শ্রীহীন পাঁচজনের গ্রাম শ্রীমুখ

বেলাল আহমেদ, বিশ্বনাথ থেকে ফিরে


জুলাই ২৬, ২০২২
০৭:৩৩ অপরাহ্ন


আপডেট : জুলাই ২৭, ২০২২
১১:২২ পূর্বাহ্ন



শ্রীহীন পাঁচজনের গ্রাম শ্রীমুখ
# এশিয়ার সবচেয়ে ছোট গ্রাম # নেই সড়ক যোগাযোগ # দরিদ্রতার আঁচড় সর্বত্র # বিশ্ব রেকর্ডের সুযোগ থাকলেও নেই কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ

চারদিকে ঝোপঝাড়। কাদামাখা পথ পেরিয়ে, জমির আল ধরে হেটে, কোথাও হাটু পানি তো কোথাও কোমর পানি, এসব ডিঙ্গিয়ে দেখা মিলবে এশিয়ার সবচেয়ে ছোট গ্রাম শ্রীমুখের। গ্রামের অবস্থান সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার খাজাঞ্চি ইউনিয়নের এক প্রান্তে। গ্রামটির পশ্চিম প্রান্তে ডোবা ও জলাশয়, পূর্বে ও দক্ষিণে ধানি জমি, উত্তরে বাঁশ-বেতের জঙ্গল। পাকা সড়ক নেই গ্রামটির প্রায় এক কিলোমিটারের মধ্যে। বর্ষায় নৌকা আর কাদাজল মাড়িয়ে এবং হেমন্তে অন্যের বাড়ির উঠান ও ধানি জমি পেরিয়ে যেতে হয় গ্রামটিতে। 

সিলেটের প্রবাসীবহুল বিশ্বনাথের উপজেলা সদর থেকে রামধানা-বন্ধুয়া হয়ে মিনিট ত্রিশ এগোলেই পৌঁছানো যাবে শ্রীমুখ গ্রামে। খাজাঞ্চি ইউনিয়নের তেলিকোনা ও পশ্চিম নোয়াগাও নামক দু’টি গ্রামের মাঝখানে অবস্থান এশিয়ার এ ছোট্ট গ্রামটির। ৬০ শতক আয়তনের এ গ্রামটিতে আছে মাত্র একটি বাড়ি। বাড়ির পূর্বপ্রান্তে ভাঙাচোরা একটি মাটির ঘর। নেই কোনো জৌলুশ। সর্বত্র দরিদ্রতার আঁচড়। 

পরিসংখ্যান ব্যুরোর নথি ও ভোটার তালিকায়ও রয়েছে একটি পরিবার নিয়ে গড়ে ওঠা এই গ্রামের নাম। ভোটার তালিকা অনুযায়ী এ গ্রামের ভোটার সংখ্যা মাত্র তিনজন। জানা যায়, এশিয়ার সবচেয়ে ছোট গ্রাম হিসেবে ইতোপূর্বে কুমিল্লার লালমাই উপজেলার ‘তিলইন’ গ্রামের নাম উঠে এলেও এ গ্রামের জনসংখ্যা ৪০ জন। আর শ্রীমুখ গ্রামের বর্তমান জনসংখ্যা পাঁচজন। এর মধ্যে তিনজন নারী, একজন পুরুষ ও একজন শিশু।

চারদিকে স্তব্ধতা। নীরব। যেন ‘কোথাও কেউ নেই’। বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে হাক-ডাক করলে বেশ কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে আসেন পঞ্চাশোর্ধ এক নারী। নাম তাঁর দিলারা বেগম। তিনি পৈত্রিক সূত্রে এ বাড়ির মালিক সৌদী আরব প্রবাসী আপ্তাব আলীর বোন। জানালেন একাই বাড়িতে আছেন তিনি। আর কেউ নেই বাড়িতে। বাড়িটিতে কে কে থাকেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি, আমার এক বোন, ভাইয়ের স্ত্রী রহিমা বেগম আর ভাইয়ের মেয়ে সপ্তম শ্রেণি পড়–য়া সুমাইয়া আক্তার তাহিয়া (৯)।’ বাড়ির মালিক আপ্তাব আলী দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরবে থাকেন বলেও জানান তিনি। 

গ্রামটির সঙ্গে নেই কোনো সড়ক যোগাযোগ। গ্রামটির বাসিন্দা দিলারা বেগম বলছেন, অনেক সুযোগ সুবিধা থেকেই বঞ্চিত ছিলেন তার। তবে কিছুটা সংকট যেমন বিদ্যুৎ সংযোগ, স্যানিটেশন ও টিউবওয়েল থাকায় সুপেয় পানির সংকট কেটেছে। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় পড়তে হয় তাদের।

তিনি বলেন, ‘আমরার বাড়িত ঢুকার কোনো রাস্তা নাই। বারিসা মাস কোনো সময় হাতরাইয়া কোনো সময় নাওয়ে সড়কও উঠা লাগে। আমার ভাতিঝি মাদরাসাত পড়ে। বাচ্চাটারে পড়ানিত আমরা বউত কষ্ট করা লাগে। এয়ত (হেমন্ত) মাসও ফেখ (কাদা)-পানি থাকে। মাইনসর উঠানেদি গিয়া সড়কও যাওয়া লাগে।’

