপাশি একজন কর্মকর্তা দিয়ে সারা জেলা মনিটরিং করে বাজারের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ কঠিন বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘আমি ১৩টি উপজেলার দায়িত্বে আছি। একদিনে এক উপজেলায় গেলেও সবগুলো বাজার একসঙ্গে দেখা সম্ভব হয় না। অভিযানের খবর পেয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা দোকানপাঠ-কারখানা বন্ধ করে চলে যায়। পাশাপাশি জনগণকে সচেতন করার চেষ্টা করি। আইনশৃংখলাবাহিনীর সদস্যরা আমাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেন।’

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সিলেটের উপপরিচালক মো. ফখরুল ইসলাম সিলেট মিররকে বলেন, ‘জনবল সংকট আছে এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবুও আমরা নিজেদের সর্বোচ্চ দিয়ে বাজার তদারকির চেষ্টা করছি।’

তিনি বলেন, ‘যে ব্যবসায়ী ভেজাল খাবার খাওয়াচ্ছেন বা ওজনে কম দিচ্ছেন তার পরিবারও আরেক প্রতিষ্ঠানে প্রতারিত হচ্ছেন। ব্যবসায়ী ও ভোক্তা প্রত্যেকে সচেতন ও সৎ হলে এমনটা হবে না। আমরা সবাইকে এ বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করি।’

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সিলেট সূত্র জানায়, ২০১২ সালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কার্যক্রম শুরু হয়। গত ৯ বছরে ৩ হাজার ৩৪৪টি অভিযানে নানা অভিযোগের প্রমাণ পেয়ে ৯ হাজার ৫২২টি ছোটো-বড় প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করে প্রতিষ্ঠানটি। আদায়কৃত ৫ কোটি ৩৯ লাখ ২২৫ টাকা সরকারি কোষাগারে যোগ হয়। আর চলতি অর্থবছরে অর্থাৎ, ২০২১-২২ বর্ষে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৮ মাসে ১৭৪৪ প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করে প্রায় কোটি টাকা জরিমানা আদায় করেছে তারা। 

সিলেটে প্রথমদিকে বাজার তদারকির জন্য অভিযান কম হলেও সম্প্রতি গতিশীল হয়েছে এর কার্যক্রম। ২০১২-১৩ অর্থবছরে বাজারে ২৮টি অভিযানে ৭৫ প্রতিষ্ঠানকে ৫ লাখ ২৩ হাজার পাঁচশ টাকা জরিমানা করা হয়। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৫৫ অভিযানে ১৫৫ প্রতিষ্ঠানকে ৯ লাখ ২০ হাজার একশ টাকা জরিমানা করা হয়। পরবর্তী বছরগুলোতে পর্যায়ক্রমে অভিযান ও জরিমানার সংখ্যা বাড়তে থাকে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৭৪ অভিযানে ৩১৬ প্রতিষ্ঠানকে ১২ লাখ ৩০ হাজার ৯৫০ টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১১৪ অভিযানে ৫৯৭ প্রতিষ্ঠানকে ১৮ লাখ ৫৪ হাজার টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩৬৯ অভিযানে এক হাজার ১০১ প্রতিষ্ঠানকে ৬৭ লাখ ২৬ হাজার ১৭৫ টাকা এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৩৮২ অভিযানে এক হাজার ৩৫৫ প্রতিষ্ঠানকে ৭৯ লাখ ৩৭ হাজার তিনশ টাকা জরিমানা করা হয়। 

২০১৮ সালের দিকে অফিসের জনবল বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাজার তদারকি জোরালো হয়। ১৮-১৯ অর্থবছরে ৫৬৮টি অভিযান পরিচালনা করে ভোক্তা অধিদপ্তর। এক হাজার ৯২০ প্রতিষ্ঠানকে ৮৪ লাখ ৪৭ হাজার ৬শ টাকা জরিমানা করা হয়। পরের বছর অর্থাৎ, ২০১৯-২০ অর্থবছরে অভিযানের সংখ্যা ছিল এক হাজার ৮৫২টি। জরিমানা আদায় হয় ৮৭ লাখ ৫৫ হাজার একশ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৯০৫ অভিযানে ২ হাজার ১৫১ প্রতিষ্ঠানকে ১ কোটি ৭৫ লাখ ৫ হাজার ৫শ টাকা জরিমানা করা হয়; যা আগের বছরের চেয়ে দ্বিগুণ। 

অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা রোধে ভোক্তা অধিদপ্তরের অফিস ও জনবল বাড়ানো গেলে শহর থেকে গ্রাম পর্যায়ের হাটবাজারগুলোতে নিয়মিত তদারকির সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং জনসাধারণ ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাবেন বলে মনে করছেন কনজুমারস্ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর সিলেট জেলা কমিটির সভাপতি জামিল চৌধুরী।

আরসি-০২