যেভাবে প্রযুক্তিহীন প্রাচীন কৌশলে ইসরায়েলকে বোকা বানিয়েছিল হামাস

সিলেট মিরর ডেস্ক


অক্টোবর ১০, ২০২৩
১১:৫৯ অপরাহ্ন


আপডেট : অক্টোবর ১১, ২০২৩
০২:১৪ অপরাহ্ন



যেভাবে প্রযুক্তিহীন প্রাচীন কৌশলে ইসরায়েলকে বোকা বানিয়েছিল হামাস


বিশ্বের অন্যতম কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে থাকা দেশের মুখোমুখি হতে সবচেয়ে প্রাচীন কৌশল বেছে নিয়েছে হামাস। গত শনিবার ইসরায়েলের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত করে দিয়ে জল, স্থল ও আকাশ পথে হামলা চালিয়ে দেশটির ভেতরে ঢুকে পড়ে ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা। 

ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থার একটি হিসেবে পরিচিত। আর গাজা উপত্যকাও মিসরের পাশে অবস্থিত, বিশ্বের সবচেয়ে কড়া নজরদারিতে থাকা একটি স্থান। সেখানের সব ধরনের ফোনকল রেকর্ড করা হয়। স্যাটেলাইটগুলো প্রত্যেক পদক্ষেপের ওপর নজর রাখে। ওয়াশিংটন ডিসি থেকে দ্বিগুণ বড় এ এলাকার ২৩ লাখ বাসিন্দার ওপর নজর রাখে বহু গোয়েন্দা। 

হামাস কোন কোন ব্যর্থতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে চতুরতার সঙ্গে এ হামলা চালিয়েছে তা খুঁজে বের করতে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের বহু বছর লেগে যেতে পারে। চলমান এ যুদ্ধাবস্থায় এখন পর্যন্ত উভয় পক্ষে মোট ১ হাজার ৭০০ জন নিহত হয়েছে, আটক হয়েছেন আরও অনেকে। 

তবে এরই মধ্যে হামাসের এ নজিরবিহীন হামলার গোপন কৌশল সামনে আসা শুরু হয়েছে বলে দাবি করছেন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল এবং অন্যান্য দেশের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তারা। 

বোঝাই যাচ্ছে, ইসরায়েলের নজর এড়িয়ে যেতে হামাস প্রযুক্তির ব্যবহার এড়িয়ে গেছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর যেকোনো ক্ষেপণাস্ত্র হামলা প্রতিরোধ করার আত্মবিশ্বাসেরও সুযোগ নিয়েছে হামাস। 

ইসরায়েলের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক উপ–মহাপরিচালক বেথ স্যানার বলেন, ‘আমার সন্দেহ এ কড়া নিরাপত্তার মধ্যেও শত শত প্রশিক্ষিত, বিশাল পরিমাণ গোলাবারুদ নিয়ে হামাস এ আকস্মিক হামলা চালাতে পেরেছে, কারণ তারা প্রাচীন কৌশল অবলম্বন করেছিল।’ 

স্যানার বলেন, ‘আমার সন্দেহ এ বিষয়ে তারা কখনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে আলাপ–আলোচনা করেনি। তারা এ পরিকল্পনা ছোট ছোট অংশে ভাগ করে ফেলে এবং আলাদা আলাদা বৈঠক করে। প্রত্যেক গ্রুপের জন্য আলাদা আলাদা কাজ নির্দিষ্ট ছিল। কীভাবে প্রতিটি অংশ সম্পূর্ণ পরিকল্পনায় পরিণত হয়েছে তা খুব কম মানুষই বুঝতে পেরেছিল।’

শনিবার ভোরে সূর্যোদয়ের সময় হাজারখানেক হামাস যোদ্ধা প্রতিরক্ষা বেড়া ভেঙে ইসরায়েলে ঢুকে পড়ে এবং গ্রাম ও শহরে ছড়িয়ে পড়া শুরু করে। এ ছাড়া আরও অনেক সৈন্য প্যারাগ্লাইড ব্যবহার করে দেশটিতে হানা দেয় এবং হাজার হাজার রকেট ছোড়া শুরু করে। 

ইসরায়েলের গোয়েন্দা কর্মকাণ্ড নিয়ে অবহিত এক ব্যক্তি বলেন, এ আক্রমণের সফলতার কারণ হলো, হামাস সংগঠনের ভেতরে গাজার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর উচ্চমানের মানব সূত্রের অভাব। 

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক ও জাতীয় সন্ত্রাস দমন কেন্দ্রের সাবেক প্রধান অ্যান্ড্রু বোরিনের অনুসারে, সম্ভবত সংগঠনটি সম্পূর্ণ এনক্রিপ্টেড প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে। তিনি বলেন, ‘আমার বিশ্বাস এখানে কোনো ডিভাইস ব্যবহার করে গোপন যোগাযোগের বিষয় জড়িত আছে।’ 

