চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে উত্তাল শ্রীমঙ্গল'

গোলাম কিবরিয়া, শ্রীমঙ্গল প্রতিনিধি


আগস্ট ১৩, ২০২২
১০:৪৯ অপরাহ্ন


আপডেট : আগস্ট ১৪, ২০২২
০৯:২২ অপরাহ্ন



চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে উত্তাল শ্রীমঙ্গল'
পালন করা হচ্ছে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট

চা শ্রমিক জনতা, আমরা সবাই একতা "চা শ্রমিক, চা শ্রমিক, এক হও, লড়াই কর", ৩০০ 'টাকা মজুরি, দিতে হবে দিতে হবে',  মালিক পক্ষের টালবাহানা,  চলবে না,  চলবে না" 

আজ শনিবার (১৩ আগষ্ট) মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে জেরিন চা বাগান, ভাড়াউড়া চা বাগান, ফুল ছড়া চা বাগান, সোনাছড়া চা বাগান, রাজঘাট চা বাগান, খেজুরি ছড়া চা বাগান, খাইছড়া চি বাগানসহ ৪২টি চা বাগানে এরকম শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে। 

১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা  করার দাবীতে চা শ্রমিকদের অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের প্রথম দিনে গতকাল তাল হয়ে ওঠে শ্রীমঙ্গল উপজেলা। শুধু শ্রীমঙ্গলে নয় দেশের চট্রগ্রাম সিলেটসহ ২৩১ টি চা বাগানে ৩০০ টাকা মজুরির দাবীতে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট করছেন শ্রমিকরা।

শ্রীমঙ্গল উপজেলার বেশ কয়েক জায়গায় ঘুরে দেখা যায় আন্দোলনরত চা শ্রমিকরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে মহাসড়কে নেমে পড়েন। এমন চিত্র দেখা যায় শ্রীমঙ্গল শহরের চৌমোহনা চত্বরে, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সাতগাঁও চা বাগান এলাকায় ও ভৈরবগঞ্জ বাজারে। এদিকে ভাড়াউড়া চা বাগানের শ্রমিকরা

সড়ক অবরোধ করে প্রায় এক ঘন্টা অবস্থান করেন। এতে সড়কের চারিপাশে যানজটের সৃষ্টি হয়। পরে শ্রীমঙ্গল থানা পুলিশের হস্তক্ষেপে মহাসড়ক থেকে শ্রমিকদের সরে যেতে দেখা গেছে।

সমাবেশে আসা নারী চা শ্রমিক উষা রানী বলেন, আমাদের দুঃখ কেউ বুঝে না। আমরা ৪ দিন ২ঘন্টা করে কর্মবিরতি করেছি। কিন্তু কেউ আমাদের এসে আশ্বাস দিলো না। আমরা এত কষ্ট করে কাজ করি কিন্তু আমাদের নায্য মজুরি দেয়া হয় না।  চাল ডাল, তেল, মসলা সব কিছুর দাম বেড়েছে। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ আছে, অসুখ হলে চিকিৎসা করাতে হয়, প্রতিদিনই জিনিসের দাম বাড়ছে। কিন্তু আমাদের মজুরি বাড়ছে।

জেরিন চা বাগানের আরেক নারী শ্রমিক সাদরমনি বলেন, আমরা সকাল থেকে সন্ধা অনেক কাজ করি। আমরা রোদে পূড়ে বৃষ্টিতে ভিজে কাজ করি। আমাদের দাবী জানানোর আগেই বাগান মালিকদের উচিত আমাদের খোজ খবর নিয়ে সুযোগ সুবিধা দেয়া। আমরা কাজ ফেলে কেন আন্দোলন করবো। দুই বছর আগে যে জিনিস ১০০ টাকায় পাওয়া যেতো এখন সেটা ২০০ টাকা। আমাদের তো আলাদা কোন রোজীর ব্যবস্থা নাই। এটা তো বাগান মালিকরা জানে। আমরা ছেলেমেদের আশা পুরন করতে পারি না। ভালো জামাকাপড় কিনে দিতে পারি না। যখন ছেলে মেয়ে এসে বলে অমুক ভালো জামা পড়েছে আমাকে কিনে দেও, তখন মনের ভিতর আঘাত পাই। ছেলেমেয়েদের জীবন আমাদের কষ্টের জীবনের সাথে মিশে গেছে। আমরা চাই চা বাগান ভালো থাকুক আমরাও ভালো থাকি। কিন্তু বাগান মালিকরা ভালই আছে, আমরা ভালো নেই। আমাদের দাবি না মানলে আমরা আন্দোলন বন্ধ করব না, আন্দোলন চলছে চলবে।