শত অবহেলা-অনাদর-সংকট, তবুও আশার আলো দেখাচ্ছে এই শ্রীমুখ গ্রাম। দালিলিক কোনো স্বীকৃতি না থাকলেও দেশের তো বটেই, এমনকি বিশ্বেরও সবচেয়ে ছোট গ্রাম শ্রীমুখ বলে দাবি গবেষকদের। তবে স্থানীয় প্রশাসন বলছে, নথিপত্র ঘেঁটে কাগজ-পত্র দেখে স্থানীয়ভাবে আগে প্রস্তুতি নিতে হবে। পরে সবকিছু ঠিক থাকলে গ্রামটিকে সবচেয়ে ছোট গ্রাম হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

এ বিষয়ে বিশ্বনাথ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা নুসরাত জাহান বলেন, ‘আমি গ্রামটি সম্পর্কে জেনেছি। তবে এখনও যাওয়া হয়নি। খুব শিগগিরই গ্রামটি দেখতে যাব। আমি এখানে যোগ দেওয়ার পর থেকে বিভিন্ন কারণে আসলে গ্রামটি দেখতে যাওয়া হয়নি। এর মধ্যে বন্যাসহ নানা কারণে এখনও এই গ্রামটির নথিপত্র ঘাঁটা হয়নি।’

গ্রামটি দেখে আসার পর কাগজপত্র নিয়ে বসব। আগে দেখি স্থানীয়ভাবে কী অবস্থায় আছে। পরে শ্রীমুখ গ্রামকে সবচেয়ে ছোট গ্রাম হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ে চেষ্টা করবÑ যোগ করেন নুসরাত জাহান।

শ্রীমুখের সঙ্গে নেই কোনো সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা প্রশাসনের এ কর্মকর্তা বলেন, ‘এ বিষয়টি আমি জেনেছি। আমাদের প্রকৌশল বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে। তারা এরই মধ্যে শ্রীমুখ গ্রামে সড়ক তৈরির জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তারা একটি প্রাক্কলন তৈরি করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে উচ্চ পর্যায়ে তা পাঠিয়েছেন।’

বিভিন্ন নথিপত্র ঘেটে দেখা যায়, দাগ, খতিয়ান এবং মৌজাসহ সরকারি সকল নথিপত্রে শ্রীমুখ আলাদা গ্রাম হিসেবে উল্লেখ রয়েছে। এর আয়তন ৬০ শতক ও লোকসংখ্যা ৫ জন। ফলে এটি দেশের সবচেয়ে ছোট গ্রাম তো বটেই এমনকি বিশ্বেরও সবচেয়ে ছোট গ্রাম হতে পারে শ্রীমুখ।

বিভিন্ন ওয়েবসাইট ঘেটে দেখা যায়, বিশ্বের সবচেয়ে ছোট গ্রামের নাম ‘হাম’। এ গ্রাম ক্রোয়েশিয়ার বুযেট পৌরসভায় অবস্থিত। এ গ্রামের জনসংখ্যা ৩০ জন এবং আয়তনে শ্রীমুখ থেকে অনেক বড়।

বিশ্বের সবচেয়ে ছোট গ্রাম হিসেবে শ্রীমুখের স্বীকৃতি আদায়ের উদ্যোগ গ্রহণের তাগিদ সচেতন মহলের। এ উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে যেমন বাংলাদেশের নাম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে তেমনি গ্রামটি দেখতে বাড়বে পর্যটকদের আনাগোনা, এমনটাই বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে স্থানীয় সাংবাদিক জাহাঙ্গীর আলম খায়ের বলেন, ‘বিশ্বের সবচেয়ে ছোট গ্রামের স্বীকৃতি আদায়ে সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। এমন একটি রেকর্ড আমাদের করে নিতে পারলে নামটি বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে এবং এতে গ্রামটি দেখতে অনেক পর্যটক আসবেন। অর্থনৈতিকভাবেও লাভবান হবেন সংশ্লিষ্টরা।’

শ্রীমুখ নিয়ে গবেষণা করেছেন সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. জহিরুল হক শাকিল। তিনি সিলেট মিররকে বলেন, সিলেট হচ্ছে পর্যটনের একটি ব্রান্ডিং। এই শ্রীমুখ বিশ্বের সবচেয়ে ছোট গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেলে বিশ্বের অনেক পর্যটক গ্রামটি দেখতে আসতেন। আমাদের পর্যটনখাতে নতুন পালক যুক্ত হতে পারতো।’ এটি একটি ঐতিহ্য। বিশ্বের ছোট গ্রামের স্বীকৃতি আদায় এবং এই ঐতিহ্যকে ছড়িয়ে দিতে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। 