ইসরায়েলের ৮২০০ ইউনিটের সাবেক সদস্য অ্যালন আরভাজ ইসরায়েলের সামরিক সিগন্যালের গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তিনি বলেন, এটি স্পষ্ট, হামাস মোবাইল ফোন ও ই–মেইল যোগাযোগের ক্ষেত্রে ইসরায়েলের নজরদারি এড়িয়ে যেতে পেরেছে।

আরভাজ বলছেন, ‘তাঁরা অবশ্যই তথ্য কীভাবে সংগ্রহ করা হয় তা জানতে পেরেছে এবং কীভাবে তা এড়িয়ে যেতে হবে তাও শিখে নিয়েছে।’ 


হামাস বাস্তবিক অর্থেই আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গিয়েছিল

ইসরায়েলি গোয়েন্দার আড়িপাতা প্রযুক্তির ব্যবহার এড়িয়ে যাওয়ার পাশাপাশি এর স্যাটেলাইট নজরদারির বাইরে থাকতে আন্ডারগ্রাউন্ডে আশ্রয় নিয়েছিল হামাস। গত কয়েক বছরে হামাস বেশ ভালোভাবেই অস্ত্র লুকানোর কৌশল রপ্ত করতে পেরেছে। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার এ সদস্য বলেন, ‘এ কারণে স্যাটেলাইট দিয়ে ইসরায়েল এর স্থলভাগের ওপর নজরদারি করতে পারলেও মাটির নিচের খোঁজ আর দিতে পারেনি।’

এ হামলায় হামাস সুড়ঙ্গ পথেরও ব্যবহার করেছে বলে জানিয়েছেন ইসরায়েলের সামরিক বিশ্লেষক ইয়াদো হেশত। ইসরায়েল ২০২১ সালে একটি সেন্সরযুক্ত ভূগর্ভস্থ প্রাচীর নির্মাণ করে। এর নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গ তৈরির পরিবর্তে হামাস এক বিকল্প পথে সুড়ঙ্গ তৈরি করে এবং ইসরায়েল বাহিনীকে চমকে দেয়। 

 ২০০৭ সালে গাজার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর থেকে হামাসের নিজস্ব গোয়েন্দা বাহিনীরও সক্ষমতা বেশ উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। পরিবর্তিত এ সক্ষমতা তাদের পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করতে সাহায্য করেছে বলে ধারণা করা হয়। তা ছাড়া চলতি বছরের মে মাসে সংগঠনটির নাটকীয় পরিবর্তন নিয়ে ‘গোয়েন্দা বিভাগ ও জাতীয় নিরাপত্তা’ নামক সাময়িকীতে একটি গবেষণা প্রকাশ করা হয়। 

প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েল সীমান্ত পর্যবেক্ষণে বিশেষ বাহিনী নিযুক্ত রেখেছিল হামাস। তারা ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সব কৌশলী আলাপ আলোচনা শুনে এর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, প্রশিক্ষণ এবং সেনা মোতায়েন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে রাখে। 

কংগ্রেসনাল রিসার্চ সার্ভিসের সাবেক শীর্ষ মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ কেনেথ কাৎজম্যান বলেন, হামাসের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, ইসরায়েলের সীমান্ত তুলনামূলক কম সৈন্য নিযুক্ত, যাদের পরাস্ত করা সম্ভব। এ কারণে তাদের মধ্যে বোমা ফাটিয়ে কাঁটাতারের বেড়া ও চেকপয়েন্ট অতিক্রম করার আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে। এসব তথ্য হামাসকে হামলার নকশা করতে সাহায্য করে। 

তবে হামাস সফলভাবে এ হামলা চালাতে পারার পেছনে ইসরায়েলের নিজস্ব খামখেয়ালিপনাও দায়ী। বিচার বিভাগের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তের জন্য প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে বেশ কয়েক মাস ধরেই বিক্ষোভ করছে ইসরায়েলিরা। এই অন্তঃকোন্দলের কারণে তাদের মনযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। 

গতকাল সোমবার সংবাদমাধ্যম দ্য টাইমস অব ইসরায়েলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, হামাসের পরিকল্পনা নিয়ে মিসরের গোয়েন্দা বিভাগ বারবার সতর্ক করেছিল। তবে, ইসরায়েলের কর্মকর্তারা গাজার পরিবর্তে পশ্চিম তীর নিয়েই ব্যস্ত ছিল। 

এ ছাড়া ইসরায়েলের অতি আত্মবিশ্বাসও এই হামলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।



এএফ/২৪