জেরিন বাগান পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি নিতাই গোয়ালা  বলেন, একটা ভালো সমাধান দরকার। পৃথিবীর বড় বড় সমস্যার সমাধান হয়েছে। চা শ্রমিকদের এই দুর্দশার সমাধান কেন হবে না। আন্দোলনের আজ ৫ম দিন। মজুরি বৃদ্ধির দাবীতে আমরা গত ৪ দিন ধরে দুইঘন্টা করে কর্মবিরতি করে আসছি। মালিক পক্ষ থেকে কোন সারা আসে নি, তাদের টনক নড়ে নি। চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা দেয়ার জন্য আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা দুই বছর আগ থেকে দাবী জানিয়ে আসছে। কিন্তু ১৯ মাস গত হয়ে গেলেও দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী  মালিক পক্ষ মজুরি বৃদ্ধির ব্যাপারে গড়িমসি করছে। তারা মাত্র ১৪ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। এই দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত উর্ধগতির বাজারে মাত্র ১৪ টাকা দিয়ে শ্রমিকদের আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না। আমরা আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাবো। 

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও বালিশিরা ভ্যালী সভাপতি বিজয় হাজরা বলেন, আমরা গত মঙ্গলবার থেকে ৪ দিন দুইঘন্টা করে কর্মবিরতি পালন করছি ৩০০ টাকা মজুরির দাবীতে।  কিন্তু মালিক পক্ষ আমাদের এই কর্মবিরতি পাত্তাই দেয় নি। মালিক পক্ষের কোন সারা মিলেনি। আজ আমরা আমাদের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট করছি।  দেশের ২৩১ টি চা বাগানে এই ধর্মঘট পালিত হচ্ছে। ৩০০ টাকা মজুরি বৃদ্ধি না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাবো। আন্দোলন কঠোর থেকে কঠোর হবে। আমাদের বিভিন্ন বাগানে চা শ্রমিকরা একত্রিত হয়েছি। সব বাগানে বাগানে সমাবেশ হবে। আমরা  শ্রীমঙ্গল শহরে বিক্ষোভ মিছিল বের করেছি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে স্মারকলিপি প্রদান করবো।

শ্রমিক নেতারা আরো বলেন, আজ বাংলাদেশের চা শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজ নিজ এলাকায় আন্দোলন করছেন। আমাদের দাবী না মানলে আমরা ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করবো। আমরা ঢাকা শহরে চা শ্রমিকরা অবস্থান নিবো।

সমাবেশ শেষে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সহ সভাপতি পংকজ কন্দ সাংবাদিকদের বলেন, আমরা  রোববার ও আগামী সোমবার (জাতীয় শোক দিবস) উপলক্ষে আন্দোলন স্থগিত করেছি। আগামীকাল সভা, সমাবেশ , বিক্ষোভ মিছিল হবে না। রোববার ও সোমবার চা বাগানে ছুটি থাকায় কাজ বন্ধ থাকবে। আগামী মঙ্গলবার থেকে আবারও ধর্মঘট চলবে।

বাংলাদেশীয় চা সংসদের সিলেট বিভাগের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ শিবলী  বলেন, মালিক পক্ষের সাথে শ্রমিকপক্ষের আলোচনা কালে এভাবে কাজ বন্ধ করে আন্দোলন করা বেআইনি, এ আন্দোলন শ্রম আইনের পরিপন্থী। আমরা আশা করছি তারা আন্দোলন বন্ধ করে কাজে যোগ দিবে। এখন চা বাগানে ভরা মৌসুম। কাজ বন্ধ রাখলে সবার ক্ষতি। তারাও 

এই সিজনে কাজ করে বাড়তি টাকা উপার্জন করেন।

আন্দোলন চলাকালীন অবস্থায়  নিরাপত্তা জোরদারে কঠোর অবস্থানে ছিলেন শ্রীমঙ্গল থানা পুলিশ।


এএফ/০১