‘মজার তথ্য হচ্ছে আদম শুমারি বা পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী এ গ্রামের বাসিন্দা পাঁচজন। নির্বাচন কমিশনের হালনাগাদ ভোটার তালিকা অনুযায়ী এই গ্রামে ভোটার মাত্র তিনজন। ভ‚মি রেকর্ডের তথ্য অনুযায়ী শ্রীমুখ নামে একটি মৌজা এবং গ্রাম আছে; যেখানে ভ‚মির পরিমাণ মাত্র ৬০ শতক। এমন চমকপ্রদ তথ্য থাকার পরও আমরা কোনো উদ্যোগ নিচ্ছি না। এটা হতাশার।’ -যোগ করেন জহিরুল হক শাকিল।    

শ্রীমুখকে বিশ্বের ছোট গ্রাম হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের পদক্ষেপগুলো কী? এমন প্রশ্নের জবাবে ড. জহিরুল হক শাকিল বলেন, ‘গিনেজ বুক অব রেকর্ডসের একটি ওয়েবসাইট আছে। যেখানে যে কেউ তথ্য দিতে পারবে। তবে এ ক্ষেত্রে পরবর্তী ধাপগুলো হচ্ছে দলিলাদি দেওয়ার। যেমন শ্রীমুখই যদি ধরেন তাহলে পরিসংখ্যান ব্যুারোর হালনাগাদ হিসেবের দলিল। হালনাগাদ ভোটার তালিকা এসব লাগবে। ভ‚মি দপ্তরের কাগজপত্র।’

তিনি বলেন, ‘আমি যে তথ্যগুলো বললাম আবেদনের জন্য এ তথ্যগুলোই কিন্তু যথেষ্ট। এ ক্ষেত্রে সরকারের যে কোনো কর্তৃপক্ষই কিন্তু আবেদন করতে পারবেন। কাগজপত্রগুলো উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ভ‚মি কর্মকর্তা বা জনপ্রতিনিধিকে দিয়ে সত্যায়িত করে আপলোড করে আবেদন করতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে এ উদ্যোগ নিলে ভালো।’ 

আবেদনের সময় গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ড কর্তৃপক্ষ সাক্ষী চায় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সাক্ষী হতে পারেন ইউএনও, ভ‚মি সম্পর্কিত কর্মকর্তা বা যে কোনো জনপ্রতিনিধি। তারা যে কোনো গবেষকের মতামত চায়। এ ক্ষেত্রে এ গ্রাম নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন, যেমন কোনো বিশ্ববদ্যিালয়ের শিক্ষক বা গবেষকের মতামত নিয়ে আপলোড করলেই হয়। যে কেউই এ আবেদন আপলোড করতে পারবে। তবে যেহেতু এটি রাষ্ট্রের বিষয় এবং গিনেজ বুক অব রেকর্ড কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। তাই প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউ যদি এটি আপলোড দেন তখন অন্য কোনো দলিল দাবি করলে সেগুলো দেওয়া সহজ হবে।’  

শ্রীমুখের গোড়াপত্তন নিয়ে কথা হয় পশ্চিম নোয়াগাও গ্রামের সত্তরোর্ধ্ব নূর মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সঠিকভাবে এ গ্রামের গোড়াপত্তন কবে হয়েছিল বলা যাবে না। তবে মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকে এখানে বসবাস করতেন আপ্তাব আলীর দাদা। শুনেছি ব্রিটিশ আমলে এখানে একটি হিন্দু পরিবার বসবাস করতো। পরে তারা অন্যত্র চলে যায়। এ সময় পাশের পশ্চিম নোয়াগাঁও গ্রামের মরহুম হাবিব উল্লাহ এই বাড়িটি ক্রয় করেন। পরে শ্রীমুখ গ্রামের বাড়িটি হাবিব উল্লাহ তার মেয়ে কটাই বিবিকে দান করেন। এরপর কটাই বিবি স্বামী আব্দুর রহমানকে নিয়ে এ বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। কটাই বিবি ও তার স্বামী মারা যাওয়ায় পর ছেলে আপ্তাব আলীর পরিবার বর্তমানে এ বাড়িতে আছে।’

গ্রামটির উন্নয়নে সরকারি উদ্যোগের দাবি জানালেন এই বৃদ্ধ। তিনি বলেন, ‘গ্রামের নাম ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই দেখতে আসেন। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হলে এ গ্রামের বাসিন্দাদের যেমন উপকার হবে, তেমনি আমরাও অনেক উপকৃত হতাম।’

শ্রীমুখ হবে বিশ্বের সবচেয়ে ছোট গ্রাম। নাম লেখাবে গ্রিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে এমনটাই দাবি স্থানীয়দের। এ বিষয়ে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. মোবারক হোসাইন বলেন,‘খোঁজ নিতে হবে। দেখতে হবে এর চেয়ে বিশ্বে আর কোনো ছোট গ্রাম আছে কী না। এটা আমি দেখব। বিশ্বনাথ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকেও বলব খোঁজখবর নিয়ে কাগজপত্র পাঠিয়ে দিতে। তাহলে আমি সেগুলো নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারব। বিশ্বে যদি এরচেয়ে ছোট গ্রাম না থাকে তাহলে আমরা প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করব।’

বিএ-০৩